করো যুক্তি দিয়ে বিশ্ব জয়

আজ থেকে প্রায় ৪০ বছর আগে আমাদের স্কুলপর্যায়ের মেগা ইভেন্ট বলতে বোঝাত জাতীয় টেলিভিশন বিতর্ক প্রতিযোগিতা। না, বিতার্কিকেরা কেউ স্কুলের পড়ুয়া নয়, কিন্তু দর্শকদের বেশির ভাগই তাই। সপ্তাহে দুই দিন সন্ধ্যাবেলায় আমরা টিভির সামনে বসে থাকতাম-জাতীয় টেলিভিশন বিতর্ক প্রতিযোগিতা দেখার জন্য। সন্ধ্যাবেলায় কেবল ওই দুই দিনই টেলিভিশন দেখার সুযোগ পেতাম আমরা। পরদিন স্কুলে গিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ হতো কে কী বলেছেন, কোন যুক্তিটা ভালো ছিল।

না, আমাদের সময় স্কুলে কোনো বিতর্ক ক্লাব ছিল না, কর্মশালাও ছিল না। কিন্তু টিভি দেখতে দেখতে আমরা শিখে ফেলেছি বিতর্কের প্রস্তাবে ‘ই’ প্রত্যয় থাকা না-থাকার অর্থ কী? কেমন করে কেবল যুক্তির পিঠে যুক্তি সাজিয়ে একটি ‘আপাত’-অবধারিত বিষয়ের বিরুদ্ধে বলে জেতা যায়! স্কুলে যখন আলোচনা হতো, তখন আমরা বুঝতাম বড় ভাইয়েরা কেমন করে যুক্তি সাজায়। কোথা থেকে সেটা পায়-আমরা বুঝে ফেলেছি-যুক্তির পেছনের কষ্টটার নাম: পড়ো পড়ো পড়ো। সেই থেকে আমরা কেবল পড়তাম। হয়তো একদিন নিজেরাও যাব বড় বিতর্কের মঞ্চে, এ আশায়। ইন্টারনেট তো ছিল না। তাই যুক্তি আর তথ্যের জন্য ভরসা বই, পত্রিকা।

পাড়ার ক্লাবে যখন বিতর্ক প্রতিযোগিতা বার্ষিক ঘটনাতে পরিণত হলো তখন যুক্তির জন্য দৌড়াতে শুরু করলাম স্যারদের বাসায়। মনে আছে, স্কুলে থাকতে একদিন হাজির হয়েছি চট্টগ্রাম কলেজের বাংলার অধ্যাপক আবু তাহেরের বাসায় বিতর্কের জন্য যুক্তি আর ‘কোটেশন’ জোগাড় করতে! পাশাপাশি কিন্তু চোখ পড়ে থাকত টেলিভিশনে। বুয়েটের হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল, শামসুন নাহার আর রোকেয়া হল, কয়েকটা ক্যাডেট কলেজ। বিতার্কিকদের টিভির পর্দায় দেখলে মনে হতো কত দিনের চেনা!

দলীয় পর্বে দুই দলে থাকত তিনজন করে। দলনেতা পরে দুই মিনিট আলাদা করে সময় পেত বিপক্ষের যুক্তি খণ্ডনের জন্য। সেটির নম্বর ব্যক্তিগত নম্বর হতো না, দলের নম্বরে যোগ হতো। আর ব্যক্তিগত সেরাদের নিয়ে হতো একটি বারোয়ারি বিতর্ক। বিচারকদের মধ্যে থাকতেন আবদুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দীন, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ও সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। বিচারকেরা যখন নম্বর যোগ করতেন, তখন সভাপতি প্রস্তাবের বিষয় নিয়ে কিছু কথা বলতেন। এভাবে বিতর্কের প্রেমে পড়ে আমরা বড় হয়েছি।

এসবের মধ্যে কোনো একবারের বারোয়ারি বক্তৃতায় বুয়েটের শহীদ স্মৃতি হলের আবুল হাসনাতের বক্তৃতা কখনো ভুলিনি। বিষয়বস্তু ছিল-আপনি এ বছরের নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন। পুরস্কার প্রাপ্তির পরে সংবাদ সম্মেলনে বিশ্বশান্তির জন্য আপনার প্রস্তাব তুলে ধরুন।

সবাই শান্তি প্রচেষ্টা, উত্তর-দক্ষিণ সমঝোতা, কমিউনিস্ট ব্লকের সঙ্গে পাশ্চাত্য ব্লকের সমঝোতা-এ রকম নানা কথা বললেন। আর হাসনাত ভাই এসে বললেন সম্পূর্ণ উল্টো। বললেন, তিনি যুদ্ধ করবেন, শান্তির জন্য যুদ্ধ করবেন। প্রথম লাইনটা বলার সঙ্গে সঙ্গে আমরা যারা টিভির সামনে আর যাঁরা বিচারক, সবাই নড়ে বসেছেন! আবুল হাসনাত শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা ধার করে: ‘নাগিনীরা চারি দিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস/শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস...’। এরপর বলতে থাকলেন কোন দেশের কাছে কী কী আগ্নেয়াস্ত্র আছে, সেগুলো দিয়ে মানবসভ্যতার কী কী ক্ষতি করা সম্ভব। বোঝা গেল, সবাই যদি তাদের অস্ত্রভান্ডার রেখে দেয়, তাহলে বিশ্বশান্তির কোনো সম্ভাবনাই নেই। কাজে এসবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে। এ যুদ্ধ হবে যুদ্ধবাজদের বিরুদ্ধে। যুক্তির শৃঙ্খল সাজিয়ে হাসনাত ভাই বললেন, শান্তির জন্য যুদ্ধ দরকার।

আমাদের দৈনন্দিন আড্ডা থেকে শুরু করে স্কুলের ক্লাসরুমে ডান-বামের লড়াইতেও তাই থাকত বিতর্ক এবং কী আশ্চর্য, সেটি কখনো ঝগড়ায় রূপ পেত না। বিতর্কের সারটুকুই আমরা নিতাম। আর শিখে গিয়েছিলাম, কেউ যখন তার যুক্তি বলতে থাকবে, তখন তাকে বাধা দেওয়া যাবে না।

এই বিতর্ক করতে করতে জেনে গেছি পৃথিবীর তিন দল মানুষের কথা। এদের একদল বোকা-কোনো কিছুই যাচাই-বাছাই করে না। কানে হাত না দিয়ে চিলের পেছনে দে দৌড়। দ্বিতীয় দলটি সবকিছুকেই পরখ করে। যুক্তির প্রাবল্যে তাদের কাছে বাকি সবই তুচ্ছ হয়ে যায়। কিন্তু তারাও আটকে পড়ে এই যুক্তিতেই। এরা বুদ্ধিমান কিন্তু জগতের পরিবর্তন করতে পারে না। কিন্তু আমরা খুঁজে ফিরছি তৃতীয় দলকে, যারা যুক্তির শৃঙ্খল থেকে মুক্তির মন্দিরে পৌঁছে যেতে পারে। এরা যুক্তি সাজাতে পারে এবং শেষ পর্যন্ত যৌক্তিক বিষয়টাকেই গ্রহণ করে।

এসবই কেন জানি এখন আর প্রবলভাবে দৃশ্যমান নয় আমাদের স্কুল বিতর্কে। বিতর্ক এখন আর সবার আগ্রহের বিষয় নয়। শুধু যারা বিতর্ক করে, তারাই সেখানে উপস্থিত থাকে। বিতার্কিক ছাড়া বিতর্কপ্রেমীদের দেখা মেলা কঠিনই বটে। সেই কঠিনেরই সন্ধান করতে চাই আমরা স্কুল বিতর্ক উৎসবে। শিল্পগোষ্ঠী টি কে গ্রুপ আর প্রথম আলো মিলে আমরা শুরু করছি ‘পুষ্টি-প্রথম আলো স্কুল বিতর্ক উৎসব’। ২৫ জুলাই এ বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারকও স্বাক্ষরিত হয়েছে। আয়োজন হবে দেশজুড়ে, ৪০টি অঞ্চলে। বিজয়ীরা যোগ দেবে জাতীয় আয়োজনে। চেষ্টা থাকবে একটি বিতর্ক ক্যাম্প করারও।

কেবল তর্কের জন্য বিতর্ক নয়, কেবল জয়-পরাজয়ের জন্যও নয়। এ জীবন খুঁড়ে, সত্য-মিথ্যার কষ্টিপাথরে জীবনবোধকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা। বিতর্ক প্রতিযোগিতা থাকবে বটে, তবে কেবল প্রতিযোগিতায় আটকে থাকব না আমরা। বিতর্ককে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রয়াস নেব। বানানো হবে সৃজনশীল বিতর্কের নমুনা, ছড়িয়ে দেওয়া হবে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। লেখা হবে নিবন্ধ, কেমন করে যুক্তি সাজাতে হয়। লেখা হবে বই।

এ উৎসব তাই খুঁজে ফিরবে একদল উদ্যমী, সৃজনশীল ও পরিবর্তনে আগ্রহী ছেলেমেয়ে। যারা কেবল পিছু নেবে না কিংবা ঘুরপাক খাবে না প্রশ্নের আবর্তে, বরং সত্য-মিথ্যার কষ্টিপাথরে যাচাই করে এগিয়ে যাবে সামনের দিকে।

শুধু যারা বিতার্কিক, তাদের জন্য নয়, যারা গণবক্তৃতায় ভালো হতে চায়, যারা যুক্তির শৃঙ্খল সাজিয়ে মুক্তির মন্দিরে পৌঁছে দিতে চায় লক্ষকোটি জনতাকে, তাদের জন্য শুরু হচ্ছে ঝকঝকে নতুন আয়োজন-পুষ্টি-প্রথম আলো স্কুল বিতর্ক উৎসব।

এ উৎসব সৃষ্টিশীল নতুন প্রজন্মকে ডাক দিয়ে বলবে-করো যুক্তি দিয়ে বিশ্ব জয়।

মুনির হাসান: প্রথম আলোর যুব কর্মসূচির সমন্বয়ক