সংবাদপত্রের পাশে একজন শেখ মুজিব

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

গেল শতকের ষাটের দশক আমাদের জাতীয় ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই দশকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটে, আবার এ সময়েই বিরোধী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের ওপর আইয়ুব-মোনায়েম জুটির দমন-পীড়নও বেড়ে যায়।

সেনাশাসক আইয়ুব তৎকালীন পূর্ববঙ্গের মসনদে বসিয়েছিলেন ময়মনসিংহের ‘বটতলার উকিল’ বলে পরিচিত আবদুল মোনায়েম খানকে। ষাটের দশকের মাঝামাঝি এখানে গণতন্ত্র ও স্বাধিকার আন্দোলন জোরদার হয়। সংবাদপত্রগুলোও সেসব খবর গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করে। বিশেষ করে ইত্তেফাক, আজাদ ও সংবাদ বিরোধী রাজনৈতিক দলের মুখপত্রে পরিণত হয়। এ কারণে মোনায়েন খান এসব পত্রিকার ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেন। আবার দৈনিক পাকিস্তান, মর্নিং নিউজ সব কাজে সরকারকে সমর্থন করার নীতি নেয়। মোনায়েম খান পয়গাম নামে আরেকটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করেন নিজের মাহাত্ম্য প্রচার করতে।

এই ষাটের দশকের একটি ঘটনা তুলে ধরেছেন প্রয়াত সাংবাদিক ফয়েজ আহ্‌মদ তাঁর ‘মধ্যরাতের অশ্বারোহী’ সিরিজের দ্বিতীয় বই সত্য বাবু মারা গেছেন-এ; যাতে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রতি বঙ্গবন্ধুর অঙ্গীকার এবং সাংবাদিকদের প্রতি তাঁর ব্যক্তিগত হৃদ্যতার কথা জানা যায়। ঘটনাটি ১৯৬৫ সালের। তখনো তিনি ছয় দফা কর্মসূচি দেননি। দেশের প্রধান বিরোধী দলের নেতা হিসেবে তাঁর বক্তব্য-বিবৃতি পত্রিকাগুলো গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করে। সেই সময় ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন সরকারের বিরুদ্ধে জোরদার আন্দোলন গড়ে তোলে। আবার আইয়ুব-মোনায়েম খান চক্র সেই আন্দোলন দমন করতে এনএসএফ (ন্যাশনাল স্টুডেন্ট ফেডারেশন) নামে একটি পেটোয়া বাহিনী তৈরি করেছিল।

১৯৬৪ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় এনএসএফের পেটোয়া বাহিনী শহরে সাম্প্রদায়িকতা ছড়ানোর উদ্দেশ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিছিল বের করতে গেলে অর্থনীতি বিভাগের প্রধান আবু মাহমুদ তাঁদের বাধা দিয়ে বলেন, ‘আমার লাশের ওপর দিয়ে তোমাদের শহরে মিছিল নিয়ে যেতে হবে।’ এরপর মোনায়েম খানের নির্দেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আবু মাহমুদকে বিভাগীয় প্রধানের পদ থেকে সরিয়ে দেয়। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন এম ও গনি, তিনি ছিলেন মোনায়েম খানের ঘোরতর সমর্থক। আবু মাহমুদ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অন্যায় আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা করে জিতে যান। রায়ের দিন হাইকোর্ট থেকে ফেরার পথে আবু মাহমুদের বাসার সামনেই তাঁকে হকিস্টিক দিয়ে পিটিয়ে গুরুতর আহত করা হয়।

সে সময় পত্রপত্রিকায় এনএসএফের গুন্ডা বাহিনীর হামলার বিবরণের খবর ছবিসহ ছাপা হয়; যদিও সরকার-সমর্থক পত্রিকাগুলো তা প্রকাশ করেনি। আবু মাহমুদ সরকারি ছাত্রসংগঠনটির কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে থানায় মামলা করেন, আইন অনুযায়ী তাঁদের গ্রেপ্তার হওয়ার কথা। কিন্তু পুলিশ বলেছে, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। যদিও তাঁরা প্রকাশ্যেই সর্বত্র ঘুরে বেড়াতেন।

ফয়েজ আহ্‌মদ জানাচ্ছেন, এই পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, আবু মাহমুদের ওপর আক্রমণকারীরা লাট ভবনে আশ্রয় নিয়েছেন, যাতে পুলিশ তাঁদের গ্রেপ্তার করতে সাহস না পায়। তিনি দুষ্কৃতকারীদের আশ্রয়দাতা হিসেবে গভর্নর মোনায়েম খানকে ইঙ্গিত করেন। শেখ মুজিব সাংবাদিকদের উদ্দেশ করে বলেন, ‘আপনারা আমার দায়িত্ব ও বরাতে লিখে দিন-লাট ভবনে ড. মাহমুদকে আক্রমণকারী ব্যক্তিদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছে।’

এরপর ফয়েজ আহ্‌মদের লেখায় আমরা আরও জানতে পারি, রাতে টেলিফোনে ও মৌখিকভাবে সব পত্রিকাকে জানিয়ে দেওয়া হয় যে এই খবর ছাপা যাবে না। কিন্তু আজাদ নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করে খবরটি ছেপে দেয়; যার শিরোনাম ছিল ‘ড. মাহমুদকে প্রহারকারী ছাত্ররা লাট ভবনে আশ্রয় নিয়েছে: শেখ মুজিব’। এরপর সরকারি মহলে তোলপাড় শুরু হয়। পরদিন সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়, আজাদকে ২০ হাজার টাকা জামানত ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জমা দিতে হবে।

আজাদ কর্তৃপক্ষ সরকারের এই নির্দেশ চ্যালেঞ্জ করে এবং সরকারের বাক্স্বাধীনতা হরণকারী অপচেষ্টার কথা ফলাও করে প্রচার করে। কিন্তু তাদের ভয়, যাঁর উদ্ধৃতি দিয়ে এই খবর ছাপা হয়েছে, তিনি কীভাবে নেবেন। ফয়েজ আহ্‌মদের ভাষায়, ‘কিন্তু আমাদের ভয় ছিল খবরের যিনি সূত্র, শেখ মুজিব বিষয়টি কীভাবে নেন। তিনি যদি অস্বীকার করেন তাহলে আজাদ বিপদে পড়বে।’

রাজনৈতিক চিন্তাচেতনায় পার্থক্য থাকলেও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক ভালো ছিল। ফয়েজ আহ্‌মদ বিকেলে বঙ্গবন্ধুর বাসায় তাঁকে পুরো বিষয়টি বিবৃত করেন। তিনি সরকারি হুকুমনামার কথা শুনে রেগে যান এবং একটি কাগজে লিখে দেন: ‘আমার সাংবাদিক সম্মেলনের যে বক্তব্য আজাদ পত্রিকায় ছাপা হয়েছে, তার প্রত্যেকটি কথা ও শব্দ আমার। কোনো ব্যক্তি বা সরকার চ্যালেঞ্জ করতে চাইলে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনতে পারেন-পত্রিকা বা রিপোর্টারের বিরুদ্ধে নয়।’

এরপর আজাদ ওই দিন বিকেলে বড় কাঠের টাইপে একটি টেলিগ্রাম প্রকাশ করে, যার শিরোনাম ছিল ‘আজাদের ২০ হাজার টাকা জামানত তলব’। আজাদ সেই টেলিগ্রাম বিক্রি করেই জামানতের টাকা তুলে নিয়েছিল। পরদিন পত্রিকার নিয়মিত সংখ্যায়ও খবরটি ফলাও করে প্রকাশিত হয়। ফলে সরকারের নেওয়া স্বৈরাচারী পদক্ষেপ বুমেরাং হয়ে তাকেই ঘায়েল করে।

আমাদের অনেক রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী অনেক কড়া বক্তব্য দিয়ে পরে তা অস্বীকার করেন। যখন তাঁর ধারণ করা বক্তব্যের টেপ বাজিয়ে শোনানো হয়, তখন বলেন, তিনি অন্য কিছু বোঝাতে চেয়েছেন। মনে আছে, আশির দশকের শুরুতে দৈনিক গণকণ্ঠ জাসদের নেতা মেজর (অব.) আবদুল জলিলের বক্তৃতা ছেপে বিপদে পড়েছিল। তাঁর বক্তৃতাটি ছিল জাতীয় সংসদ নিয়ে। জাতীয় সংসদ মেজর জলিলকে তলব করলে তিনি তাঁর বক্তৃতা অস্বীকার করেন। তখন স্মার্টফোন ছিল না। রিপোর্টারের নোটই প্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। সে যাত্রা গণকণ্ঠ প্রতিবেদকের নোট দেখিয়ে রেহাই পায়। অথচ শেখ মুজিবের লিখিত বক্তব্য সম্বল করেই আজাদ সরকারের বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ে জয়ী হয়েছিল।

বঙ্গবন্ধু কারাগারের রোজনাচায়ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথা অনেকবার বলেছেন। ৮ জুন ১৯৬৬ সালে লিখেছেন, ‘ধর্মঘটের কোনো সংবাদ নাই। শুধু সরকারি প্রেসনোট। ইত্তেফাক, আজাদ, অবজারভার সকলেরই একই অবস্থা। একেই বলে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা! ইত্তেফাক মাত্র ৪ পৃষ্ঠা।...খবরের কাগজগুলি দেখে আমি শিউরিয়া উঠলাম। পত্রিকায় নিজস্ব খবর ছাপতে দেয় নাই।’ ১৭ জুনের রোজনামচায় তিনি লিখেছেন, ‘ইত্তেফাক কাগজ আসে নাই। এর পরিবর্তে আমাকে দৈনিক পাকিস্তান দিয়েছে। কারণ জিজ্ঞাসা করলে বলল কাগজ বন্ধ। সরকার নাকি বন্ধ করে দিয়েছে। আর খবর পেলাম রাতে মানিক ভাইয়ের কাছে একটা নোটিশ দিয়ে গিয়েছে। আমরার মনে হলো সরকার নিশ্চয়ই কাগজ বন্ধ করে দিয়েছে। মোনায়েম খান সব পারে। বানরের হাত শাবল।’

৩০ জুনের রোজনামচায় আছে, ‘আজ ইত্তেফাক ও ইত্তেফাকের সম্পাদকের বিরুদ্ধে হামলা, কাল আবার অন্য কাগজ ও তার মালিকের উপর সরকার হামলা করবে না, কে বলতে পারে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বলতে তো কিছুই নাই। এখন ব্যক্তিগত সম্পত্তিও বাজেয়াপ্ত করা শুরু করেছে। পাকিস্তানকে শাসকগোষ্ঠী কোন পথে নিয়ে চলেছে ভারতেও ভয় হয়। আজ দলমত-নির্বিশেষে সকলের এই জঘন্য অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো উচিত।’ (কারাগারের রোজনামচা, শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলা একাডমি, ২০১৭)

বঙ্গবন্ধুর রোজনামচা থেকে আমরা আরও জানতে পারি, সে সময় সংবাদপত্র দলনের বিরুদ্ধে সাংবাদিক সমাজ জোরালো ভূমিকা নিয়েছিল। সরকার ইত্তেফাক বন্ধ করে দেওয়ার পর সাংবাদিক ইউনিয়ন ধর্মঘটও পালন করেছে। তখন সাংবাদিক ইউনিয়ন ছিল অভিন্ন; যেকোনো ইস্যুতে তারা ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত নিতে পারত।

লেখাটি শুরু করেছিলাম ফয়েজ আহ্‌মদের বর্ণিত ঘটনা দিয়ে। তিনি আরও লিখেছেন, দৈনিক আজাদ সরকারবিরোধী ভূমিকা নেওয়ায় গভর্নর মোনায়েম খান পত্রিকায় সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেন। এর প্রত্যুত্তরে আজাদ দীর্ঘ ছয় বছর মোনায়েম খানের কোনো ছবি প্রকাশ করেনি।

পাকিস্তানি জমানায় পত্রিকাগুলো এই সাহস দেখাতে পারত। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে কোনো সরকারের বিরুদ্ধে এ ধরনের সিদ্ধান্তের কথা কি ভাবা যায়?

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]