দলীয় প্রতীক চালুই নষ্টের গোড়া

স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রার্থীর সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক বেশি গভীর
স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রার্থীর সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক বেশি গভীর

৩০ জুলাই একসঙ্গে তিন সিটির নির্বাচন যেভাবে হলো তা শুধু খুলনা ও গাজীপুর মডেলকে ম্লানই করেনি, বরং এমন নির্বাচনের পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার যেভাবে নির্বিকারে সন্তুষ্টি প্রকাশ করতে পারলেন, তা আমাদের আরও গভীরভাবে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করেছে। বিএনপি জিতলে ভালো, আওয়ামী লীগ জিতলে খারাপ কিংবা বিরোধী দলের জেতা মানেই ভালো নির্বাচনের নমুনা-এ ধরনের চিন্তাভাবনা যে পরিবেশে হয়ে থাকে, সেই পরিবেশ ৩০ জুলাই ছিল না। ৩০ জুলাই নির্বাচনী ব্যবস্থায় ‘ব্ল্যাক মানডে’ হিসেবেই বিবেচিত হবে।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন আমাদের জাতীয় ও সাধারণ নির্বাচন ব্যবস্থার ক্ষতি করেছে। এবার আমরা স্থানীয় সরকার ব্যবস্থারও সর্বনাশ ডেকে আনলাম। ভবিষ্যতের মেয়র নির্বাচনগুলো কোন মডেলে হবে? খুলনা, গাজীপুর নাকি বরিশাল, রাজশাহী, নাকি সিলেট মডেলে হবে? আমরা কি এখন স্লোগান তুলব, ‘সূক্ষ্ম কারচুপির’ দিনগুলো ফিরিয়ে দাও। ‘মিডিয়া ক্যুর’ দিনগুলো ফিরিয়ে দাও। সামনেই সাধারণ নির্বাচন। সারা বিশ্ব বাংলাদেশের ভোট ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করছে। যত দূর বুঝতে পারি, আন্তর্জাতিক মিত্র ও উন্নয়ন অংশীদারেরা সরকারকে উঠতে-বসতে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দিতে উৎসাহিত করছে। সার্বিকভাবে একটি সংবেদনশীল পরিস্থিতিতে ব্যালটে প্রকাশ্যে সিল, ছিনতাই করা বা অপেক্ষমাণ ভোটারদের ব্যালট পেপার শেষ হওয়ার খবর অবহিত করার মতো ভিডিও ও আলোকচিত্র গণমাধ্যমে জায়গা করে নিল। অপেক্ষমাণ ভোটাররা জেনেছেন, ব্যালট পেপার শেষ হয়ে গেছে।

আবারও বলছি, পরাজিত প্রার্থীর নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি বলে দাবি করাটা বাংলাদেশের সংস্কৃতির অংশ, এটা ঠিক। কিন্তু তিন সিটিতে যত অনিয়ম ও কলঙ্কিত ঘটনা ঘটল, তাতে এ ধরনের আপ্তবাক্য ব্যবহার করে পার পাওয়া যাবে না। কারও পছন্দ হোক বা না হোক, স্থানীয় সরকার পর্যায়ের পাঁচ সিটির ভোটের দিনের পরিবেশ ভালো ছিল না। মানুষ অবাধে ভোট দিতে পেরেছে বলে প্রতীয়মান হয়নি। লোকে বলে ধীরে ধীরে অবস্থার উন্নতি হয়, কিন্তু দলীয় সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকারের নির্বাচনী ব্যবস্থায় বিরাট ধস নামল। সাধারণ মানুষ এখন আরও বেশি অসহায় বোধ করতে পারে। এই অসহায়ত্ব তাকে প্রতিনিয়ত কুরে কুরে খাবে।

সংসদীয় নির্বাচনে ভোট না দিতে পারার কষ্ট একরকম। ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের মন্দের ভালো দিকও আছে। একটা সান্ত্বনাও আছে। কারণ, হিসেবে বলা হয়েছিল, এটা সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা। এই নির্বাচনের গুণমান নিয়ে প্রশ্ন না তুলতে বলা হয়েছে। বিএনপি বয়কট করেছিল, সেটাও একটা জোরালো যুক্তি ছিল। সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিতদের সঙ্গে এলাকাবাসীর তেমন একটা দেখা-সাক্ষাৎ হয় না। অনেক সাংসদ ভোট শেষে আর নিয়মিত এলাকায় যান না। কিন্তু স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে বিজয়ী কোনো জনপ্রতিনিধির পক্ষে তা সম্ভব নয়। মেম্বার-চেয়ারম্যান ও মেয়র-কাউন্সিলররা এলাকাবাসীর সুখ-দুঃখের সাথি। দৈনন্দিন জীবনে নানা ছোটখাটো অথচ অপরিহার্য কারণে তাঁদের যোগাযোগ ঘটে। সে রকম একটি বাস্তবতায় সকাল ১০টা কিংবা দুপুর ১২টার মধ্যে ভোটাভুটি শেষ হওয়ার মতো কারচুপির অভিযোগ পুকুরচুরির মতো প্রবাদবাক্যকে পানসে করে ফেলেছে।

একসময় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলো সেরে ফেলার কথা ভাবা হয়েছিল। অনেকে দাবি করে থাকেন যে ২০১৩ সালে পাঁচ সিটি (বরিশাল, খুলনা, গাজীপুর, রাজশাহী ও সিলেট) নির্বাচনে বিএনপির কাছে আওয়ামী লীগ হেরে যাওয়ার পরে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ নতুন কৌশল গ্রহণ করে। তা হচ্ছে দলীয় প্রতীকে মেয়র নির্বাচন চালু করা। ২০১৫ সালে মন্ত্রিসভায় এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ড. বদিউল আলম মজুমদারের মতে, স্থানীয় সরকারে নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে চালু করার পক্ষে তিনটি যুক্তি দেওয়া হয়েছিল। এক. দলীয় ‘শৃঙ্খলার’ ভিত্তিতে মনোনয়নপত্র নিশ্চিত করা। দুই. নির্দলীয় নির্বাচন অরাজনৈতিক হয়, তাই স্থানীয় সরকারের নির্বাচনকে রাজনৈতিক রূপ দেওয়া, তিন. বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সহমত রয়েছে যে স্থানীয় সরকারব্যবস্থাও দলীয় ভিত্তিতে হবে। এর সবটাই খোঁড়া যুক্তি। (ডেইলি স্টার, ১৮ অক্টোবর ২০১৫)। যে দেশে স্বীকৃতমতে দলগুলোতে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রচর্চা নেই, যে দেশে খুনোখুনির মতো অপরাধে অভিযুক্ত দলীয় কর্মী বা ক্যাডারের বিরুদ্ধে কোনো দলীয় ব্যবস্থা নেওয়া যায় না,৩৩ লাখ মামলার ভারে জবুথবু আদালতই ব্যবস্থা নেবেন বলে ফেলে রাখা হয়, যে দেশে ‘পকেট ও অ্যাডহক কমিটি’কে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বলে মানতে বাধ্য করা হয়, সেই দেশে ওই তিন যুক্তির কোনোটিই যুক্তিসংগত নয়।

প্রতিবেশী দেশের রাজ্যগুলোতে দলীয় ভিত্তিতে পঞ্চায়েত নির্বাচন করার অভিজ্ঞতা বিচিত্র, অনেকেই বিপদ দেখেছেন। অনেকেই বলবেন যে পশ্চিমবঙ্গে শুরু থেকেই দলীয় ভিত্তিতে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা চালু হয়েছে। তাঁদের উদ্দেশে বলা যায় যে শৃঙ্খলাপূর্ণ দলভিত্তিক ব্যবস্থার প্রবর্তক বামফ্রন্ট তা চালু করেছিল। এখন নিরঙ্কুশবাদ বা দল দূষণের কারণে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনপ্রিয় শাসনে স্থানীয় সরকার নির্বাচন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেসের ক্যাডাররা গত মে মাসে ৪৮ হাজার পঞ্চায়েত আসনের মধ্যে ১৬ হাজারের বেশি আসনে বিরোধী দল বা স্বতন্ত্র কাউকে দাঁড়াতে দেয়নি। তৃণমূলের নেতারা বিনা ভোটে জিতেছেন। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বিস্ময়ের সঙ্গে এই নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচন কমিশনকে এসব ‘নির্বাচিত’ খেলোয়াড়দের শপথ না পড়াতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রের নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্ট বেঞ্চ ৬ আগস্ট এর ফয়সালা দেবেন।

বিস্ময়ের ঘোর তো আমাদেরও কাটেনি। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর সম্প্রতি খুলনা ও গাজীপুর এবং ৩০ জুলাই তিন সিটিতে যা ঘটতে পারল, এরপর আগামী সাধারণ নির্বাচনটি কেমন যাবে, সে বিষয়ে আমরা কোন মডেলে ভাবব, সেটা ভাবতে বিচক্ষণ সিইসি আমাদের সাহায্য করতে পারেন। ১৫৩টি সংসদীয় আসনে বিনা ভোটে পাস করিয়ে নেওয়া যায়, সেটা আমরা বাস্তব হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত স্বপ্নেও কল্পনা করিনি। ২০১৪ সালে সেটা ঘটে গেছে। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় স্থানীয় সরকারের কোনো স্তরের নির্বাচন করা যায়, তা আমাদের ভাবনার মধ্যেও আসেনি। এখন মনে হচ্ছে সবই সম্ভব।

আমাদের মতো বিহার নির্দলীয় ভিত্তিতেই পঞ্চায়েতকে দাঁড় করিয়েছিল। তৃণমূলে দল গড়া, মাওবাদী প্রভাব কমানোর (কারণ শত শত মাওবাদী জয়ী হচ্ছিল) মতো স্থানীয় কারণ বিবেচনায় তারা পঞ্চায়েতের নির্বাচন দলীয় করল। জম্মু ও কাশ্মীরে নির্দলীয় ভিত্তিতে হচ্ছে। কর্ণাটকে ২০০৫ সালে যখন দল ভিত্তিতে করার কথা উঠল, মহিশুর হাইকোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি এবং এমনকি কর্ণাটক হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি ডি এম চন্দ্রশেখর নির্বাচন কমিশনে ছুটে গেলেন। তাঁরা বললেন, একে বাঁচান। স্থানীয় সরকারে দলবাজি ঢোকাবেন না। যদিও এটা সত্য যে ভোটারদের কাছে প্রার্থীদের দলীয় পরিচয় গোপন থাকে না। কিন্তু দলীয় প্রতীক ঢোকানোর মধ্যে যে তফাত রয়েছে, সেটা অস্বীকার করা যাবে না। কর্ণাটকে তিন স্তরবিশিষ্ট নির্দলীয় স্থানীয় সরকারব্যবস্থা ১৯৯৩ সালে সংবিধানে যুক্ত করা হয়েছিল।

আমরা পশ্চিমবঙ্গ ও কর্ণাটক থেকে এই শিক্ষা নিতে পারি যে আমাদের দেশে যখন পেশাজীবী সংগঠনসহ প্রায় সবকিছুই রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত হয়ে গেছে, তখন স্থানীয় সরকারকে রেহাই দেওয়া হোক। দলীয় বিদ্রোহ ঠেকানো মুশকিল ভেবে কাউন্সিলরদের নির্বাচনকে নির্দলীয় রেখেছিল। এবার ৩০ জুলাইয়ের নির্বাচন থেকে আমরা যে শিক্ষা পেলাম, তা বিবেচনায় নিয়ে বলতে হচ্ছে মেয়র পদকে নির্দলীয় রাখুন। জাতীয় রাজনীতির রেষারেষির ক্ষেত্র হওয়া থেকে একে বাঁচান।

বিএনপি এ জন্য চাপ দেবে, সেই ভয় অবশ্য সরকারের নেই।

মিজানুর রহমান খান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক
mrkhanbd@gmail. com