ওই দেখা যায় আন্ডারপাস

চলন্ত যানবাহনের ফাঁকফোকর দিয়ে রাস্তা পার হতে গিয়ে যানবাহনের ধাক্কায় হাত-পা ভাঙা, মাথায় কিংবা শরীরের বিভিন্ন অংশে আঘাত পাওয়ার ঘটনা প্রায়ই ঘটে। ছবি: প্রথম আলো
চলন্ত যানবাহনের ফাঁকফোকর দিয়ে রাস্তা পার হতে গিয়ে যানবাহনের ধাক্কায় হাত-পা ভাঙা, মাথায় কিংবা শরীরের বিভিন্ন অংশে আঘাত পাওয়ার ঘটনা প্রায়ই ঘটে। ছবি: প্রথম আলো

ঢাকার কারওয়ান বাজারে আন্ডারপাসে ঢোকার মুখে দাঁড়িয়ে আছি। সড়কে যানবাহন চলাচল করছে। পায়ে চলা লোকজনের একটা অংশ আন্ডারপাসে মুখের কাছে দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে তাকায়। যানবাহনের চলাচল লক্ষ করে, ফাঁকফোকর খোঁজে। একটু ফাঁক পেলেই দৌড়ে রাস্তা পার হয়। হাতে ও কাঁধে ব্যাগ-বোঁচকা, মাথায় বস্তা কিংবা টুকরি, কানে ধরা মোবাইল ফোন। বিচিত্র বয়সের নারী ও পুরুষ ছুটন্ত যানবাহনের ফাঁকফোকর দিয়ে প্রাণ হাতে নিয়ে রাস্তা পার হয়। এ জন্য সড়ক-বিভাজকের কাঁটাতারের বেড়া কেটে দেওয়া হয়েছে।

মাঝবয়সী দুই নারী-পুরুষ সড়কের ওপার থেকে এপারে এসে পৌঁছালেন। আমি তাঁদের থামালাম। মহিলাকে বললাম, ‘আপা, এই যে আন্ডারপাস। কিন্তু আপনারা আন্ডারপাস ব্যবহার না করে এভাবে রাস্তা পার হলেন কেন, একটু বলবেন?’

মহিলার মুখে লজ্জা-পাওয়া হাসির ভাব। তিনি কিছু বললেন না; তাঁর সঙ্গের পুরুষটি বললেন, ‘শর্টকাট।’

‘কিন্তু এটা যে ভীষণ রিস্কি, তা কি আপনারা জানেন না?’

তাঁরা আর কিছু বললেন না, নিজেদের পথে চলে গেলেন।

এক যুবক মিন্তিওয়ালা খালি টুকরি হাতে নিয়ে রাস্তার ওই পার থেকে এপারে এসে দাঁড়াতেই তাঁকে থামালাম। বললাম, ‘কী ভাই, আন্ডারপাস চোখে দেখেন না? এভাবে রাস্তা পার হলেন কেন?’ যুবক বত্রিশটা দাঁত বের করে একটা হাসি উপহার দিলেন। আমিও হাসতে হাসতে বললাম, ‘মিয়া, হাসতেছেন কেন? কোনো বাস চাপা দিলে তো আপনার সবগুলা দাঁত রাস্তায় ছড়ায়ে-ছিটায়ে পড়ে থাকত।’

মিন্তিওয়ালা হা হা করে হেসে উঠে প্রায় নাচতে নাচতে চলে গেলেন কারওয়ান বাজারের কিচেন মার্কেটের দিকে।

ফুটপাতের তরুণ ফল বিক্রেতা আমাকে বললেন, ‘খাড়ায়ে থাকেন মামা। দেখবেন, কেউ না কেউ বাসের তলে পইড়্যা মরব।’

‘আপনি কাউকে চাপা পড়তে দেখেছেন?’

‘কত দেখলাম! হয় মরে, না হয় হাত-পাও ভাঙে।’

ফার্মগেট থেকে শাহবাগ পর্যন্ত কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউ সড়কে মোট পাঁচটি ফুটওভার ব্রিজ ও একটি আন্ডারপাস আছে। এগুলো ব্যবহার করলে এ সড়কে কোনো রাস্তা পারাপারের সময় একজন মানুষেরও মৃত্যু হওয়ার কথা নয়। কিন্তু দু-এক মাস পরপর এই সড়কে কেউ না কেউ রাস্তা পার হতে গিয়ে মারা যায়। চলন্ত যানবাহনের ফাঁকফোকর দিয়ে রাস্তা পার হতে গিয়ে যানবাহনের ধাক্কায় হাত-পা ভাঙা, মাথায় কিংবা শরীরের বিভিন্ন অংশে আঘাত পাওয়ার ঘটনা প্রায়ই ঘটে। যারা আন্ডারপাস ও ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার না করে এভাবে চলন্ত যানবাহনের ফাঁকফোকর দিয়ে রাস্তা পারাপার হয়, তাদের অনেকের সঙ্গে আমি কথা বলেছি। ‘আপনারা এটা কেন করেন?’ -এ রকম প্রশ্নের উত্তরে কেউ বলেন, ‘তাতে আপনার কী সমস্যা?’ কেউ হেসে এড়িয়ে যান। কেউ বলেন, ‘সবাই তো এভাবেই পার হয়।’ কেউ বলেন, ফুটওভার ব্রিজের ‘সিঁড়িগুলা বেশি উঁচা’; সেগুলোর ওপরে ‘ছিনতাই হয়’, আন্ডারপাসের ভেতরে নোংরা, আলো কম, ভিড়ের ঠেলাঠেলি, ফকিরের উৎপাত এবং ছিনতাইয়ের ভয়।

আন্ডারপাস ও ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার না করে এভাবে চলন্ত যানবাহনের ফাঁকফোকর দিয়ে রাস্তা পারাপারের এই চিত্র শুধু কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউতেই সীমাবদ্ধ নয়; এটা সারা ঢাকা মহানগরের সাধারণ চিত্র। বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাম্প্রতিক গবেষণা জরিপের হিসাব অনুযায়ী, ঢাকা মহানগরের ভেতরে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতি মাসে গড়ে ২৪ জন মানুষ মারা যায়। সাধারণ ধারণা হলো এসব দুর্ঘটনার জন্য যানবাহনের চালকেরাই বেশি দায়ী। বেপরোয়া যান চালানোকে সড়ক দুর্ঘটনার এক নম্বর কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এটা ঢাকার বাইরের সড়ক-মহাসড়কের জন্য যতটা সত্য, ঢাকা মহানগরের ভেতরের সড়কগুলোর জন্য ততটা সত্য নয়। ঢাকার ভেতরে সড়ক দুর্ঘটনায় যারা মারা যায়, তাদের ৬০ শতাংশ পথচারী।

এ বিষয়ে সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান খুঁজে পাইনি। তবে ইউনিভার্সিটি টেকনোলজি মালয়েশিয়ার সহযোগী অধ্যাপক ইশতিয়াক আহমেদ ও আইএমসি ওয়ার্ল্ডওয়াইড লিমিটেডের গবেষক বায়েস আহমেদের এক যৌথ গবেষণাপত্রে ২০১১ সালে ঢাকা মহানগরীর সড়ক দুর্ঘটনার যে হিসাব পাওয়া গেল, সেখানে দেখা যাচ্ছে ওই বছর ঢাকায় মোট ৩৮২টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে, মারা গেছে ২৯০ জন মানুষ। তাদের মধ্যে ২০৮ জনই পথচারী। অবশিষ্ট নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৫৩ জন ইঞ্জিনচালিত যানবাহনের যাত্রী ও চালক এবং ২৯ জন ইঞ্জিনবিহীন যানবাহনের (রিকশা ও বাইসাইকেল) যাত্রী ও চালক। ৩৮২টি সড়ক দুর্ঘটনার মধ্যে ১৯৭টিই ঘটেছে পথচারীদের কারণে; অর্থাৎ চলন্ত যানবাহনের ফাঁকফোকর দিয়ে রাস্তা পারাপারের সময় এসব মানুষ যানবাহনের চাপায় কিংবা ধাক্কায় মারা গেছে।

গত ২৯ জুলাই ঢাকার বিমানবন্দর সড়কে শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী রাজীব ও দিয়া খানমের মৃত্যু এবং আরও ৯ জনের আহত হওয়ার জন্য তারা দায়ী নয়। তারা বাসের জন্য অপেক্ষা করছিল সড়ক থেকে নিরাপদ দূরত্বে, ফুটপাতে দাঁড়িয়ে। কিন্তু দুটি বাস যাত্রী তোলার প্রতিযোগিতায় পরস্পরকে পাল্লা দিতে গিয়ে একটি বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফুটপাতে উঠে তাদের চাপা দেয়। এ জন্য ওই বাসের চালকই দায়ী, হতাহত ব্যক্তিরা কোনোভাবেই দায়ী নয়। বিআরটিএর তদন্তে বাসের চালককেই দায়ী করা হয়েছে। এই দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে ফেটে পড়াই ছিল স্বাভাবিক ও যৌক্তিক। তবে মনে রাখা প্রয়োজন, চালকের দোষে এ ধরনের সড়ক দুর্ঘটনার (hit object off road) হার খুবই কম। উল্লিখিত গবেষণাপত্র অনুযায়ী মাত্র ১ শতাংশ।

এ তথ্য উল্লেখ করার উদ্দেশ্য যানবাহনের চালকদের বেপরোয়া যান চালানোর মারাত্মক প্রবণতাটিকে খাটো করে দেখা বা এড়িয়ে যাওয়া নয়। তাঁদের এই প্রবণতা অবশ্যই বন্ধ করা দরকার। সে উদ্দেশ্যে নতুন আইনে তাঁদের শাস্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে; অষ্টম শ্রেণি পাস ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্সে যান চালানো সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করার অভিযানও নিয়মিত চালানো দরকার। বিআরটিএ ও ট্রাফিক পুলিশের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আমলে নিতে হবে, এসব দূর করার কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

তবে আমরা পথচারীরা যদি সতর্ক না হই, যদি চলন্ত যানবাহনের ফাঁকফোকর দিয়ে রাস্তা পার হওয়ার ঝুঁকি নেওয়া বন্ধ না করি, তাহলে অন্য যা কিছুই করি না কেন, সড়কে আমাদের মৃত্যু বন্ধ হবে না।

মশিউল আলম: প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ও সাহিত্যিক
[email protected]