ক্ষতির ঝুঁকিতে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র

বিচ্ছিন্ন লড়াইটা শুরু হয়েছিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপের মধ্য দিয়ে। এখন মনে হচ্ছে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ণাঙ্গ বাণিজ্যযুদ্ধটা খুব দ্রুত শুরু হতে যাচ্ছে। যদি ইউরোপের সঙ্গে কোনো ধরনের সমঝোতা চুক্তি হয়, তাহলে যুদ্ধটা প্রধানত চলবে চীনের সঙ্গে। (অবশ্যই কানাডা ও মেক্সিকোর সঙ্গে চলা লড়াইটা চলতেই থাকবে। কেননা যুক্তরাষ্ট্র যেসব জিনিস দাবি করেছে, তা কোনো দেশ মেনে নিতে পারে না বা নেওয়া উচিত হবে না)।

ট্রাম্পের এই বাণিজ্যযুদ্ধের সম্ভাব্য ফলাফল সম্পর্কে আমরা কী বলতে পারি? প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্রের দেশীয় বিনিয়োগ যদি তার সঞ্চয়কে ছাড়িয়ে যেতেই থাকে, তাহলে তাকে পুঁজির জন্য বাইরে থেকে টাকা আনতে হবে এবং এর ফলে বড় ধরনের বাণিজ্য ঘাটতি দেখা দেবে। গত বছরের শেষ নাগাদ কর কর্তন বিল পাসের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব ঘাটতি নতুন রেকর্ডে পৌঁছেছে। সাম্প্রতিক এক হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালের মধ্যে এই ঘাটতির পরিমাণ এক ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। এর অর্থ হচ্ছে ভবিষ্যতে বাণিজ্য ঘাটতি বাড়তেই থাকবে।

চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতির বিষয়ে ট্রাম্পের সংকীর্ণ ফোকাসের কারণে দ্বিপক্ষীয় ভারসাম্যের উন্নতি হতে পারে, যদি অন্য দেশের (বা দেশগুলোর) সঙ্গে ঘাটতি সমপরিমাণ বাড়ে।

যুক্তরাষ্ট্র চীনের কাছে আরও প্রাকৃতিক গ্যাস বিক্রি করতে পারে এবং কম ওয়াশিং মেশিন কিনতে পারে; কিন্তু এটি অন্যান্য দেশে কম প্রাকৃতিক গ্যাস বিক্রি করবে এবং ওয়াশিং মেশিন কিনবে বা থাইল্যান্ড বা অন্য কোনো দেশ থেকে অন্য কিছু কিনবে, যারা কিনা ট্রাম্পের রোষানল এড়াতে পেরেছে। কিন্তু যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র বাজারে হস্তক্ষেপ করেছে, তাই এটি আমদানি করার জন্য আরও বেশি অর্থ প্রদান করবে এবং রপ্তানি করে খুব বেশি অর্থ পাবে না। সংক্ষেপে বলা যায়, এখনকার চেয়েও যুক্তরাষ্ট্রের পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। যুক্তরাষ্ট্রের একটি সমস্যা আছে, কিন্তু সেই সমস্যা চীনের নেই। যুক্তরাষ্ট্রের সঞ্চয় খুব সামান্য। তাঁর দেশের অন্য আরও অনেকের মতো তিনি মোটামুটি অদূরদৃষ্টিসম্পন্ন। তিনি যদি অর্থনীতির বিন্দুমাত্র বুঝতেন এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হতেন, তাহলে তিনি জাতীয় সঞ্চয় বাড়ানোর জন্য পদক্ষেপ নিতেন। এতে বহুজাতিক বাণিজ্য ঘাটতিও কমে যেত।

যদি চীন আরও সক্রিয়ভাবে হস্তক্ষেপ করে এবং আরও আক্রমণাত্মকভাবে প্রতিশোধ নেয়, তাহলে মার্কিন-চীন বাণিজ্য ভারসাম্যে পরিবর্তন আসবে। চীনের তার অর্থনীতির ওপর অনেক বেশি নিয়ন্ত্রণ রয়েছে এবং বিনিয়োগ ও রপ্তানির পরিবর্তে দেশীয় চাহিদার ওপর ভিত্তি করে একটি প্রগতি মডেলের দিকে অগ্রসর হতে চায়।

মার্কিন পদক্ষেপগুলো এমন একটা সময়ে নেওয়া হয়েছে, যখন চীন অতিরিক্ত ক্ষমতা পরিচালনা করার চেষ্টা করছে; অন্তত কিছু ক্ষেত্রে। যুক্তরাষ্ট্র এসব কাজ আরও কঠিন করে তুলবে।

এটা অনেক স্পষ্ট, যদি ট্রাম্পের লক্ষ্য হয় যে চীনকে তার ‘মেড ইন চায়না ২০২৫’ নীতি প্রণয়ন থেকে সরিয়ে নেওয়া, তাহলে তিনি প্রায় নিশ্চিতভাবে ব্যর্থ হবেন। আগামী ৪০ বছরের মধ্যে চীন ও উন্নত দেশগুলোর মধ্যে আয়বৈষম্য কমিয়ে আনার লক্ষ্যে ২০১৫ সালে বেইজিং নীতি গ্রহণ করেছিল।

পক্ষান্তরে, ট্রাম্পের কর্মকাণ্ড প্রযুক্তিগত সার্বভৌমত্ব অর্জনের জন্য চীনা নেতাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টিকে দৃঢ় করবে। কারণ তারা এটা উপলব্ধি করতে পারছে যে তারা অন্যের ওপর নির্ভর করতে পারবে না এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সক্রিয়ভাবে প্রতিক্রিয়াশীল।

ট্রাম্পের প্রতি জনসমর্থন আরও হ্রাস পাবে। কেননা মার্কিনরা এটা উপলব্ধি করতে পারছে যে এই বাণিজ্যযুদ্ধে তাদের দ্বিগুণ ক্ষতি হচ্ছে। চীনের প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপের কারণে তারা যে শুধু চাকরি হারাবে তা নয়, মার্কিন শুল্ক বৃদ্ধির কারণে মার্কিন রপ্তানিপণ্যের দাম বাড়বে এবং এতে তারা আর প্রতিযোগিতা করতে পারবে না।

ট্রাম্প দেখিয়েছেন, যখন তাঁর মিথ্যা প্রকাশিত হয় বা তাঁর নীতিগুলো ব্যর্থ হয়, তখন তিনি কীভাবে তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। চীন বারবার যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে যাওয়ার এবং নিজেদের বিজয় ঘোষণা করার নানা উপায় বাতলেছে। কিন্তু তিনি সেগুলো প্রত্যাখ্যান করেছেন। সম্ভবত প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে একটি বৈঠকে সমস্যা সমাধানে কিছুটা সংশোধনের কথা এবং কিছু নতুন উদ্যোগের কথা ঘোষণা করতে পারেন, যা চীন ইতিমধ্যে ঘোষণা করার পরিকল্পনা করেছে এবং যাতে সবাই খুশি হতে পারে। ট্রাম্পকেই এই সমস্যার সমাধান করতে হবে, যা তিনি সৃষ্টি করেছেন। তিনি বিশ্বকে বদলে দিয়েছেন খারাপের দিকে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

জোসেফ ই স্টিগলিৎজ নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ