সড়কে অবৈধ ধর্মঘট

যাত্রীদের প্রাণ যায়, তারা বাসে ওঠা বন্ধ করে না, কারণ জানে কোনো লাভ হবে না। কেউ তাদের নিরাপদ সড়ক দেবে না। গতকাল গাজীপুরে মেডিকেল ছাত্রীর মৃত্যুর পরেও অসহায় মানুষ গাড়িতে চড়বে। কিন্তু  সরকারি কর্তৃপক্ষের সহানুভূতিও মিলবে না। কিন্তু পরিবহন সংগঠনের নেতারা জানেন, যাত্রী নিরাপত্তায় নিরুদ্বেগ থাকলে তাঁদের কৈফিয়ত দিতে হবে না। কারও বিচার হবে না। গাড়ির নিরাপত্তার দাবিতে তাঁরা অবৈধ ধর্মঘট ডাকতে পারেন। তাতে তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, কোনো চাপেও পড়তে হবে না। এই অবস্থাটি গ্রহণযোগ্য নয়।

এটা সবারই জানা পরিবহন খাতটি সরকারের কবজায় ও নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। সরকারের একজন মন্ত্রী এর সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। ফলে কোনো ঘোষণা ছাড়া এই যে বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে, তার পেছনে যে সরকারের সায় ও সমর্থন রয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। একই সঙ্গে এমন ধারণা করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, এয়ারপোর্ট রোডে বাসচাপায় শিক্ষার্থীর করুণ মৃত্যুর জের ধরে মনে হচ্ছে, ছাত্রদের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন ও তৎপরতাকে ম্লান করতেই একটা পাল্টা প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবেই অবৈধ ধর্মঘট ডাকা হয়েছে। তারা ছাত্রদের মুখোমুখি হতে ভীত। কারণ, উল্লেখযোগ্যসংখ্যক গাড়ির বৈধ কাগজপত্র নেই। কোনো ধরনের পূর্বঘোষণা ছাড়াই এই ধর্মঘট শুধু অবৈধ নয়, বরং ভয়ানক গণবিরোধী। এর বিরুদ্ধে আদালতে রিট করার বিষয়টি বিবেচনার দাবি রাখে।   

সড়কের নিরাপত্তায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাঁচ দফা নির্দেশনা বাস্তবায়িত হয়নি। এমনকি এসব নির্দেশনা বাস্তবায়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত তিন মন্ত্রী এক মাস চলে গেলেও একটি বৈঠকে বসার দরকার মনে করেননি। বরং নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনের মধ্যে আরও ১১ জনের মৃত্যু ঘটেছে। আর গত সাড়ে তিন বছরে সড়ক দুর্ঘটনা ২৫ হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। আমরা শঙ্কিত যে এখনই উপযুক্ত পদক্ষেপ না নেওয়া হলে সড়ক জনগণের জন্য প্রতিকারহীন এক ভয়াল মৃত্যুফাঁদ হিসেবেই থেকে যাবে।

পরিবহন খাতের দৃশ্যত একশ্রেণির নির্দয় মালিক-মোক্তার যেন ধনুকভাঙাপণ করেছেন যে তাঁরা এই খাতে বিশৃঙ্খল অবস্থাই বজায় রাখবেন। তাঁদের কাছে যাত্রীদের জীবনের চেয়ে বাসের দাম অনেক বেশি। এ কারণে সড়কে মৃত্যুর কোনো পরিসংখ্যান নিয়ে তাঁরা কোনো জবাবদিহির ধার ধারেন না। এক মাস আগে প্রধানমন্ত্রী যেসব পদক্ষেপ নিতে বলেছিলেন, সেসব আইনেই বলা আছে। কিন্তু প্রতীয়মান হচ্ছে, মানুষ যতই লাশ হোক, তাঁদের আইন
মানতে বাধ্য করার কেউ নেই। জনগণের আস্থা ও শ্রদ্ধা অর্জন করতে হলে বিবেকবান পরিবহনমালিকদের এই খাত বাঁচাতে এগিয়ে আসতে হবে। এবং এখনই তার সময়। 

এটা একটি মস্ত পরিহাস যে সরকার পরিবহন খাতের এই অঘোষিত ধর্মঘট নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করছে না। অবৈধ এই ধর্মঘটের বিরুদ্ধে কোনো আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এতে জনগণ যে চরম দুর্ভোগের মধ্যে পড়ছে, তা সরকারের বিবেচনার মধ্যে নেই। অথচ ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকে তারা সুনজরে দেখতে পারছে না। বরং আমরা দেখতে পাচ্ছি এই শিশুদের ওপর হামলা ও নির্যাতনে পুলিশ ও ছাত্রলীগকে ব্যবহার করার মতো ভয়াবহ পথ বেছে নিচ্ছে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এখন যেখানে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। শিক্ষার্থীরা যেসব দাবি তুলে ধরেছে, তাতে অযৌক্তিক কিছু নেই। এখন সরকারের উচিত বিশ্বাসযোগ্যভাবে এসব দাবি মেনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া এবং তা বাস্তবায়নের সময়ভিত্তিক পরিকল্পনা ঘোষণা করা।

আমরা আশা করব, সরকার দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবে। একই সঙ্গে আমরা অবৈধ ধর্মঘটের অবসান চাই।