রুখে দাঁড়ালেই তুমি বাংলাদেশ!

দেশের এই বিপুলসংখ্যক তরুণই আমাদের আগামী, আমাদের ভবিষ্যৎ
দেশের এই বিপুলসংখ্যক তরুণই আমাদের আগামী, আমাদের ভবিষ্যৎ

একরাতে চমকে উঠি ফেসবুক দেখে। রক্তাক্ত স্কুলছাত্রকে ধরাধরি করে নিয়ে যাওয়ার ছবি, হাত বেয়ে চুইয়ে পড়া রক্তের ছবি, স্কুলের ইউনিফর্ম আর কেডসের গায়ে রক্তের ছোপ ছোপ চিহ্ন। গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বাহিনীর নির্যাতনের চিত্র নয়, বাংলাদেশের পুলিশের পেটানোর ক্ষত বাংলাদেশের শিশুদের গায়ে!

স্তব্ধ হয়ে বসে থাকি অনেকটা রাত। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় হাতুড়ি দিয়ে তরিকুলের পা গুঁড়ো করে দেওয়া হয়েছিল প্রকাশ্যে। গ্রেপ্তার হয়নি হাতুড়িওয়ালা, আর চিকিৎসা ছাড়াই সরকারি হাসপাতাল থেকে বের করে দেওয়া হয় তরিকুলকে। এমন বহু নারকীয় কাণ্ড দেখে দেখে ক্ষুব্ধ গর্জনে ফেটে পড়তে ইচ্ছা হয়েছিল আমারও। কিন্তু এ দেশে এখন গর্জন পাপ, প্রতিবাদ নৈরাজ্য, প্রতিরোধ রাষ্ট্রদ্রোহ। অদ্ভুত এক অবসাদ নেমেছিল দেহে-মনে। ‘ঝিনুক নীরবে সহো’।

কিন্তু নীরবে কি সহা যায় সবকিছু? কোটা সংস্কার আন্দোলনে রাজপথে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের রক্ত। আর এবার রাজপথে একের পর এক হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে রাস্তায় নামা শিশু-কিশোরদের পিটিয়ে রক্তাক্ত করছে পুলিশ! তাদের অপরাধ? একের পর এক বেপরোয়া সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিকার না পেয়ে নেমে এসেছে তারা রাস্তায়। এটুকু প্রতিবাদ সহ্য হচ্ছে না এ দেশের শাসকদের। তাহলে প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষের দেহ সড়কে পিষ্ট হওয়াকে তাঁরা সহ্য করলেন কীভাবে?

ঘুম আসে না অনেকটা রাত। ফেসবুকে দেখি প্রতিবাদী মানববন্ধনে এক মায়ের আর্তচিত্কার। নেতা-নেত্রীদের নামে অভিসম্পাত করছেন তিনি। ‘একটা বোমা মেরে এ দেশের সব মানুষকে মেরে ফেলেন আপনারা!’ বলতে বলতে কেঁদে ওঠেন তিনি। গাড়ি আটকানোতে আমার এক ব্যারিস্টার ভাই কাল হেঁটে হেঁটে এসেছে সুপ্রিম কোর্টে। লিখেছে, ‘তবু আমার আপত্তি নেই, দরকার হলে প্রতিদিন হাঁটব আমরা, তবু আমাদের সন্তানেরা বিচার পাক রাজপথে হত্যাযজ্ঞের।’ সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা আমার সহকর্মীর সঙ্গে। আমেরিকান এমবাসিতে গিয়ে পথে চার ঘণ্টা আটকে ছিলেন তিনি এক জায়গায়। তবু তিনি বললেন, ‘আমাদের কারও খারাপ লাগেনি। দরকাল ছিল এই প্রতিবাদের।’

আসলেই দরকার ছিল এই প্রতিবাদের। এ দেশে এখন যে কারও সন্তানকে নিমেষে পিষে ফেলতে পারে যন্ত্রদানব। কলকবজার ঠিক নেই, চালকের লাইসেন্স নেই, হুঁশ নেই, বয়স নেই। রাজপথকে ফর্মুলা ওয়ানের ট্রাক বানিয়ে সেই গাড়ি নিয়ে নামে অন্ধ প্রতিযোগিতায়। বছরে ১০ হাজার মানুষ মারে তারা, এক বছরে ছাত্রই মেরেছে প্রায় ১ হাজার। শাস্তি? না, শাস্তি নেই কারও। কালেভদ্রে ধরা পড়লে কয়েক দিনের হাজত, কালেভদ্রে বিচার হলে কয়েক মাসের জেল।

সড়কে এই দানবদের হাতে সন্তানদের সঁপে দিয়ে কীভাবে সুস্থ থাকেন মা-বাবা? রাজপথে অজস্র শিশু-কিশোরের মিছিল দেখি আর ভাবি-কী কষ্টে, কী মরিয়া হলে পেটের সন্তানকে রাস্তায় পাঠান মা! এটা কি বুঝতে পারছে আমাদের সরকার? হয়তো বোঝেনই না তাঁরা! কোটি টাকার যানে চড়েন, রাজপথে সবাইকে আটকে রেখে হুইসেল বাজিয়ে নির্বিঘ্নে চলাচল করেন তাঁরা। রাস্তায় চলার যন্ত্রণা, রাস্তায় চলার ঝুঁকি কেমন করে বুঝবেন তাঁরা?

২.
কিন্তু তাঁদের কিছু জিনিস বোঝার সময় এসেছে, কিছু প্রশ্ন বিবেচনার। আমাদের আমজনতার সন্তানেরা রাস্তায় প্ল্যাকার্ড নিয়ে নেমেছে, জনপ্রতিনিধিদের সপ্তাহে তিন দিন পরিবহনে চড়তে হবে। আমি ভাবি, ব্রিটেনে পারে, ভারতে পারে, আপনারা পারেন না কেন? আর যদি না-ই পারেন, কেন আপনাদের চলতি পথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকতে হবে নারী, শিশু, বৃদ্ধ, অসুস্থ সবাইকে? গণপরিবহনে চড়তে পারেন না, রাস্তায় অপেক্ষা করতে পারেন না, পারেন না এ দেশে নিজেদের সন্তানদের রেখে পড়াতে, পারেন না এ দেশের হাসপাতালে নিজেদের চিকিৎসা করাতে। কেন গণতান্ত্রিক এ দেশে আপনাদের জন্য লাটসাহেবি ব্যবস্থা?
উত্তর আছে কোনো?
প্রশ্ন আরও আছে। রাজপথে পিষ্ট ছাত্রদের খবর শুনে গণপরিবহনের আসল সরদার রাষ্ট্রের নৌমন্ত্রী অবিরাম হেসেছেন। হাসা নাকি তাঁর অভ্যাস। আমাদের আমজনতার সন্তান প্রশ্ন করেছে, নিজের সন্তান অপঘাতে মারা গেলেও কি আপনি হাসতে পারবেন এভাবে?
উত্তর আছে নৌমন্ত্রীর?
আমাদের সন্তানেরা দাবি করেছে, নয় টাকায় এক জিবি না, সড়কে নিরাপত্তা চাই। কোনটা উন্নয়ন, সরকার বাহাদুর? প্রাণ নিয়ে স্কুল থেকে ফেরার নিরাপত্তা, নাকি এক জিবির আস্ফালন?
আমাদের সন্তান হাতে লেখে, যদি তুমি রুখে দাঁড়াও, তবে তুমি বাংলাদেশ! আসলে তো এটাই বাংলাদেশ! যে দেশে জীবনের অধিকার চাইলে, বৈষম্যের অবসান চাইলে, নিজের ইচ্ছায় ভোট দিতে চাইলে জীবন দুর্বিষহ করা হয় রাষ্ট্রের বাহিনী দিয়ে, নাকি সেটাই আমাদের বাংলাদেশ? সেই বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্যই কি অকাতরে প্রাণ দিয়েছেন আমাদের লাখ লাখ মানুষ?
আছে কোনো উত্তর?
উত্তর নেই। কারণ, সবকিছুতে সরকার দেখে ষড়যন্ত্র, সরকার পতনের বিভীষিকা! দমন করা হয় মেরেকেটে। রাস্তায় বাম পেটান, ডান পেটান, হুজুর পেটান, কমিউনিস্ট পেটান, বৃদ্ধ, নারী, যুবক পেটান, পেটাচ্ছেন এখন স্কুলছাত্র? কেউ কোনো দাবি করলেই কেন পেটানো হবে? রামপালের বিরুদ্ধে কথা বললে, লুটের হিসাব চাইলে, গুম-খুনের বিচার চাইলে কেন পুলিশ মারতে আসবে?
আর পেটানোর জন্য, অন্যায়-অবিচার করার জন্য, লুট করার জন্য কেনই-বা আমাদের কাছ থেকে ট্যাক্সের টাকা নেওয়া হবে? এই রাষ্ট্রের সংবিধান অনুসারে জনগণের সেবক হওয়ার কথা মন্ত্রী, আমলা ও পুলিশের। কেন সেই জনগণ সেবা চাইলে জনগণের টাকায় পালা বাহিনী দিয়ে পেটানো হবে, জনগণের টাকায় চালানো আদালত দিয়ে জেলে ঢুকিয়ে রাখা হবে, জনগণের টাকায় পরিচালিত রাষ্ট্রের গণমাধ্যম দিয়ে অপবাদ দেওয়া হবে?
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়, রাষ্ট্রের সংবিধানে, গণতন্ত্রের কোন অভিধানে লেখা আছে এসব?

৩.
রাজপথের ছাত্রদের বাড়িতে ফেরার ডাক দেওয়া হচ্ছে এখন। দোষীদের আইনের সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। এত দিন শাস্তি দেননি কেন তাহলে কাউকে? আর জেনেবুঝে মানুষ মারার শাস্তি কীভাবে মাত্র তিন বছরের হতে পারে? লাইসেন্স ছাড়া, ফিটনেস ছাড়া রাজপথে উন্মত্তভাবে গাড়ি চালানো মানেই হচ্ছে চালকের এই জ্ঞানটা আছে যে, এতে মানুষ মরতে পারে। এমন নিশ্চিত জ্ঞান থাকলে পেনাল কোডে হত্যাকাণ্ডের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। যারা জেনেবুঝে এটা করতে দেয়, তাদের জন্যও সমান শাস্তি সেখানে। বেপরোয়া চালক আর বাস-ট্রাকের মালিকদের জন্য কেন তা ভিন্ন হবে? সর্বোচ্চ শাস্তি তিন বছর দিয়ে কি হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার হবে?

রাস্তায় নামা তরুণসমাজের এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। তাদের পিটিয়ে, মামলা দিয়ে, অনুপ্রবেশকারী দিয়ে নাশকতা করে, স্কুল বন্ধ রেখে, মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে, তাদের নামে অপবাদ দিয়ে হয়তো এবারও পার পাওয়া যাবে। কিন্তু তাদের বুকের ধিকিধিকি আগুন নিভবে না তাতে। এই আগুন শহীদ রমিজ উদ্দিন কলেজের দুই ছাত্রের মৃত্যুতে এক দিনে তৈরি হয়নি। এটি তৈরি হয়েছে বহু বছর ধরে রাজপথে বেপরোয়া হত্যাযজ্ঞে, এর কোনো বিচার না পেয়ে, এই হত্যাকারীদের দিয়ে পরিবহন ব্যবসা চালানো সরকারি লোকজনের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেখে দেখে।

দেশের এই বিপুলসংখ্যক তরুণই আমাদের আগামী, আমাদের ভবিষ্যৎ। সব ভয়কে জয় করে তারা একসঙ্গে প্রতিবাদ করেছে। সেই সঙ্গে রাজপথে তৈরি করেছে কিছু অনিন্দ্যসুন্দর দৃশ্য। চাইলেই ভুয়া লাইসেন্স ধরা যায়, উল্টো পথের গাড়ি ফেরানো যায়, সড়কে শৃঙ্খলা আনা যায়-আমাদের বুড়োদের কী অসামান্যভাবেই না তা করে দেখিয়েছে কিশোর-তরুণেরা সরেজমিনে!

ভাবুন তো, এই হিরের টুকরো সন্তানদের নিয়ে কী অসাধারণ একটা দেশই না গড়তে পারতাম আমরা। তা না করে কেমন করে আমরা সব পথ নির্বিঘ্ন রাখি তাদেরই পিষে মারার জন্য!

আসিফ নজরুল: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক