অশুভ চক্র বহাল, দোষ শুধুই চালকের?

সড়কে নৈরাজ্যের পরিপ্রেক্ষিতে কলকাতার ‘অ্যাকসিডেন্ট’ (২০১২) ছবির একটি দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ চাউর হয়ে গেছে, যাকে বলে ভাইরাল হয়ে গেছে। ছবিটির দৃশ্যে দেখা যায়, বাসচালক গাড়ি বের করতে চাইছেন না, কারণ বাসে কিছু সমস্যা আছে। তার চেয়ে বড় কথা, চালক এই বাস চালাতে গিয়ে কিছুদিন আগে দুর্ঘটনা শিকার হয়েছেন। দুর্ঘটনায় একটি শিশু মারা গেছে। ছবিটির কাহিনি এ নিয়েই।


ছবির সেই দৃশ্যে দেখা যায়, চালক মালিকের কাছে অভিযোগ করছেন, ‘বাসে সমস্যা আছে আগেই তো বলেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা ড্রাইভাররা তো আপনার জন্যই কাজ করি।’ তখন মালিক শুরু করেন চরম খিস্তিখেউড়। তিনি বলেন, কিসের মালিক। দৈনিক এই বাসের টিকিট বিক্রি হয় চার হাজার রুপির। ডিজেল লাগে ৬০ লিটার, ২১৬৬ রুপির। চালক ও সহযোগীর কমিশন ৯৬০ টাকা, টায়ার ঠিক করতে ১৫০ রুপি, ইউনিয়নের চাঁদা ১০০০ রুপি, পুলিশের ঘুষ ২০০ রুপি—এরপর মদন মালিকের থাকে ৪২৪ রুপি। তিনি বলেন, ১৯৯৩ সালে এই বাস চালিয়ে দিনে তাঁর ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ রুপি থাকত। এ-ই হচ্ছে বাস্তবতা।

পরিবহন খাতের এই অরাজকতার চিত্র শুধু পশ্চিমবঙ্গের নয়, আমাদেরও। এখন আমরা যা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। ইউনিয়নের দৌরাত্ম্য মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে। এর চেয়েও বড় কথা, ইউনিয়নে শ্রমিকদের নেতৃত্ব নেই, আছে শাজাহান খান প্রকৃতির রাজনীতিকদের নেতৃত্ব; বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময় যা ছিল মির্জা আব্বাসদের হাতে। ইউনিয়নের দখলদারি নিয়ে মারামারি ও সহিংসতার ঘটনাও প্রায়ই ঘটে।

এই অশুভ চক্রের হাতে গোটা দেশের পরিবহন খাত জিম্মি, যার নির্মম শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ, যদিও মানুষের ক্ষোভের শিকার হচ্ছেন শুধু চালকেরা। চালকের অবহেলার কারণে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটলে তার দায় অবশ্যই চালকের। কিন্তু আরেকটি ব্যাপারে আমরা খেয়াল করি না, তা হলো বাসের ফিটনেস না থাকার মূল দায় মালিকের। বাসের চাকা ফেটে গেছে, ব্রেক ঠিকঠাক কাজ করে না—এসব সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব মালিকের। এসব কারণেও কখনো কখনো দুর্ঘটনা ঘটে। ফলে, তখন দুর্ঘটনার দায় এককভাবে চালকের কাঁধে চাপানো যায় না। অথচ পুরো চক্র মানুষের দৃষ্টির বাইরে থেকে যাচ্ছে।

দেশের পরিবহন খাত অনেক বড় হলেও এই খাতের শ্রমিকেরা এখনো অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকের মতোই জীবন যাপন করেন। তাঁদের যেমন নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা নেই, তেমনি নেই কোনো সামাজিক সুরক্ষা। কখনো কখনো চালকদের টানা ২৪ ঘণ্টা বা তার চেয়েও বেশি সময় ধরে গাড়ি চালাতে হয়। তাঁদের মজুরিও দেওয়া হয় ট্রিপভিত্তিক। ফলে, সবার মধ্যেই তাড়া থাকে, যত বেশি ট্রিপ দেওয়া যাবে, তত বেশি উপার্জন। তাই রাস্তায় শুরু হয় প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতার কারণেই দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু হলো, যার প্রতিক্রিয়ায় শিক্ষার্থীদের রাস্তায় নেমে আসা। ব্যাপারটা হলো, গরমের মধ্যে সারা দিন গাড়ি চালালে এবং রাস্তায় পদে পদে নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হলে কার বা মাথা ঠিক থাকে। সে জন্যই পরিবহনশ্রমিকদের মধ্যে বেপরোয়া মনোভাব দেখা যায়। ফলে, এই কর্মক্লান্ত চালকদের পক্ষে দুর্ঘটনা ঘটানো অসম্ভব কিছু নয়। লাইসেন্স পেতে গেলেও পদে পদে ঘুষ দিতে হয় তাঁদের।

এ ছাড়া অপ্রাপ্তবয়স্ক শ্রমিকের হাতে স্টিয়ারিং তুলে দেওয়া চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচায়ক। দেশের মালিকদের হাতে ছবির সেই মদনবাবুর মতো বাসপ্রতি হয়তো এত কম টাকা থাকে তা নয়, শ্রমিকদের ট্রিপভিত্তিক মজুরি দিয়ে বা চুক্তিতে গাড়ি চালিয়ে তাঁরা ভালোই উপার্জন করছেন। কিন্তু এই পুলিশ ও ইউনিয়নের দৌরাত্ম্যে তাঁরাও কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন—এ কথা বললে অত্যুক্তি হয় না। তবে দেশের সড়কে অরাজকতার অন্যতম কারণ হলো অনেক অবসরপ্রাপ্ত আমলা ও পুলিশ কর্মকর্তা গাড়ির মালিক হয়েছেন। ফলে, তাঁদের গাড়ি আটক করা হলেও ব্যবস্থা নেওয়া যায় না, ছেড়ে দিতে হয়।

পরিবহনশ্রমিকেরা মানুষ—এ কথা মাথায় রেখে তাঁদের ব্যাপারটা দেখতে হবে। ট্রিপভিত্তিক মজুরি বাতিল করে এই খাতের শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করতে হবে। এর সঙ্গে চুক্তিতে গাড়ি দেওয়া বন্ধ করতে হবে। তবে আশার কথা, ঢাকা পরিবহন মালিক সমিতি চুক্তিতে গাড়ি না দেওয়ার ব্যাপারে রাজি হয়েছে। শ্রম আইন অনুসারে তাঁদের সব সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে: অর্থাৎ আহার-বিশ্রামসহ দৈনিক আট ঘণ্টা কর্মদিবস বাস্তবায়ন করা, সপ্তাহে এক দিন ছুটি, বছরে ৫৩ দিনের মজুরিসহ ছুটি, চিকিৎসা ভাতা, ঈদ/পূজার বোনাস চালু প্রভৃতি। বড় বাস কোম্পানিগুলোর পক্ষে এসব সুবিধা দেওয়া খুব কঠিন কাজ নয়। ছোট কোম্পানিগুলোর জন্য তা কঠিন হবে। সে জন্য প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের প্রস্তাবিত ছয়টি বড় কোম্পানির অধীনে সব বাস কোম্পানিকে নিয়ে আসাই সবচেয়ে বাস্তব সমাধান।

তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো এসব সুবিধা নিশ্চিত করার পাশাপাশি পরিবহনশ্রমিকদেরও দায়িত্বশীল হতে হবে। সে জন্য তাঁদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণও দেওয়া যেতে পারে। আর কোনো চালক যদি ইচ্ছা করে কাউকে পিষে মারেন, তাঁর শাস্তি অবশ্যই মৃত্যুদণ্ড।

প্রতীক বর্ধন: সাংবাদিক।