৪০০৭৭০৭, নতুন শিহরণ

পর্বত মূষিক প্রসব করেনি। শিহরণ জাগিয়েছে। শিহরণ সংখ্যায়। ৪০০৭৭০৭। মানে, ৪০ লাখ ৭ হাজার ৭০৭। আসামের এতজন মানুষ যে ভারতীয় নাগরিক, গত ৩০ জুলাই পর্যন্ত তার অকাট্য প্রমাণ তাঁরা সরকারের ঘরে জমা দিতে পারেননি। পারবেন কি না, সেই মারাত্মক প্রশ্নটা ডেমোক্লিসের খাঁড়ার মতো তাঁদের গর্দানের ওপর ঝুলে রয়েছে। কবে, কোন মুহূর্তে সেই খাঁড়া ঝুপ করে নেমে আসবে, তা অজানা। আপাতত চলছে আতঙ্ক ও আশঙ্কার দিবারাত্রির কাব্য। রাজনীতির তুমুল তরজাও।

আন্দোলনে জেরবার আসামে স্থায়ী শান্তির খোঁজে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী ১৯৮৫ সালে যে চুক্তি করেছিলেন, বিদেশি বিতাড়নের কথা সেখানেই ছিল। ৩৩ বছর পর সেই লক্ষ্যে আসাম ও কেন্দ্রের বিজেপি সরকার দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে যে খসড়া নাগরিক পঞ্জি চূড়ান্ত করেছে, তাতে ওই সামান্য বেশি ৪০ লাখ সংখ্যাটা জ্বলজ্বল করছে। নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে রাজ্যের ৩ কোটি ২৯ লাখ ৯১ হাজার ৩৮৪ জন ফরম তুলেছিলেন। তাঁদের মধ্যে নাগরিকত্বের প্রমাণ প্রশ্নাতীতভাবে জমা দিয়েছেন ২ কোটি ৮৯ লাখ ৮৩ হাজার ৬৭৭ জন। বাকিরা পারেননি। এই বাকিদের মধ্যে রয়েছেন হরেক কিসিমের মানুষ। দেশের এক সাবেক প্রয়াত রাষ্ট্রপতির পরিবারের নিকটজন আছেন, প্রবীণ অবসরপ্রাপ্ত সেনানীর পরিবারের সদস্য আছেন, আছেন স্বামী, স্ত্রী অথবা তাঁদের সন্তানেরা। তালিকা অন্তহীন।

নাগরিক পঞ্জি তৈরির কো-অর্ডিনেটর যিনি, তাঁর নাম প্রতীক হাজেলা। বিভিন্ন সংবাদপত্রে তিনি যে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, তাতে বলেছেন, যাঁরা প্রমাণপত্র দাখিল করেছেন, তাঁরা যে নাগরিক, সে কথা এখনই বলা যাবে না। কারণ, তাঁদের বিরুদ্ধে অন্য কেউ অভিযোগ আনতে পারেন। সেই অভিযোগ খতিয়ে দেখার দায়িত্বও তাঁদের নিতে হবে। যে ৪০ লাখ মানুষের নাম চূড়ান্ত খসড়া তালিকায় ওঠেনি, তাঁরা আবার আবেদনের সময় পাবেন। এসবের পর তৈরি হবে চূড়ান্ত তালিকা। তাতে যাঁদের স্থান হবে না, তাঁদের যাওয়ার জায়গা হলো ট্রাইব্যুনাল। সেখানে সুবিচার না পেলে খোলা থাকবে আদালতের দরজা।

হাজেলার পক্ষ থেকে সুপ্রিম কোর্টে আরও একটি তথ্য দাখিল করা হয় গত ৩১ জুলাই। তাতে বলা হয়, তালিকায় বাদ পড়া ওই ৪০ লাখ মানুষের মধ্যে ৫ লাখ ৭০ হাজারের ঠিকুজি দেশের ২৫টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের সরকারের কাছে পাঠানো হয়েছিল। এই মানুষজন ভিনরাজ্যের বাসিন্দা, কিন্তু চাকরিসূত্রে অথবা বিয়ে করে আসামে বসবাস করছেন। তাঁদের সেই দাবি ঠিক কি না, তা যাচাই করতেই রাজ্যগুলোকে অনুরোধ করা হয়। হাজেলার জমা দেওয়া তথ্য অনুযায়ী রাজ্যগুলো ২ লাখ ৩৭ হাজার মানুষের নথি যাচাইয়ের পর ফেরত পাঠায়নি। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ। হাজেলার তথ্য বলছে, ১ লাখ ১৪ হাজার নামের মধ্যে রাজ্য সরকার ফেরত পাঠিয়েছে মাত্র ৬ হাজার ১০০টি। মানে, মাত্র ৬ শতাংশ! পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিল্লিতে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তাঁর জবাব ছিল, ‘ওরা মিথ্যে কথা বলছে।’

এটা এখন প্রায় নিশ্চিত, ৪০ লাখের তালিকা পরবর্তী ৬ মাসে আরও অনেকটাই কমে যাবে। কতটা কমতে পারে, সেই আন্দাজ হাজেলা দিতে চাননি। তবে আসামের সাবেক কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ বলেছেন, নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়। সরকারি তথ্য অনুযায়ী রাজ্যে ‘ডাউটফুল’ বা সন্দেহজনক ভোটারের সংখ্যা ২ লাখ ৪৮ হাজার।

বড় হয়ে যে প্রশ্নটা ঘুরপাক খাচ্ছে, তা ওই সম্ভাব্য চূড়ান্ত সংখ্যাকে ঘিরে। ৪০ লাখের মধ্যে শেষ পর্যন্ত যাঁরা কোনোভাবেই নিজেদের নাগরিকত্বের (তাঁরা যে ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের আগে থেকে ভারতে বসবাস করছেন) প্রমাণ দাখিল করতে পারবেন না, তাঁদের ভবিষ্যৎ কী? সুপ্রিম কোর্ট ভারত সরকারকে দুটো নির্দেশ দিয়েছিলেন: এক, বাংলাদেশ সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া লাগানোর অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে এবং নদী সীমান্তে চব্বিশ ঘণ্টা টহলদারির বন্দোবস্ত করতে, যাতে অনুপ্রবেশ শূন্যে নেমে আসে; দুই, বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে এমন একটা ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে চিহ্নিত ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের’ ফেরত পাঠানো যায়।

কার্যত অবস্থাটা কী রকম? আসামের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়াল জানিয়েছেন, অনাগরিকদের ভবিষ্যৎ তাঁদের দেখার কথা নয়। দেখবে কেন্দ্রীয় সরকার। রাজ্য ও কেন্দ্র—দুই সরকারেরই শাসকদল বিজেপি। তাদের চোখে প্রমাণ দাখিলে ব্যর্থ মানুষজন ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’। বছরের পর বছর ধরে ‘অবৈধভাবে’ আসামে ঢুকে তাঁরা ‘রাজ্যের জনবিন্যাস বদলে দিয়েছেন’। বিজেপির নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল, এসব অনুপ্রবেশকারীকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে। প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদি নিজেই নির্বাচনী জনসভায় বারবার সে কথা বলেছিলেন।

বাস্তব চিত্রটা কী? প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশে সফর করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ভারতে সফর করেছেন। দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরা একে অন্যের দেশে গেছেন। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং এই সেদিন বাংলাদেশ ঘুরে এলেন। কোনো ভারতীয় নেতা একটিবারের জন্যও বাংলাদেশের সঙ্গে এই ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলেননি! দুই দেশের মধ্যে এ বিষয়ে কোনো চুক্তিও হয়নি। ‘কাতারে কাতারে মানুষ বাংলাদেশ থেকে ভারতে চলে এসেছে’—এই অভিযোগ প্রতিবেশী রাষ্ট্র স্বীকারও করে না। ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী সম্প্রতি বলেছেন, ‘আসামে নাগরিক পঞ্জি তৈরির উদ্যোগ ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এটা দ্বিপক্ষীয় সমস্যা নয়।’ প্রশ্ন এখানেই। ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় যা, তা নিয়ে বাংলাদেশ কেন মাথা ঘামাবে? বিজেপি যে ‘পুশব্যাকের’ কথা বলছে, বাংলাদেশ কেন তাকে মান্যতা দেবে? ভারতে যাঁরা নাগরিক বলে গণ্য হবেন না, তাঁরা যে বাংলাদেশি নাগরিক, কী করে ভারত তা প্রমাণ করবে?

তার মানে সৃষ্টি হতে চলেছে এক অদ্ভুত জটিলতা। কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার অথবা নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) তৈরির দায়িত্বে থাকা কর্তা কিংবা সুপ্রিম কোর্ট—সবাই এ বিষয়ে নীরব। এ জটিলতা আরও বাড়তে পারে আগামী দিনে, নরেন্দ্র মোদির সরকার নাগরিকত্ব সংশোধন বিল পাস করালে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে ‘অত্যাচারিত’ হিন্দু, শিখ, জৈন, পারসি ও বৌদ্ধরা ভারতের নাগরিকত্ব পেয়ে যাবেন। মমতার দাবি, ৪০ লাখের মধ্যে সাড়ে ১২ লাখ হিন্দু। দাবি যা-ই হোক, অমুসলমানরা নাগরিকত্ব পেলে এনআরসির মূল উদ্যোগটাই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাবে। আসামের মানুষ সেটাও পছন্দ করছেন না।

ট্রাইব্যুনাল ও কোর্ট-কাছারি শেষে ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের’ তালিকা কবে চূড়ান্ত হবে, এখনই তা বলা যাচ্ছে না। তবে যখনই হোক, ভারত রাষ্ট্রের কাছে সেটা হবে অবশ্যই বিপুল এক বোঝা। আসামের সাবেক কংগ্রেস নেতা ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পবন সিং ঘাটোয়ার প্রথম আলোকে বিষয়টি ব্যাখ্যা করলেন এভাবে, ‘সংখ্যা যা-ই হোক, লক্ষাধিক মানুষ নাগরিকত্ব হারাবেন। তাঁদের কোথাও ফেরত পাঠানো সম্ভব নয়। অতএব, তাঁরা গণ্য হবেন রাষ্ট্রহীন নাগরিক হিসেবে। সোজা কথায়, উদ্বাস্তু। তাঁদের জন্য শিবির তৈরি করতে হবে। খাওয়া-পরা জোগাতে হবে। ন্যূনতম নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্য দিতে হবে। স্বাস্থ্য ও শিক্ষার বন্দোবস্ত করতে হবে। তার মানে, বিপুল খরচের বোঝা চাপবে সরকারের ঘাড়ে। অথচ এত দিন তাঁরা নিজেরাই নিজেদের ভাগ্যনিয়ন্তা ছিলেন।’

অবশ্যই বোঝা। এনআরসি তৈরিতে এখনো পর্যন্ত খরচ ১ হাজার ২০০ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। উদ্বাস্তু পুনর্বাসন ও ত্রাণ খরচ কিন্তু এককালীন নয়!

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ও তৃণমূল সাংসদ ইতিহাসবিদ সুগত বোস তাঁর আশঙ্কার কথা গোপন করেননি। প্রথম আলোকে তিনি বলেছেন, ‘আমাদের বন্ধু-প্রতিবেশী একটাই। বাংলাদেশ। অনুপ্রবেশকারী তকমা দিয়ে আসামের মানুষদের জবরদস্তির মাধ্যমে ফেরত পাঠানোর চেষ্টা হলে সেই বন্ধুতা শুধু যে চটকে যাবে, তা-ই নয়, আসাম হয়ে উঠবে আরেকটি রাখাইন রাজ্য।’

নাগরিক পঞ্জি তৈরির এই উদ্যোগ বিজেপির কাছে নির্ভেজাল রাজনৈতিক। নজরে তাদের ২০১৯ সালের নির্বাচন। বিজেপির সর্বভারতীয় সম্পাদক রাম মাধবসহ একাধিক নেতা বলেছেন, আসাম দিয়ে শুরু। পরের লক্ষ্য পশ্চিমবঙ্গ। বিজেপির বিশ্বাস, নাগরিক পঞ্জি তৈরিকে কেন্দ্র করে অনুপ্রবেশের রাজনীতি বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোসহ গোটা ভারতেই হিন্দু মেরুকরণে সহায়ক হয়ে উঠবে। দলের এক শীর্ষ নেতার কথায়, ‘ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ভোটব্যাংকের রাজনীতি যারা করে, নাগরিক পঞ্জি তাদের শিরদাঁড়ায় শীতল স্রোত বইয়ে দেবে। ওরা ভয় পেয়েছে।’

বাস্তবিকই। ৪০০৭৭০৭ সংখ্যাটি নতুন শিহরণ বটে।

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি