পাকিস্তান-ভারত পানিযুদ্ধ

সমকালীন পাকিস্তান সম্পর্কে ওয়াকিবহাল মাত্রই জানেন, দেশটির প্রধান বিচারপতি মিয়া সাকিব নিসার রাজনৈতিক অঙ্গনেও একজন নিত্য-আলোচিত ব্যক্তি। তাঁর এরূপ ভূমিকা নিয়ে সে দেশে বিতর্ক আছে। কৌতূহলের বিষয়, প্রতিনিয়ত তিনি নিজের পরিসর বাড়াতেও সক্রিয়।

অনেক দিন ধরে সাকিব নিসার দেশের হাসপাতালগুলো সফর করছেন। তিনি সেগুলোর সুশাসন উন্নত করতে চান। সর্বশেষ তিনি গত মাসে উচ্চ আদালতকে ব্যবহার করে দেশে দুটি বড় আকারের ড্যাম তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন। শুধু নির্দেশ দিয়েই থেমে যাননি, ড্যাম তৈরির তহবিল গড়ে তুলতে ব্যাংক হিসাবও খুলে দিয়েছেন স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানে। দেশে-বিদেশে অবস্থানকারী সব পাকিস্তানির কাছে সাকিব নিসার আবেদন
জানিয়েছেন ওই হিসাবে অর্থ দিতে। মোবাইলে ‘৮০০০’ টিপে এ অর্থ পাঠানোর প্রযুক্তিগত ব্যবস্থাও করে দেওয়া হয়েছে।

নির্বাচনী ডামাডোলের মধ্যেও এই পদক্ষেপ পাকিস্তানজুড়ে বেশ মনোযোগ পেয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, নওয়াজ শরিফের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্কে নাজেহাল প্রধান বিচারপতি জনগণের সহানুভূতি পেতে ড্যাম প্রজেক্টে হাত দিয়েছেন। তবে যে উদ্দেশ্যেই তিনি পানি প্রকল্পে নামুন না কেন, বাস্তবতা হলো, পাকিস্তান এ ক্ষেত্রে প্রকৃতই ভয়াবহ এক সংকটের মুখে পড়েছে।

বহির্বিশ্ব পাকিস্তানের মৌলবাদ ও সন্ত্রাসজনিত সমস্যার কথাই জানে, কিন্তু দেশটি প্রধান যে সংকটে পড়তে যাচ্ছে, তা হলো পানি। অবস্থা না পাল্টালে আগামী এক দশক পর পাকিস্তান তার নাগরিকদের প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহ করতে পারবে না। পাকিস্তানের পানিসম্পদবিষয়ক গবেষণা কাউন্সিল (পিসিআরডব্লিউআর) জানিয়েছে, ২০২৫ সাল থেকে দেশটি ‘পানি দুষ্প্রাপ্যতার যুগে’ প্রবেশ করতে যাচ্ছে। পানি হতে যাচ্ছে বিশ্বের পঞ্চম জনবহুল দেশটির প্রকৃত নিরাপত্তা ইস্যু। এতে উদ্বাস্তুসংকট ও অস্থিরতা বাড়বে। ইতিমধ্যে সিন্ধু ও বেলুচিস্তান বলছে, প্রাপ্ত পানি পাঞ্জাব অযৌক্তিকভাবে বেশি টেনে নিচ্ছে। এভাবে দেশটির প্রদেশে প্রদেশে ভাতৃঘাতী সংঘাতের বিষবৃক্ষও বড় হচ্ছে পানির কারণে।

ভারত যেভাবে পরিস্থিতিতে যুক্ত
পানি নিয়ে পাকিস্তানের জীবন-মরণ সমস্যা হঠাৎ তৈরি হয়নি। প্রয়োজন ও জোগানের ব্যবধান সামনে রেখে কার্যকর কোনো পানি পরিকল্পনা নেই দেশটিতে। দেশটি প্রতিবছর প্রকৃতি থেকে যে পানি পায়, তার মাত্র ১০ ভাগ ধরে রাখার সামর্থ্য তার আছে। তবে অনেক রাজনীতিবিদ মনে করেন, সংকটের মূলে রয়েছে ভারতের বৈরী আচরণ। বিশেষত দুই দেশের মধ্যে ১৯৬০ সালে সম্পাদিত পানি চুক্তি ভারত লঙ্ঘন করে কাশ্মীর অঞ্চলে একের পর এক ড্যাম তৈরি করছে বলে পাকিস্তানের অভিযোগ। এ ক্ষেত্রে কাশ্মীর সীমান্তের ভারতীয় ‘কৃষানগঙ্গা জলবিদ্যুৎ প্রকল্প’-এর উদাহরণ দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী মোদি গত মে মাসে সেটি উদ্বোধন করেন। এ প্রকল্প নির্মিত হয়েছে ঝিলাম নদীর শাখা নিলমের প্রবাহে। এটা পাকিস্তানে পানিসংকটের একটি কারণ হয়েছে।

কৃষানগঙ্গা জলবিদ্যুৎ প্রকল্প উদ্বোধনের সময়ই কিস্তোয়ার জেলায় চেনাবের একটি শাখানদীতে ভারত তিন গুণ বড় আরেকটি ড্যাম প্রকল্প (‘পাকুল দুল’ নামে পরিচিত) শুরুর ঘোষণা দিয়েছে। কাশ্মীরের ভারতীয় ড্যামগুলো নিশ্চিতভাবেই কারাকোরাম-হিমালয় অঞ্চল থেকে সিন্ধু অববাহিকায় পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করছে এবং এরূপ প্রতিবন্ধকতা বাড়াতে নিজের চেষ্টা নয়াদিল্লি গোপন করছে না।

ভারত আফগানিস্তানেও অন্তত ১২টি ড্যাম নির্মাণে বিনিয়োগ করার পরিকল্পনা করছে বলে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। এই ড্যামগুলো কাবুল নদীর পাকিস্তান অংশে প্রবাহ কমিয়ে ফেলবে। আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা ৯টি নদীর মধ্যে কাবুল হলো পাকিস্তানের পানির একটা বড় উৎস। কাবুল ও সিন্ধু নদের মিলনস্থলেই পাকিস্তান কলাবাগ ড্যাম তৈরির পরিকল্পনা করছিল, কিন্তু। সে পরিকল্পনা পাকিস্তান শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন করতে পারেনি। আফগানিস্তানের সঙ্গে পাকিস্তানের পানি নিয়ে কোনো চুক্তি নেই, সেটাও পাকিস্তানের বড় এক দুর্বলতা হয়ে আছে।

ভারতের সশস্ত্র বাহিনীকে নিয়ে পাকিস্তানের সার্বক্ষণিক পাল্টা পরিকল্পনার কথা শোনা গেলেও পানিযুদ্ধ সামাল দিতে তাদের নির্ভরযোগ্য কোনো সুরক্ষা আছে বলে মনে হয় না। অথচ প্রায় ২২ কোটি মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজন ছাড়াও দেশটির অর্থনীতিও ব্যাপকভাবে পানিনির্ভর। ২০০৯ সালে দেশটিতে বছরে মাথাপিছু পানির প্রাপ্যতা ছিল দেড় হাজার কিউবিক মিটার (১ কিমি = ১ হাজার লিটার)। গত বছর তা নেমে এসেছে ১ হাজার ১৭ কিউবিক মিটারে। দেশটির সেচভিত্তিক আবাদের ৯৫ ভাগই সিন্ধু অববাহিকার নদীনির্ভর, এই পানিকে ভারত যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে বলে অভিযোগ। কিন্তু পাকিস্তানের সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনের প্রচারকালে মনে হয়নি দেশটির কোনো রাজনৈতিক দলের পরিস্থিতির ভয়াবহতা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় সচেতনতা আছে। হয়তো পানির সংকটের প্রধান শিকার কৃষকসমাজ বলেই এ উপেক্ষা।

বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় কাজ হলো না
ভারতের সঙ্গে পানির বিবাদে পাকিস্তানের প্রশাসন একমাত্র যে পদক্ষেপ নিয়েছে তা হলো বিশ্বব্যাংকের দ্বারস্থ হওয়া। বিশ্বব্যাংক ১৯৬০ সালের সিন্ধু পানি চুক্তির মধ্যস্থতাকারী ও স্বাক্ষরকারী। এ চুক্তিতে একটি স্থায়ী কাঠামোর প্রস্তাব ছিল, যার ভারত-পাকিস্তানের অভিন্ন নদীগুলোর পানির বিবাদ নিরসন করার কথা। কিন্তু কৃষানগঙ্গা জলবিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে পাকিস্তান ভারতকে থামাতে বিশ্বব্যাংক থেকে প্রয়োজনীয় সক্রিয়তা পায়নি বলে মনে করে। গত মে মাসে ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় ভারত-পাকিস্তানের পানিবিশেষজ্ঞরা বসেছিলেন চলমান বিবাদ নিরসনের লক্ষ্যে। তা সমস্যার কোনো সমাধান দেয়নি।

পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সাত দশকের উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্কের মধ্যেও সিন্ধু পানি চুক্তি একটি ব্যতিক্রমী উদ্যোগ। তিনটি যুদ্ধের পরও এ চুক্তি টিকে আছে। এ চুক্তির মধ্য দিয়ে রবি, সুলেজ ও বিয়াস নদীর ওপর ভারতের বিশেষ অধিকার স্বীকৃত হয় এবং সিন্ধু, চেনাব ও ঝিলামের ক্ষেত্রে অনুরূপ অধিকার পায় পাকিস্তান। কিন্তু শেষোক্ত নদীগুলোর প্রবাহ আসছে ভারত অধিকৃত কাশ্মীর থেকে বা কাশ্মীর হয়ে। ২০১৬ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর উরিতে কাশ্মীরি সশস্ত্র তরুণদের হামলায় ১৮ জন ভারতীয় সেনার মৃত্যুর পর মোদি বলেছিলেন, ‘রক্ত আর পানি একই সঙ্গে বইতে পারে না।’ এর ১১ দিন পরই মোদি তাঁর দেশের পানিবিশেষজ্ঞদের নিয়ে বসেছিলেন সিন্ধু পানি চুক্তি নিয়ে আলোচনার জন্য। মোদি সরকার ঘোষণা না দিয়েই চুক্তি থেকে সরে আসার কৌশল নিতে পারে। অথচ চুক্তি-সংশ্লিষ্ট নদীগুলোর ওপর পাকিস্তানের চার ভাগের তিন ভাগ মানুষের নির্ভরতা রয়েছে।

শুধু কৃষানগঙ্গা জলবিদ্যুৎ প্রকল্পই নয়, ২০১৬-এর জুনের এক হিসাবে দেখা গেছে, কাশ্মীরে ভারতের ৩৩টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মিত হয়েছে বা নির্মাণের কাজ চলছে। কাশ্মীর নিয়ে ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার বড় এক গোপন কারণ সেখানকার নদীর প্রবাহ ও ড্যাম প্রকল্পগুলো। ফলে দুই দেশের মধ্যকার পানিযুদ্ধের বড় ভরকেন্দ্র হয়ে আছে কাশ্মীর। পাকিস্তানে পানির সংকটের ভয়াবহতা ও জম্মু-কাশ্মীরে ভারতের ড্যাম নির্মাণের ব্যাপকতা বলে দেয়, দক্ষিণ এশিয়ায় পানির বিবাদ উত্তেজনাপূর্ণ পর্যায়ে প্রবেশ করতে যাচ্ছে শিগগির।

প্রকৃত লাভবান কে?
পাকিস্তানের সঙ্গে চলমান পানিযুদ্ধে ভারত চূড়ান্তভাবে লাভবান হবে কি না, সেই প্রশ্নে ভিন্নমতও আছে। বিশেষত, ভারত যখনই পাকিস্তানের নদীগুলোর উজানে একতরফা ড্যাম নির্মাণ করবে, চীনের জন্য তখনই ব্রহ্মপুত্রের উজানে একতরফা একই রূপ স্থাপনা নির্মাণে সুবিধা হবে। ভারতের নদীর পানির ২৯ ভাগের উৎস ব্রহ্মপুত্র এবং তার আন্তনদী প্রকল্পসমূহের মূল ভরসা ওই পানি।

আবার পানি নিয়ে ভারতের তরফ থেকে পাকিস্তানের ওপর চাপ যত বাড়বে—অস্তিত্বের সংগ্রামে দেশটি ততই চীনমুখী হবে, যা উপমহাদেশের শক্তির ভারসাম্যে ভারতের বিপক্ষে যায়।

আলতাফ পারভেজ: দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ের গবেষক