ঘটনা-দুর্ঘটনায় 'গুজব' ও 'তৃতীয় পক্ষ'

দুই পক্ষ একজোট হয়ে শিক্ষার্থীদের ধাওয়া
দুই পক্ষ একজোট হয়ে শিক্ষার্থীদের ধাওয়া

বাজারে দুটি শব্দের এখন খুব ডিমান্ড। মার মার কাট কাট চাহিদা। একটি হলো ‘গুজব’। অপরটি ‘তৃতীয় পক্ষ’। অজুতবিশ্রুত এই শব্দ দুটির প্রথমটি মৌলিক। দ্বিতীয়টি যৌগিক। দেশের গরম পরিস্থিতিতে শব্দ দুটি এখন জোড়ের ভাইয়ের মতো। এরা এখন একসঙ্গে দেশের চিপাচাপা থেকে রাজপথ-নৌপথ-আকাশপথে উচ্চারিত হচ্ছে।

‘গুজব’-এর নবজন্ম হয়েছে জিগাতলায়। তার জন্মকালে প্রসববিষয়ক সহায়তা দিয়েছে ‘তৃতীয় পক্ষ’।

ছেলেপেলে ক্লাস ফেলে বিনা বেতনে ট্রাফিক পুলিশের কাজ করতে গিয়েছিল। অভিজ্ঞতা না থাকলে যা হয় আরকি! কথা নেই বার্তা নেই তারা যার-তার গাড়ি থামানো শুরু করল। পাকামো করে বলা শুরু করল, ‘আঙ্কেল লাইসেন্স দেখি!’ পুলিশ-বিডিআর-মন্ত্রী-মিনিস্টার কেউ বাদ গেল না। ছেলে-ছোকরার জ্যাঠামি দেখে প্রথমে পুলিশ কিছু বলেনি। কিন্তু কাঁহাতক আর সহ্য করা যায়? একসময় পুলিশ বলল, ‘বাবারা, অনেক হইছে, এইবার যাও!’ কিন্তু পোলাপান যায় না। কী মুসিবত! পুলিশ এইবার ধাওয়া দিল। কাইজা লেগে গেল। দুটো পক্ষ তৈরি হলো। প্রথম পক্ষ হলো ছাত্রপাত্র। দ্বিতীয় পক্ষ হলো পুলিশ। আচমকা সেখানে হাজির হলো ‘তৃতীয় পক্ষ’। তাদের মাথায় হেলমেট। হাতে লাঠি, রামদা, আরও কী সব যন্ত্রপাতি! তারা দ্বিতীয় পক্ষের সঙ্গে একজোট হয়ে মারাত্মক গতিতে মারপিট শুরু করল। পোলাপানও ঢিল খাওয়া মৌমাছির মতো পাল্টা প্রতিরোধ করতে চাইল। কিন্তু ‘তৃতীয় পক্ষ’ বড় মারাত্মক। তারা ‘ধুমায়ে পেটাল’। একদম ‘ফাটায়ে ফেলা’ যাকে বলে। হেলমেট পরা থাকায় তাদের চেনা গেল না।

আগের আমলে টেলিভিশনে লাইভ নিউজ সম্প্রচারের চল ছিল। এখন সেই দিন আর নেই। এখন লাইভ স্ক্রলেরও দেখা পাওয়া কঠিন। ফলে পাবলিকের আসল ‘নিউজ চ্যানেল’ হয়ে দাঁড়িয়েছে ফেসবুক। এখন ‘এক মিডিয়া লোকান্তরে, কোটি মিডিয়া লক্ষ ঘরে’। চীনা প্রযুক্তির কল্যাণে এখন স্মার্টফোনের দাম অনেক কম। ডিজিটাল বাংলার হাতে হাতে এখন স্মার্টফোন। এখন এই দেশে প্রায় দশ কোটি মুঠোফোন। মানে দশ কোটি মিডিয়া। যাদের হাতে স্মার্টফোন, তারা একবেলা উপোস করে হলেও ইন্টারনেটের ডেটা মজুত রাখে। তাদের যার মনে যা আসে, সে তা-ই লিখে ‘সিটিজেন জার্নালিজম’ করে। লাইভে এসে ‘ব্রেকিং নিউজ’ দেয়। কোনো সূত্রটুত্র লাগে না। যেহেতু মূলধারার টিভি নিউজে ‘রংপুরে কাগজিলেবুর বাম্পার ফলন’এবং ‘মধ্যপ্রাচ্যে বিরাট হাউকাউ’র চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিউজ পাওয়া কঠিন, সেহেতু পাবলিকের দোষ দিয়ে লাভ নেই। তারা গরম-গরম যা পায়, তা-ই খায়।

এই রকমের একটি গরম ‘নিউজ’ খাওয়ালেন কেউ কেউ। তাঁরা ‘বিশ্বস্ত সূত্রের বরাত’ দিয়ে ফেসবুক লাইভে এসে বললেন, জিগাতলায় একাধিক ছাত্রকে মেরে ফেলা হয়েছে, ছাত্রীদের ধর্ষণ করা হয়েছে, একজনের চোখ উপড়ে ফেলা হয়েছে। তাঁদের এই ব্রেকিং নিউজের সঙ্গে ‘গুজব’ নামক শব্দটি ভূমিষ্ঠ হলো। জন্ম নিয়েই ‘গুজব’ সর্বগ্রাসী এবং সর্বভুক হয়ে উঠল। গুজব নামক সেই দানব সত্যিকারের ঘটনাও খেয়ে ফেলা শুরু করল।

মূলধারার মিডিয়া বারবার বলতে লাগল, ‘গুজব’!, ‘গুজব’! আসল ঘটনা কী, তারা সেটা পরিষ্কার করল না। ফলে আবার মানুষ ফেসবুকে হুমড়ি খেল। মানুষ বলা শুরু করল, ‘হত্যার কথা গুজব, ধর্ষণের কথা গুজব, চোখ ওপড়ানোর কথা গুজব’। কিন্তু পুলিশের পাশাপাশি তৃতীয় পক্ষ নেমে যে ত্রাসের পরিস্থিতি, সেটি তাহলে কী? এই যে ভিডিওতে সাংবাদিক পেটানোর দৃশ্য দেখা যাচ্ছে, এগুলো তো গুজব নয়! ‘গুজব’ বলার সময় এসব ঘটনার কথা চেপে যাওয়ার চেষ্টা ছিল। এতে গুজব আরও বেশি ছড়িয়ে গেল।

তার মানে গুজবের জন্ম হয়েছে সেটা যেমন সত্যি, তেমনি ‘গুজব, গুজব’! বলে আসল ঘটনা আড়াল করার চেষ্টাটাও সত্যি। এই দুটি ‘সত্যি’ই ভয়ানক। দুটি ‘সত্যি’ই ধ্বংসাত্মক।

আমাদের পুলিশ বাহিনীর দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা কঠিন। তারা ঘাপটি মেরে থাকা ধূর্ত আসামিকে খুব দ্রুত গ্রেপ্তার করে ফেলতে পারে। কিন্তু এই তৃতীয় পক্ষকে খুঁজে পাওয়া তাদের জন্য জটিল।

সরকার বলছে, এরা তাদের লোক নয়। এরা সরকারবিরোধী লোক। এরা তৃতীয় পক্ষ। বিএনপি বলছে, এরা সরকারদলীয় লোক। একদল সাংবাদিক তাদের ‘কতিপয় দুর্বৃত্ত’ বলেছে। কোনো কোনো মিডিয়া এদের বলেছে ‘একদল যুবক’। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘তাদের পরিচয় বের করুন। তাহলে অবশ্যই বিচার করব।’ ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা হামলা চালায়নি। সব গুজব। এখন যে অবস্থা হয়েছে, তাতে সবাই খবর আর গুজবকে মিলিয়ে ফেলছে। গুলিয়ে ফেলছে। ফলে রহস্যময় ‘তৃতীয় পক্ষ’ জোরদার হচ্ছে। মূলধারার সংবাদমাধ্যমের ওপর আস্থাহীনতা যত বাড়বে, ‘গুজব’ তত শক্তিশালী হবে।

সারফুদ্দিন আহমেদ: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক
[email protected]