জনঘনত্ব ও নগর-পরিকল্পনা

ঢাকা এখন পৃথিবীর সর্বোচ্চ জনঘনত্বের শহর। মাত্র ৩২৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই শহরে এখন প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষের বাস। প্রতি বর্গকিলোমিটারে গড়ে প্রায় ৪৫ হাজার। পৃথিবীর কোনো মেগা সিটির জনঘনত্ব ঢাকার জনঘনত্বের কাছাকাছিও নয়। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দুটি সর্বাধিক জনঘনত্বের শহর মুম্বাই ও করাচির জনঘনত্ব ঢাকার চেয়ে এক-তৃতীয়াংশ কম। নিউইয়র্কের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা ম্যানহাটানের জনঘনত্ব ঢাকার জনঘনত্বের চেয়ে ৪০ শতাংশ কম। এ রকম মহানগরের বাসিন্দাদের জীবনযাপনের সার্বিক সুবিধা ও স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করার জন্য যে ধরনের পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন, ঢাকায় তার অভাব অত্যন্ত। অপরিকল্পিত নগরায়ণই যেন-বা ঢাকার প্রধান বৈশিষ্ট্য। তাই এই মহানগরে জীবনযাত্রার মান নিম্নগামী। যত দিন যাচ্ছে, এখানকার জীবন ততই আরও বেশি মাত্রায় সমস্যাপূর্ণ হয়ে উঠছে।

সুতরাং ক্রমবর্ধমান ঢাকা মহানগরকে কীভাবে আরও বাসযোগ্য করা যায়, নাগরিক সুযোগ-সুবিধাগুলো কীভাবে আরও বাড়ানো যায়, জনঘনত্ব আরও বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভবিষ্যতে আরও যেসব সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে, কীভাবে সেগুলোর সমাধান করা যায়—এসব বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করা প্রয়োজন; স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি অনেক পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। নগর বিশেষজ্ঞরা পরিকল্পনা প্রণয়নের তাগিদ দিয়ে চলেছেন, নানা রকমের পরামর্শও দিচ্ছেন। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) দুই দশক মেয়াদি (২০১৬-২০৩৫) একটি বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান—ড্যাপ) প্রণয়নের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।

রাজউক ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) ৪ আগস্ট ঢাকায় এক যৌথ সেমিনারের আয়োজন করেছিল, যেখানে নগর বিশেষজ্ঞরা ঢাকার বিভিন্ন এলাকার জনঘনত্ব সঠিকভাবে নির্ণয় ও নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। কোনো নির্দিষ্ট এলাকার হেক্টরপ্রতি বাসিন্দার সংখ্যা নির্ধারণের দ্বারা ওই এলাকার জনঘনত্ব নির্ণয় করা হয়; এর ভিত্তিতেই ওই এলাকার ভৌত অবকাঠামো নির্মাণের পরিকল্পনা প্রণয়ন করা প্রয়োজন। এ জন্য সংশ্লিষ্ট বিধিবিধান থাকা দরকার। বর্তমানে যে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা আছে, সেখানে পুরো মহানগরের জন্য একই ধরনের ফ্লোর এরিয়া রেশিও নির্ধারণ করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এর ফলে ঢাকার ভবনের উচ্চতা বেশি হয়েছে এবং জনঘনত্ব অনিয়ন্ত্রিতভাবে বেড়েছে। এটা এই নগরের টেকসই ও সুষম উন্নয়নের জন্য সহায়ক নয়। অনেক দেশের মেগা সিটিগুলোর অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বলা যায়, বিশেষজ্ঞদের এই পর্যবেক্ষণ সঠিক।

সেদিনের সেমিনার থেকে জানা গেল, রাজউকের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় (২০১৬-২০৩৫) ঢাকা মহানগরের এলাকাভিত্তিক জনঘনত্ব নির্ণয় ও নিয়ন্ত্রণ এবং ভবনের উচ্চতা নির্ণয় ও নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আরও আগেই এটা করা উচিত ছিল। ঢাকার পূর্বাঞ্চলে নগর সম্প্রসারণের যেসব পরিকল্পনা ও উদ্যোগ চলছে, সেগুলোর ক্ষেত্রে ডেনসিটি জোনিংয়ের কাজ দ্রুত করা প্রয়োজন। সব উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের উদ্যোগে জনঘনত্ব নিয়ন্ত্রণের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। সর্বোপরি সব পরিকল্পনার সুষ্ঠু বাস্তবায়ন এবং সব বিধিবিধানের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।