চার কমিশনারকে ধন্যবাদ

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা আগামী জাতীয় নির্বাচন সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন, সেটি তিনি বুঝে বলুন আর না বুঝে বলুন, তাঁর প্রতিক্রিয়াটি অনুধাবন করবেন আশা করি। তাঁর অনভিপ্রেত মন্তব্যের পর আমরা এই সম্পাদকীয় কলামে লিখেছিলাম, সিইসি ঠিক বলেননি। কোনো বড় নির্বাচনে অনিয়ম পুরোপুরি বন্ধ করা যাবে না, তবে অনিয়ম হলে ইসি ব্যবস্থা নেবে—এই আপ্তবাক্যে দেশবাসী কোনোভাবেই আশ্বস্ত হবে না। বিগত পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সংঘটিত অনিয়ম ও বিচ্যুতি প্রতিকারে নির্বাচন কমিশন কার্যত কিছুই করেনি।

সিইসির বক্তব্য এতটাই অনভিপ্রেত যে ক্ষমতাসীন দলের দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি বলেছেন, দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের আরও সংযত হয়ে কথা বলা উচিত। যেখানে সিইসির রাজনৈতিক নেতাদের সবক দেওয়ার কথা, সেখানে উল্টো তাঁকে সবক দেওয়া নির্বাচন কমিশনের জন্য কতটা অসম্মানজনক, তা-ও ভেবে দেখার বিষয়।

সিইসির বক্তব্যে আগামী নির্বাচন নিয়ে জনমনে যে হতাশা তৈরি হয়েছে, তার কিছু কিছু প্রতিক্রিয়া ইতিমধ্যে পাওয়া গেছে। তবে এই হতাশার মধ্যে ক্ষীণ আলোর রেখা দেখা গেল চারজন কমিশনারের বক্তব্যে, যাঁরা তাঁরই সহকর্মী। প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপকালে তাঁরা বলেছেন, জাতীয় নির্বাচনে অনিয়ম হবে না, সে বিষয়ে নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না বলে সিইসি যে মন্তব্য করেছেন, তা তাঁর ব্যক্তিগত, নির্বাচন কমিশনের নয়। এই চার কমিশনার আরও বলেছেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে তাঁরা জাতির কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সত্য ভাষণের জন্য তাঁদের ধন্যবাদ জানাই। একই সঙ্গে এ কথাও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে শুধু কথায় তো চিড়ে ভিজবে না। নির্বাচনটি অবাধ ও সুষ্ঠু করতে হলে নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি এবং সবার জন্য মাঠ সমতল রাখার পূর্বশর্ত পূরণ করতে হবে।

নুরুল হুদা কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে যে পথনকশা তৈরি করেছিল, তার প্রতি দলমত-নির্বিশেষে সবাই সমর্থন জানিয়েছিল। সেই পথনকশা অনুযায়ী, রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে তাদের আলোচনাও জনমনে কিছুটা আশা জাগিয়েছিল। কুমিল্লা ও রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের অভিজ্ঞতা সেই প্রত্যাশা আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যে ব্যাপক অনিয়ম ও কারচুপির ঘটনা ঘটল, তাতে নির্বাচন কমিশনের প্রতি আস্থা রাখাই কঠিন হয়ে পড়েছে।

মানুষ অতীত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে এগোয়; ভুল সংশোধনের চেষ্টা করে। কিন্তু নির্বাচনের পদাধিকারীদের কথাবার্তা ও আচরণে মনে হচ্ছে তাঁরা অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিতে চান না। যখন আগের সিটি নির্বাচনটির চেয়ে পরের সিটি নির্বাচনে অনিয়ম ও কারচুপির মাত্রা বেড়ে যায় এবং কমিশনের কোনো আদেশ-উপদেশই আর কাজে আসছে না, তখন পদাধিকারীদেরই বেশি উদ্বিগ্ন হওয়ার কথা। কিন্তু তাঁরা সবকিছু ঠিক আছে বলে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে সচেষ্ট থেকেছেন। খুলনা সিটি নির্বাচনের পর কমিশন ভুল সংশোধনের চেষ্টা করলে হয়তো ভোটারদের বরিশালে ভোটকেন্দ্র দখলের মহড়া দেখতে হতো না।

প্রধান নির্বাচন কমিশনের বক্তব্যের রেশ ধরে আমরা বলতে চাই, নির্বাচনে অনিয়ম হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার চেয়ে সেই অনিয়মটি যাতে না হয়, সে বিষয়েই কমিশনকে অধিক মনোযোগী হতে হবে। অতীতের ব্যর্থতা–দুর্বলতা সত্ত্বেও যদি তাঁরা জাতীয় নির্বাচনটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে পারেন, জনগণ অকুণ্ঠ চিত্তে বাহবা দেবে। অন্যথায় পূর্বসূরিদের পরিণতির কথাই তাঁদের স্মরণ করিয়ে দিতে হবে।