সংবাদকর্মীদের ওপর আক্রমণ

নিরাপদ সড়কের দাবিতে চলমান শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের খবর সংগ্রহ করার সময় সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের ওপর সরকার-সমর্থিত বলে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা যে আক্রমণ চালিয়েছেন, তা কোনো সভ্য গণতান্ত্রিক দেশে কল্পনাও করা যায় না। আক্রমণকারীরা লাঠি, লোহার রড, রামদা ইত্যাদি নিয়ে কর্তব্যরত সংবাদকর্মীদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছেন, নির্বিচারে আঘাত করেছেন, ক্যামেরা ভেঙে দিয়েছেন, মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়েছেন। কুড়িজনের বেশি সংবাদকর্মী আক্রমণের শিকার হয়েছেন; তাঁদের মধ্যে আহত হয়েছেন ১২ জন।

গত শনি ও রোববার রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরি ও জিগাতলা এলাকায় সরকার-সমর্থিত সশস্ত্র ব্যক্তিরা পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় সংবাদকর্মীদের ওপর এসব পরিকল্পিত ও সংঘবদ্ধ আক্রমণ চালিয়েছেন। এটা নিছক ব্যক্তি-সাংবাদিকের ওপর আক্রমণ নয়, পুরো সংবাদমাধ্যমের ওপর আক্রমণ; অবাধ তথ্যপ্রবাহ, জনগণের তথ্য জানা ও জনগণকে তথ্য জানানোর অধিকার এবং স্বাধীন সাংবাদিকতার ওপর বিরাট আঘাত। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন একপর্যায়ে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে দমন করার চেষ্টার ফলে দেশজুড়ে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে; এমন পরিস্থিতিতে সঠিক সংবাদ সংগ্রহ ও পরিবেশনের গুরুত্ব বিশেষভাবে বেড়ে যায়। বিশেষ করে ইন্টারনেটভিত্তিক অপেশাদার ও অদক্ষ নিউজ পোর্টাল এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব, জল্পনাকল্পনা, উসকানি ইত্যাদি ছড়িয়ে পড়ার যে আশঙ্কা রয়েছে, তা রোধ করার সর্বোত্তম পন্থা সঠিক ও দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার পথ উন্মুক্ত রাখা। কিন্তু দায়িত্বরত সাংবাদিকদের ওপর শারীরিক আক্রমণ ও সম্প্রচারমাধ্যমের কার্যালয়ে চিঠি পাঠিয়ে নানা রকমের নিষেধমূলক নির্দেশনা প্রদান পুরোপুরি বিপরীত পন্থা। তা ছাড়া ইন্টারনেটের গতি কমানোর মাধ্যমে মানুষের আন্তযোগাযোগে বিঘ্ন ঘটালে নেতিবাচক জল্পনাকল্পনা ও গুজব ছড়িয়ে পড়তে পারে, যার ফলে সার্বিক পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটার আশঙ্কা রয়েছে।

লক্ষণীয় বিষয় হলো সংবাদকর্মীদের ওপর আক্রমণ চালানো হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতিতেই। সংবাদকর্মীদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করা ও নিরাপত্তা দেওয়া তাঁদের পেশাগত দায়িত্ব ছিল। তাঁরা সেই দায়িত্ব পালন না করে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন। সংঘবদ্ধ দুর্বৃত্তদের দ্বারা সংবাদকর্মীদের ওপর সশস্ত্র আক্রমণের মতো গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সামনেই সংঘটিত হচ্ছে, কিন্তু তাঁরা সে অপরাধ ঠেকানোর চেষ্টা না করে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছেন—এটা কোনো আইনের শাসনভিত্তিক রাষ্ট্র বা সমাজের চিত্র হতে পারে না।

সংবাদকর্মীদের ওপর সশস্ত্র আক্রমণের স্থিরচিত্র ও ভিডিও চিত্র সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। তা ছাড়া পুলিশ ও গোয়েন্দারা আক্রমণকারীদের সম্পর্কে অনেক তথ্যই সংগ্রহ করতে পারবেন। আক্রমণকারীদের শনাক্ত করা কোনো কঠিন কাজ নয়। তাঁদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করা হোক। সরকার যদি সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে বাধা দেওয়ার নীতি গ্রহণ করে থাকে, তাহলে অবিলম্বে এই নীতি থেকে সরে আসা উচিত। কারণ, এই নীতি বাস্তবায়নের প্রচেষ্টায় শুধু সরকার নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, গোটা জাতি বিরাট ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে।

ফেক নিউজ বা ভুয়া খবর যখন বৈশ্বিক প্রবণতা হয়ে উঠেছে এবং অনেক সমাজে সমস্যার কারণ হচ্ছে, তখন বাংলাদেশের মতো অস্থির রাজনীতির দেশে, বিশেষ করে বর্তমান পরিস্থিতিতে বস্তুনিষ্ঠ ও দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা বিশেষভাবে প্রয়োজন। সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা আমাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব; এ জন্য সংবাদকর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এটা সরকারের দায়িত্ব। আমরা আশা করব, আর একজন সংবাদকর্মীও আক্রমণের শিকার হবেন না; তাঁদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে কোনো ধরনের বাধা সৃষ্টি করা হবে না।