সড়কে বিশৃঙ্খলা

স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের দেশ কাঁপানো আন্দোলনের পর সড়ক পরিবহন খাতে যে বড় ধরনের পরিবর্তন আসার কথা ছিল, তার বিন্দুমাত্র আলামত দেখা যাচ্ছে না। মন্ত্রিসভায় একটি বিল অনুমোদন এবং ‘পরিবহনমোগলদের’ যৎসামান্য আশ্বাস, ঘটা করে ট্রাফিক সপ্তাহ উদ্‌যাপনের মধ্যেই যেন নীতিনির্ধারকেরা দেশবাসীকে আশ্বস্ত করতে চাইছেন। বাস্তবে এসব ‘মুখরক্ষা’ করার চেষ্টা সড়ক পরিবহন খাতের বিশৃঙ্খলা কমাতে পারবে বলে মনে হয় না। পরিস্থিতি এতটাই নৈরাজ্যকর যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর গাড়িতেও বাস ধাক্কা দিচ্ছে।

সড়ক পরিবহনের দুই প্রধান সমস্যা হলো—যানবাহনের ফিটনেস না থাকা এবং বৈধ কাগজপত্র ছাড়া চালকদের গাড়ি চালানো। অবৈধ চালকই আছেন ৯ থেকে ১৭ লাখ, আর শুধু ঢাকাতেই স্বীকৃতমতে ফিটনেসবিহীন যানবাহনের সংখ্যা সোয়া দুই লাখের বেশি। এর ওপরে রয়েছে পরিবহনমালিকদের কথা ও কাজে গরমিল। সড়কে বেপরোয়া ও পাল্লা দিয়ে গাড়ি চালানো শুধু কতিপয় উচ্ছৃঙ্খল চালকের কাণ্ড নয়; এর নেপথ্যের বড় কারণ চালকদের কাছে চুক্তিতে বাস-মিনিবাস চালাতে দেওয়া। মালিক শুধু দেখেন চুক্তির টাকা উশুল হলো কি না। এরপর চালক-হেলপার কত কম সময়ে কত বেশি ট্রিপ দিয়ে কত টাকা আয় করে নিলেন, সেসব দেখার কেউ নেই। মূলত এই দ্বিমুখী বেআইনি কর্মকাণ্ডই সড়ক পরিবহনে নৈরাজ্য ও দুর্ঘটনার বড় কারণ।

মালিক, চালক, পুলিশ, বিআরটিএসহ সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় কারোরই কিছু অজানা ছিল না। কলেজছাত্র রাজীবের হাত কাটা পড়া এবং হাসপাতালে তাঁর করুণ মৃত্যু সারা দেশে আলোড়ন তুলেছিল। কিন্তু এরপরও পরিবহনমালিক কিংবা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কারোরই ঘুম ভাঙেনি। ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এখন দাবি করছেন যে চুক্তিতে বাস চালানোর ‘প্রমাণ’ পাওয়ার কারণে তাঁরা পাঁচটি কোম্পানিকে সমিতি থেকে বহিষ্কার করেছেন। এই পদক্ষেপ অনেকটাই লোক দেখানো। কারণ, আকস্মিকভাবে ‘প্রমাণ’ আবিষ্কারের কোনো ব্যাপার ছিল না। শুধু বর্তমান পরিস্থিতিটি সামলানোর গরজ থেকে মালিকেরা একটি পদক্ষেপ নিয়েছেন, যা কতটা ফলপ্রসূ হবে, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে।

সরকারের নীতিনির্ধারকদের দাবি, তাঁরা শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নিয়েছেন, ধীরে ধীরে তা বাস্তবায়ন করবেন। কিন্তু আইনের প্রয়োগ তো ধীরে ধীরে বাস্তবায়নের বিষয় নয়। সড়কের নিরাপত্তায় শিক্ষার্থীরা যেসব দাবি করেছে, সেটি আইনের বাইরে নয়। বিষয়টি মালিক-চালক, বিআরটিএ এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মর্জির ওপর ছেড়ে দিলে হবে না। যাঁরা দীর্ঘকাল ধরে অনিয়মকেই নিয়মে পরিণত করে ফেলেছেন, তাঁদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। অপ্রিয় হলেও বাস্তবতা এতটা রূঢ় যে, বড় ধরনের সংস্কার, নতুন বিনিয়োগ ও লোকবল বাড়ানো ছাড়া বিদ্যমান অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা রহিত করা যাবে না।

এটা সত্যি যে, সরকারের সড়কসংশ্লিষ্ট নীতি বাস্তবায়নের দায়িত্ব সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরেরই। সাত বছর আগে তিনি এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিলেও পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে। তিনি যেভাবে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের উদ্দেশে বক্তৃতা-বিবৃতিতে যতটা সময় ব্যয় করছেন, তার সিকিভাগও সড়কে করছেন না।

আশা করব, নিরাপদ সড়কের জন্য অনতিবিলম্বে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেওয়ার বিকল্প নেই। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ সাম্প্রতিক শিক্ষার্থী আন্দোলন থেকে কতটা কী ফায়দা নিতে চেয়েছিল, সেটা সড়ক ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন থেকে আলাদা করতে হবে। আইন কঠোর করার চেয়েও জরুরি হলো আইনের যথাযথ প্রয়োগ। বিশেষজ্ঞরা গণপরিবহনের বিশৃঙ্খলা রোধে ‘রুট ফ্র্যাঞ্চাইজ’ চালুর যে পরামর্শ দিচ্ছেন, তা বিআরটিএ পারবে না। সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়কেই নেতৃত্ব দিতে হবে।