কেন সৌদি আরব ও কানাডার এই কলহ?

সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ও কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো।
সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ও কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো।

‘সামার বাদাবিসহ অধিকারকর্মী ও সুশীল সমাজের কর্মীদের গ্রেপ্তারে কানাডা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। আমরা তাঁদেরসহ অন্যান্য মানবাধিকারকর্মীকে অবিলম্বে মুক্তি দেওয়ার জন্য সৌদি কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।’ সৌদি আরবে নারী অধিকারকর্মীদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ডের টুইটারে এমন উদ্বেগ প্রকাশ এমন কিছু অশোভন ছিল না। সাদামাটাভাবেই তিনি অধিকারকর্মীদের মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। আর তাতেই যে সৌদি আরব এমন খেপে যাবে, তা কে জানত?

সৌদি আরবের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমালোচনা নতুন কিছু নয়। বিষয়টি নিয়ে আগেও বহুবার রিয়াদ সমালোচনার মুখে পড়েছে। তবে আগে রিয়াদের প্রতিক্রিয়া এতটা কড়া ছিল না। তারা বরাবর এ ধরনের সমালোচনাকে উপেক্ষাই করেছে। কিন্তু এবার সৌদি আরব কানাডার এ আহ্বানকে সহজভাবে নেয়নি। দেশটি এখন কানাডার বিরুদ্ধে তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর অভিযোগ এনেছে।

সৌদি আরব এক বিবৃতিতে বলেছে, কানাডা সব আন্তর্জাতিক প্রটোকলের বিরুদ্ধে গিয়ে সৌদি আরবের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেছে। ফ্রিল্যান্ডের টুইট সৌদি আরবের আইন ও বিচারব্যবস্থার প্রতি সুস্পষ্ট অপমান। কানাডা যদি আরও কোনো পদক্ষেপ নেয়, তাহলে আমরা এটাই বুঝব যে আমাদেরও অধিকার আছে কানাডার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার।

সৌদি আরব শুধু বিবৃতি দিয়ে ক্ষান্ত হয়নি, তারা সে দেশ থেকে কানাডীয় রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করেছে এবং কানাডায় নিযুক্ত সৌদি রাষ্ট্রদূতকেও প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এ ছাড়া কানাডার সঙ্গে নতুন সব বাণিজ্য ও বিনিয়োগ স্থগিত ঘোষণা করেছে। টরন্টোর সঙ্গে নিজেদের বিমান যোগাযোগও স্থগিত করেছে।

তবে কানাডার এ উদ্বেগ ও আহ্বানের পেছনে অবশ্য একটি গল্প আছে। সামার বাদাবি দীর্ঘদিন ধরে তাঁর ভাই একজন সুপরিচিত ব্লগার রাইফ বাদাবির পক্ষে প্রচারণা চালিয়ে আসছিলেন। ইসলাম ধর্ম ত্যাগ এবং ইলেকট্রনিক চ্যানেলের মাধ্যমে ইসলামকে অবমাননার জন্য সৌদি কর্তৃপক্ষ ২০১৪ সালে রাইফকে ১০ বছরের জেল এবং এক হাজার চাবুক মারার নির্দেশ দেয়। ২০১২ সালে রাইফ গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাঁর স্ত্রী এনসাফ হায়দার তাঁর তিন সন্তানকে নিয়ে কানাডায় পালিয়ে যান। গত ১ জুলাই তাঁদের কানাডার নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। এরপর থেকে এনসাফ তাঁর স্বামীর মুক্তির জন্য প্রচারণা চালিয়ে আসছেন, যা সৌদি আরবকে বিরক্ত করেছে। কানাডার প্রতি ক্ষুব্ধ হওয়ার এটাও একটা কারণ হতে পারে।

সৌদি আরবের ক্ষুব্ধ হওয়ার আরেকটি কারণ হতে পারে কানাডার সাবেক প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপারের আমলে করা ১৫ বিলিয়ন ডলারের একটি অস্ত্র চুক্তির ব্যাপারে কানাডীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রশ্ন তোলা। সৌদি শাসকদের নির্যাতনের প্রবণতা এবং দেশটির মানবাধিকার পরিস্থিতি বিবেচনায় এনে সেখানে অস্ত্র রপ্তানির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে সংবাদমাধ্যমগুলো। এই চুক্তিতে সৌদি আরবের কাছে হালকা অস্ত্র বিক্রির কথা বলা হয়েছে, যা সৌদি নেতৃত্বাধীন ইয়েমেনের যুদ্ধে বা খোদ সৌদি নাগরিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হতে পারে। এ ব্যাপারে উদ্বেগ থাকা সত্ত্বেও কানাডার বর্তমান সরকার অস্ত্র চুক্তি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু দেশটির গণমাধ্যমগুলো এর বিরোধিতা করছে।

সৌদি যুবরাজ মোহম্মদ বিন সালমান, যিনি কিনা কার্যত সৌদি আরবের শাসক, এই অস্ত্র চুক্তির ব্যাপারে কানাডীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর মাথা ঘামানোটা একদম পছন্দ করেননি। যুবরাজ নতুন সৌদি আরব গড়তে চান। এ জন্য নানা সংস্কারমূলক কাজ করছেন তিনি। তাই এ সময় তিনি বাইরের দেশ থেকে সমালোচনা শুনতে নারাজ। বাইরের বিশ্বকে তিনি দেখিয়ে দিতে চান, সৌদি আরব দুর্বল কোনো দেশ নয়। আর এটার প্রমাণ দিয়েছেন কাতারের ওপর উপর্যুপরি অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক অবরোধ আরোপ করে। ইয়েমেনে সামরিক অভিযান চালিয়েও রিয়াদ তার শক্তিমত্তা জানান দিয়েছে। কানাডার ব্যাপারে সৌদি আরব এখন পর্যন্ত যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, তাতে এক ঢিলে দুই পাখি মারা হয়েছে। কানাডাকে একটা উচিত জবাব দেওয়া তো হলোই, পাশাপাশি যেসব পশ্চিমা দেশ তাদের সমালোচনা করে, তাদের সৌদি আরবের অবস্থান বুঝিয়ে দেওয়া হলো।

তবে অন্যান্য দেশের তুলনায় কানাডার প্রতি সৌদি আরবের এই পদক্ষেপ অনেক লঘু এবং হাস্যকর রকমের বেখাপ্পা। এ ঘটনায় সবার মধ্যে এ ধারণা জোরদার হয়েছে যে সৌদি অর্থনীতির পরিবর্তনে যে পরিকল্পনা সৌদি যুবরাজ নিয়েছেন, তা বাস্তবায়ন করতে তিনি যথেষ্ট দক্ষ নন। এখন কানাডা কি পারবে সৌদি আরবের সঙ্গে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক যুদ্ধ চালিয়ে যেতে? এমনিতেই কানাডীয়রা যেকোনো ভীতি ও হুমকি মোকাবিলায় দক্ষ। তাই আমার উত্তর হচ্ছে কানাডা পারবে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত। আল–জাজিরা থেকে নেওয়া

বিল ল সাংবাদিক ও মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশ্লেষক