সে কহে বিস্তর মিছা যে কহে বিস্তর

গত বুধবার প্রথম আলোর পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে হঠাৎ চোখ পড়ল একটি শিরোনামে, ‘সিইসি বললেন: জাতীয় নির্বাচনে অনিয়ম হবে না, এই নিশ্চয়তা নেই।’ এর আগের দিন আগারগাঁওয়ে নির্বাচন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে এক কর্মশালার উদ্বোধন শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপ করার সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা এ কথা বলেন। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত পাঁচটি সিটি নির্বাচনে বেশ কিছু অনিয়ম হয়েছে। এ অবস্থায় জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কি না-সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, ‘আমরা অস্বস্তিতে নেই। আমরা মনে করি না যে জাতীয় নির্বাচনে এ রকম অসুবিধা হবে। তবে পাবলিক নির্বাচন, বড় বড় নির্বাচনে কোথাও কোনো অনিয়ম হবে না, এই নিশ্চয়তা দেওয়ার সুযোগ আমার নাই।’

তিনি আরও বলেন, কোথাও কোনো অনিয়ম হলে তদন্ত করে কমিশন ব্যবস্থা নেবে।

সিইসিকে উদ্ধৃত করে ইত্তেফাক একটি প্রতিবেদন ছেপেছে আরও বড় করে। বর্তমানে নির্বাচনের পরিবেশ আছে কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেছেন, ‘অসুবিধা কোথায়? আমি তো কোনো অসুবিধা দেখি না। সংবিধানের বিধান অনুসারে নির্বাচন হবে। নির্বাচনী পরিবেশ আছে। আমি তো কোনো অসুবিধা দেখছি না। আমরা মনে করি না সংসদ নির্বাচনে এ রকম কোনো অসুবিধা হবে।’

লক্ষ করার বিষয়, এ মন্তব্যে সিইসি একবচন থেকে বহুবচন, অর্থাৎ ‘আমি’ থেকে ‘আমরা’ হয়ে গেছেন।

নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক সংস্থা। পাঁচজনে মিলে এই কমিশন। সিইসি এই কমিশনের মুখপাত্র, ‘বস’ নন। বিষয়টি এর আগে প্রথম আলোয় প্রকাশিত আমার একটি কলামের প্রতিক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার প্রাঞ্জলভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। নির্বাচনে সেনা মোতায়েন নিয়ে মাহবুব তালুকদারের একটি বক্তব্যে ভিন্নমত প্রকাশ করে সিইসি বলেছিলেন, এটা মাহবুব তালুকদারের ব্যক্তিগত মতামত, নির্বাচন কমিশনের বক্তব্য নয়। প্রশ্ন হলো, নির্বাচন কমিশনের সদস্যরা ব্যক্তিগত মত প্রকাশ্যে দিতে পারেন কি না, বা কেন দেবেন। এ নিয়ে অনেক ভুল-বোঝাবুঝি বা বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে বলেই প্রসঙ্গটি তুলছি।

মঙ্গলবার সিইসি শুধু এখানেই থামেননি। গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন সম্প্রতি বলেছেন, নির্বাচন কমিশনের ওপর জাতির আস্থা নেই। এর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে সিইসি বলেন, ‘ড. কামাল কীভাবে দেখেন, জাতির কী পরিসংখ্যান তাঁর কাছে আছে, তা তো আমি জানি না। একটা কথা বলতে হলে জাতির পরিসংখ্যান নিতে হবে, তাঁর কাছে জাতি বলেছে কি না। ভোট নিয়ে বা কোনোভাবে ড. কামাল সাহেবকে বলেছে কি না যে আমরা জাতি, আস্থা রাখি না। এ রকম কথা তো আমি শুনি নাই।’

বলা বাহুল্য, সিইসি মন্তব্য প্রকাশের ক্ষেত্রে একটি বটমলাইন নির্ধারণ করে দিয়েছেন-কথাবার্তা বলতে হবে জরিপের ভিত্তিতে, অর্থাৎ কেউ যদি অভিযোগ করেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি, তাহলে তাঁকে এর সপক্ষে প্রমাণ হাজির করতে হবে, কত শতাংশ ভোটার মনে করেন যে এটি সুষ্ঠু হয়নি।

নির্বাচন কমিশনাররা পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দেন, এ রকম উদাহরণ অতীতেও আমরা দেখেছি। এই কমিশনেও এটা লক্ষ করা গেছে। কিছুদিন আগেও কয়েকটি বিষয়ে কমিশনের সংখ্যাগরিষ্ঠের নেওয়া সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মাহবুব তালুকদার নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছিলেন এবং তাঁর এই ‘আপত্তি’ রেকর্ড করা হয়েছিল।

বড় ভোটে অনিয়ম হবে না, এর কোনো নিশ্চয়তা দেওয়া যাবে না-এ রকম শিরোনাম প্রায় সব দৈনিকেই হয়েছে। সংবাদের ভেতরে আরও কথাবার্তা থাকলেও ‘বিস্ফোরক’ শব্দগুলো দিয়েই সব পত্রিকা শিরোনাম করেছে। গণমাধ্যমে শিরোনাম তৈরির ব্যাপারে এ ধরনের ঐকমত্য সব সময় দেখা যায় না। তাই বিষয়টা আমাদের ভাবায়। এ ব্যাপারে কৌতূহল নিয়েই আমি যোগাযোগ করলাম নির্বাচন কমিশনের জ্যেষ্ঠ সদস্য মাহবুব তালুকদারের সঙ্গে। এ বিষয়ে আমি তাঁর মন্তব্য জানতে চাইলাম। ‘নির্বাচনে অনিয়ম হবে না, এমন নিশ্চয়তা নেই’-সিইসির এই বক্তব্যের বিষয়ে মাহবুব তালুকদার বলেন, ‘সিইসি কেন এবং কোন প্রেক্ষাপটে এ কথা বলেছেন, তা আমি জানি না। আমি এ কথার সঙ্গে একমত নই। এটা তাঁর ব্যক্তিগত অভিমত হতে পারে। আগামী জাতীয় নির্বাচনে যারা অনিয়ম করতে চায়, তারা এ ধরনের কথায় উৎসাহিত হতে পারে। তবে এটা আমার ব্যক্তিগত অভিমত।’

মাহবুব তালুকদারের বক্তব্যে এটা পরিষ্কার যে সিইসির মন্তব্য একান্তই ব্যক্তিগত। তালুকদারের ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়াও ইঙ্গিতবহ-যারা অনিয়ম করতে চায়, তারা সিইসির এ ধরনের কথায় উৎসাহিত হতে পারে। সোজা কথা হলো সিইসির মন্তব্যে জল ঘোলা হওয়ার মতো বিষয় আছে, উসকানির উপাদান তো আছেই।
নির্বাচন কমিশন খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি সংস্থা। দেশের গণতন্ত্র, সুশাসন, উন্নয়ন, ভবিষ্যৎ-সবই নির্ভর করে দেশের অভিভাবকদের ওপর। আমরা পাঁচ বছর পরপর ভোট দিয়ে তাঁদের নির্বাচিত করি। ভোট যদি ভালো হয়, নির্বাচন যদি সুষ্ঠু হয়, তাহলে আমাদের রাজনৈতিক অভিভাবকেরা জনভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পারবেন। এই প্রক্রিয়ায় কোনো রকম অনিয়ম হলে নির্বাচন হবে প্রশ্নবিদ্ধ। তখন নির্বাচিত প্রতিনিধিদের জবাবদিহির জায়গাটা নষ্ট হয়ে যাবে।

সম্প্রতি সিটি নির্বাচনগুলো নিয়ে অনেক কথাবার্তা, হইচই হয়েছে। গাজীপুরের নির্বাচন নিয়ে পর্যবেক্ষকদের ফোরাম ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৪০ শতাংশ ভোটকেন্দ্রে অনিয়ম হয়েছে। সংখ্যাটি অনেক বড়। আমরা সম্প্রচার গণমাধ্যমে নির্বাচনের সংবাদে শুনেছি, সুষ্ঠুভাবে ভোট গ্রহণ চলছে। একই সঙ্গে ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, ব্যালট পেপার হাতিয়ে নিয়ে যথেচ্ছ সিল মারা হচ্ছে বিশেষ দলের প্রার্থীর মার্কায়। এটা তো গুরুতর অনিয়ম। তো, এ ধরনের অনিয়ম হলে ওই কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ সাময়িকভাবে বা পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু যারা অনিয়ম করে, তাদের বিরুদ্ধে কী ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তা জানা যায় না। সিইসি বলেছেন, অনিয়ম হলে কমিশন ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু অনিয়মের আশঙ্কা তো অমূলক নয়। সুতরাং অনিয়ম যাতে না হয়, তার জন্য প্রতিরোধমূলক কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়, তা নিয়ে আলোচনা হওয়া ও সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি।

নির্বাচন কমিশনের প্রধান বা অন্য সদস্যরা কমিশনের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে ব্যক্তিগত মন্তব্য করে প্রায়ই ধূম্রজাল তৈরি করেন। কেন করেন? সব সময় কি কথা বলতেই হবে? সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করলেই কি চটজলদি জবাব দিতে হবে? সামনে কেউ মাইক্রোফোন ধরলেই কথা বলার জন্য আমরা অনেকেই উসখুস করি। এটা একধরনের বাচালতা। নির্বাচন কমিশনের কর্তাব্যক্তিদের কি প্রগল্ভ হওয়া সাজে?

ভারতচন্দ্রের একটি শ্লোক এখানে উদ্ধৃত করা যেতে পারে। ‘সে কহে বিস্তর মিছা যে কহে বিস্তর’। যিনি বেশি কথা বলেন, তাঁর কথার বেশি অংশই মিছা বা অপ্রাসঙ্গিক বা খাপছাড়া বা গুরুত্বহীন বা প্রলাপ। দরকার কি বেশি কথা বলার? নাকি সিইসির মুখ দিয়ে রূঢ় সত্যটিই বেরিয়ে এসেছে যে সিটি নির্বাচন যেভাবে হচ্ছে, জাতীয় নির্বাচনও সে রকমই হবে? অনিয়মই নিয়ম?

মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক
mohi 2005 @gmail. com