সুশাসনের পক্ষে আদালত

দেশে আমদানি-রপ্তানি পণ্য ওঠানো-নামানো ও গুদামজাতকরণ-সংকটের প্রেক্ষাপটে ১৯৯৮ সালে তদানীন্তন সরকার স্টিভেডরিং সার্ভিসেস অব আমেরিকাকে (এসএসএ) পতেঙ্গা ও পানগাঁওয়ে নির্মাণ, মালিকানা ও পরিচালনার (বিওও) ভিত্তিতে দুটি কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণের অনুমতি দেয়।

প্রকল্পটি একটি অযাচিত প্রস্তাব (আনসলিসিটেড প্রপোজাল) হওয়া সত্ত্বেও দেশের জন্য অতিপ্রয়োজনীয় বিবেচনায় আমরা ইডকল থেকে এ প্রকল্পের ‘ডিউ ডিলিজেন্স’ সাপেক্ষে ৪০-৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের জন্য প্রাথমিক সহায়তাপত্র দিই। আমি ব্যক্তিগতভাবে তদানীন্তন নৌপরিবহনসচিবের সঙ্গে প্রস্তাবটিকে কীভাবে প্রতিযোগিতামূলক করা যায়, সে বিষয়ে আলোচনা করি। এ ব্যাপারে তাঁকে অযাচিত প্রস্তাব প্রতিযোগিতামূলক করার জন্য বিশ্বব্যাপী ব্যবহৃত ‘সুইস চ্যালেঞ্জ’ পদ্ধতি অনুসরণ করার অনুরোধ জানাই। সুইস চ্যালেঞ্জ পদ্ধতিতে একটি সরকারি সংস্থা যেকোনো অযাচিত দর প্রস্তাবের বিশদ বিবরণ দিয়ে তৃতীয় পক্ষকে তা ম্যাচ করতে বা তদপেক্ষা উন্নত প্রস্তাব প্রদান করতে আহ্বান জানানো হয়। উন্নত প্রস্তাব না পাওয়া গেলে মূল অযাচিত প্রস্তাবদাতাকেই প্রকল্প বাস্তবায়নের সুযোগ দেওয়া হয়। এতে প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।

ইতিমধ্যে ২০০০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রকল্পটির অনুমোদনের বিরোধিতা করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সাবেক চেয়ারম্যান মাহমুদুল ইসলামসহ কয়েকজন হাইকোর্ট বিভাগে একটি রিট আবেদন করলে আদালত সরকারের প্রতি রুল জারি করেন। শুনানির পর ২০০২ সালের নভেম্বর মাসে আদালত এ বিষয়ে রায় ঘোষণা করেন। আদালতের রায়ে বলা হয়, প্রকল্পের অনুমোদন ও তৎপরবর্তী সব কার্যক্রম অবৈধ ও আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত।

একদিকে দেশের বন্দরের করুণ অবস্থা, অন্যদিকে বেসরকারি খাত কর্তৃক বাস্তবায়িত বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্পে বিনিয়োগের জন্য ইডকলের কাছে ঋণ দেওয়ার জন্য অর্থ অলস পড়ে আছে। তাই সংবাদপত্রে আদালতের রায় জেনে আমরা বিমর্ষ হয়ে পড়ি। মনে মনে আমাদের দেশের আদালত অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্তরায়, এ ধারণা পোষণ করতে থাকি। যা-ই হোক, কৌতূহলবশত রিট আবেদন ও আদালতের রায়ের অনুলিপি পরে সংগ্রহ করে পড়ি। রিট আবেদন ও রায় পড়ে আগের ধারণা পাল্টে যায় এবং আদালতের প্রতি শ্রদ্ধা জাগে। বুঝতে পারি, আদালত সঠিক কাজটি করেছেন।

প্রায় ১৬ বছর পর রিট আবেদন ও আদালতের রায়টি আবার পড়লাম। রিট আবেদনে উল্লেখ করা মূল অনিয়মগুলো হচ্ছে:
১. প্রস্তাবিত কনটেইনার টার্মিনালটি দেশের স্বার্থের অনুকূল নয় এবং এতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ক্ষতি হবে; ২. বন্দরের কয়েক হাজার শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়বেন এবং বন্দর কার্যক্রমে বিভ্রান্তি ও অনিশ্চয়তা দেখা দেবে; ৩. অনুমোদন দেওয়ার আগে বন্দরের কাজে প্রতিষ্ঠানটির অভিজ্ঞতা বা আর্থিক সামর্থ্যের বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হয়নি; ৪. প্রস্তাবটির সঙ্গে সরকারকে প্রদেয় রয়্যালটি, এককালীন জমা, লাইসেন্স ফি ও রাজস্ব কর বিষয়ে স্পষ্টভাবে কিছু নেই; ৫. কোনো প্রকার স্বচ্ছতা ছাড়া পর্দার আড়ালে কাজটি হয়েছে এবং তাতে সমতা ও জাতীয় স্বার্থের নীতি লঙ্ঘিত হয়েছে; ৬. কনটেইনার টার্মিনাল বিষয়ে এসকাপ ও আংকটাড সুপারিশকৃত নীতিমালা অনুসরণ করা হয়নি; ৭. অন্যান্য কোম্পানি আবেদন করায় উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতি বা সুইস চ্যালেঞ্জ পদ্ধতি অনুসরণ করা অনিবার্য ছিল, কিন্তু তা করা হয়নি এবং ৮. কনটেইনার টার্মিনাল স্থাপন করার জন্য কোনো জাতীয় নীতিমালা, আইন ও বিধিমালা নেই। তাই এসবের অনুপস্থিতিতে তর্কিত অনুমোদন আইনত কর্তৃত্ববহির্ভূত।

সংক্ষেপে আদালতের পর্যবেক্ষণ ও রায় নিম্নরূপ
সরকারের পক্ষ থেকে আদালতকে বলা হয়েছিল যে রিট আবেদনকারীদের বিচারাধীন বিষয়ে হস্তক্ষেপের অধিকার (লোকাস স্ট্যান্ডি) নেই। বিজ্ঞ আদালতের রায়ে বলা হয় যে সরকারি দায়িত্ব পালনে সরকারি ক্ষমতার বা আইনি প্রক্রিয়ার অপপ্রয়োগ বা অপব্যবহার বা সংবিধানের কোনো অনুচ্ছেদের লঙ্ঘনক্রমে কোনো অন্যায় করা হলে আদালতের নজরে তা যে-ই আনুক না কেন বা যেভাবেই আসুক না কেন, সংবিধানের অভিভাবক হিসেবে তা সংশোধন করা ও সুরাহা করা বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের দায়িত্ব।

সরকারের পক্ষে আরও দাবি করা হয়েছিল যে নির্বাহী বিভাগ বন্দর স্থাপনের মতো বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সম্পূর্ণভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত। আদালতের রায়ে বলা হয় যে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত আদালতে প্রশ্নবিদ্ধ করা যায় না, তবে এ ধরনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে নির্বাহী কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত, যথা অধ্যবসায় ও মনোনিবেশসহকারে গৃহীত না হলে, যৌক্তিক না হলে বা ন্যায়ানুগ না হলে, স্বেচ্ছাচারিতামূলক হলে, এবং/অথবা জনস্বার্থের বিরুদ্ধে কোনো ব্যক্তিস্বার্থের অনুকূলে হলে তা আদালতের সামনে প্রশ্নবিদ্ধ হয়। সব সরকারি কর্মের মধ্যে জন-উপাদান নিহিত আছে, সে জন্য সেটা অবশ্যই জনস্বার্থে ও যৌক্তিকভাবে পরিচালিত হতে হবে। সরকার যদি কোনো চুক্তি করে বা কোনো সম্পদ ইজারা দেয় বা কোনো লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের স্বত্ব দান করে, তাহলে যৌক্তিকতা ও জনস্বার্থের নিরিখে সেটার বৈধতা বিচার্য, আর যদি তাতে সেটা না টিকে, তাহলে তা অসাংবিধানিক ও অকার্যকর বলে গণ্য হবে।

সরকারি ক্রয় ও এর সম্পদের নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে অবাধ প্রতিযোগিতার আবশ্যকতা উল্লেখ করে রায়ে বলা হয়, রাষ্ট্রীয় সম্পদ বা ভান্ডার বিলিবণ্টন করতে গিয়ে কোনো সরকারি কর্তৃপক্ষ অবাধে নিজের খেয়ালখুশিমতো চলতে পারে না। উন্মুক্ত বিজ্ঞপ্তি ছাড়া কোনো সরকারি সম্পদভান্ডার কোনো বেসরকারি পক্ষকে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে প্রদান করা হলে তা অন্যকে বঞ্চিত করার এবং সংবিধানের ২৭,৩১ ও ৪০ অনুচ্ছেদ লঙ্ঘনের শামিল।

ইডকল প্রস্তাবিত সুইস চ্যালেঞ্জ বিষয়ে আদালতের রায়ে বলা হয় যে বিলম্বের অজুহাতে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা কিংবা সুইস চ্যালেঞ্জ পদ্ধতি অনুসরণ না করার ছয় সচিবের কমিটির সুপারিশ সদুদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে হয়নি। অর্থাৎ আদালতের কাছে সুইস চ্যালেঞ্জ পদ্ধতি গ্রহণযোগ্য ছিল। অতএব, তখন ইডকলের পরামর্শ অনুযায়ী সুইস চ্যালেঞ্জ পদ্ধতি অনুসরণ করা হলে প্রকল্পটি আইনগত বাধার সম্মুখীন হতো না এবং বেসরকারি খাতে এই সম্ভাবনাময় প্রকল্পের সময়মতো বাস্তবায়ন সম্ভব হতো।

যেহেতু আদালতের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে যে প্রতিবাদী পক্ষকে সরকার যে তর্কিত অনুমোদন দিয়েছে, তা অবৈধ এবং আইনি এখতিয়ারবহির্ভূত, সেহেতু উক্ত রূপ অনুমোদনের ভিত্তিতে কৃত পরবর্তী কর্মপদক্ষেপগুলো একইভাবে অবৈধ।

আদালতে রায়ে তর্কিত অনুমোদন বাতিল করা ছাড়াও দুটি বিশেষ পর্যবেক্ষণ রাখা হয়: ১. অবাধ প্রতিযোগিতা পরিহার ও দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে কাজ করে পরপর দুজন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বিভ্রান্তকারী কর্মকর্তাদের বিষয়ে তদন্ত করা এবং ২. রায়ের অনুলিপি প্রধানমন্ত্রীর পঠন ও কার্যক্রম গ্রহণের জন্য প্রেরণ করা।

মাইলফলক এ রায়ের বিরুদ্ধে যত দূর জানি কোনো আপিল হয়নি। প্রকল্পের বেসরকারি উদ্যোক্তা, সরকার সবাই এ রায় মেনে নিয়েছে।

এখন দিন পাল্টেছে। আদালতের রায়ে উল্লিখিত অনিয়মগুলোকে ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধির বিশেষ আইন, ২০১০’ প্রণয়ন করার মাধ্যমে আইনগত বৈধতা দেওয়া হয়েছে। এতে বিধান করা হয়েছে যে অবাধ প্রতিযোগিতা ছাড়াই কতিপয় পদ্ধতি অনুসরণ সাপেক্ষে যেকোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ, আলোচনা ও দর-কষাকষির মাধ্যমে প্রকল্প অনুমোদন করা যাবে। আইনে আরও বলা হয়েছে, এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্তের বিষয়ে আদালতে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না। সর্বোপরি এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সব ধরনের আইনগত কার্যধারা থেকে দায়মুক্তি প্রদান করা হয়েছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে জরুরি অবস্থার কথা বলে ২০১০ সালে আইন করা হলেও পরপর পাঁচবার এর মেয়াদ বৃদ্ধি করে বর্তমানে ২০২১ সাল পর্যন্ত বলবৎ রাখা হয়েছে। জরুরি অবস্থা আপৎকালীন ব্যবস্থা হলেও বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের জরুরি অবস্থা আর শেষ হয় না!
মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সাবেক সচিব ও প্রতিষ্ঠাতা সিইও ইডকল
fouzul. khan@gmail. com