নেতাজি, বঙ্গবন্ধু, ম্যান্ডেলা

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ,, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও নেলসন ম্যান্ডেলা
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ,, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও নেলসন ম্যান্ডেলা

বাংলাদেশের রাজনৈতিক মঞ্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আবির্ভাবের আগে বাঙালির সবচেয়ে প্রিয় নেতা ছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। তিনি স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলেন, দেখিয়েছিলেন। তিনি ব্রিটিশ ভারতের পরাধীন মানুষকে সে স্বপ্ন পূরণে রক্ত দিতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। নেতাজি তাঁর জীবদ্দশায় নিজ দেশকে স্বাধীন দেখে যেতে পারেননি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পেরেছিলেন।

বিশ শতকের অন্য আরেক নেতার সঙ্গেও বঙ্গবন্ধুর তুলনা চলে, তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা। তাঁরা দুজনেই জীবনের দীর্ঘ সময় কারান্তরালে কাটিয়েছেন, নিগ্রহের মুখোমুখি হয়ে একমুহূর্তের জন্যও আপসের কথা ভাবেননি। যে স্বপ্ন তাঁরা দেখেছিলেন—মুক্ত, স্বাধীন স্বদেশ—নিজের জীবদ্দশাতেই তার বাস্তবায়ন দেখে গেছেন।

অনুমান করি, বঙ্গবন্ধু তাঁর চেয়ে ২৩ বছরের বড় নেতাজি সুভাষ বসুকে কখনো মুখোমুখি দেখেননি। ১৯৪২ সালে যখন তিনি ইসলামিয়া কলেজে পড়তে কলকাতায় যান, তার এক বছর আগে নেতাজি আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতৃত্ব দিতে দেশ ত্যাগ করেছেন। তিরিশের দশকে নেতাজি যখন কলকাতার মেয়র ও কংগ্রেসের নেতা হিসেবে কলকাতায় রাজনৈতিকভাবে সক্রিয়, তখন বঙ্গবন্ধু নিতান্তই কিশোর।

ম্যান্ডেলার সঙ্গেও বঙ্গবন্ধুর কখনো মুখোমুখি দেখা হয়নি। তাঁরা দুজন সমবয়সী—ম্যান্ডেলার জন্ম ১৯১৮ সালে, বঙ্গবন্ধুর ১৯২০ সালে। সম্ভবত একে অপরের বিষয়ে সম্যক অবহিত ছিলেন, কিন্তু দুজনের পথ কখনো মিলিত হয়নি। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু ঘাতকের হাতে সপরিবার নিহত হওয়ার সময় ম্যান্ডেলা কারাগারে।

কেউ কারও মুখোমুখি হননি, অথচ এই তিন নেতা—নেতাজি সুভাষ বসু, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও নেলসন ম্যান্ডেলা—এক অদৃশ্য সুতোয় একে অপরের সঙ্গে বাঁধা। তাঁরা তিনজনই পরাধীন জাতির মুক্তির স্বপ্নদ্রষ্টা। শুধু নিজ নিজ দেশ বা জাতির নয়, পৃথিবীর যেখানেই নিপীড়িত মানুষ স্বাধীনতার জন্য লড়ছেন, এই তিন নেতা তাঁদের জন্য আশার প্রতীক। মুক্তি সহজে আসে না, তার জন্য চাই ব্যক্তিগত আত্মত্যাগ। তাঁরা তিনজনই নিজের উদাহরণে সে কথার প্রমাণ দিয়েছেন। এই আত্মত্যাগ অর্থহীন নয়, তাঁদের জীবন সে কথারও প্রমাণ।

আমার হাতে সম্প্রতি নতুন একটি বই এসেছে, নাম বঙ্গবন্ধু, এপিটম অব আ নেশন। এনায়েতুল্লাহ খান সম্পাদিত ও ‘কসমস বুকস’ থেকে প্রকাশিত বঙ্গবন্ধুর প্রতি নিবেদিত এই সচিত্র গ্রন্থে ১৯৫৭ সালে বঙ্গবন্ধুর নিজের হাতে লেখা এই রকম একটি আশ্চর্য কথা রয়েছে, ‘গ্রেট থিংস আর অ্যাচিভড থ্রু গ্রেট স্যাক্রিফাইসেস।’ অর্থাৎ বড় কিছু অর্জন করতে হলে চাই বড় ধরনের আত্মত্যাগ। ঠিক একই কথা বলেছিলেন ম্যান্ডেলা, জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর। তিনি বলেছিলেন, ‘অনলি থ্রু হার্ডশিপ, স্যাক্রিফাইস অ্যান্ড মিলিট্যান্ট অ্যাকশন ক্যান ফ্রিডম বি ওয়ান।’ শুধু কঠোর পরিশ্রম, আত্মত্যাগ ও লড়াকু কর্মকাণ্ডের ভেতর দিয়েই আসবে স্বাধীনতা। ম্যান্ডেলার এ কথা বলার প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে নেতাজি সুভাষ বসু বলেছিলেন, নিজের মুক্তির জন্য রক্ত দিতে প্রস্তুত হতে হবে। ‘আমাদের আত্মত্যাগের ভেতর দিয়ে যে মুক্তি আমরা অর্জন করব, নিজের শক্তিবলেই আমরা তা রক্ষায় সক্ষম হব।’

সুভাষ বসু ও নেলসন ম্যান্ডেলা, উভয়েই অবস্থাসম্পন্ন পরিবারের সন্তান ছিলেন। সুভাষের পিতা ছিলেন তাঁর সময়ের নামজাদা আইনজীবী। ম্যান্ডেলার পিতামহ ছিলেন তাঁর সম্প্রদায়ের রাজা। বড় কিছু অর্জনের জন্য অনুপ্রেরণা ও প্রস্তুতি তাঁরা পরিবার থেকেই পেয়েছিলেন। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু জন্মেছিলেন এক নিতান্ত মধ্যবিত্ত, আজকের বিচারে নিম্নবিত্ত পরিবারে, তাঁর পিতা ছিলেন সে সময়ের সামান্য এক সেরেস্তাদার। সরকারি কর্মচারী, সরকারের অনুগত থাকার শিক্ষাই তাঁর পাওয়ার কথা। অথচ বঙ্গবন্ধু আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করলেন সুভাষ বসুকে, যিনি সরকারি চাকরি তুচ্ছ করে ইংরেজকে দেশছাড়া করতে জীবন বাজি রেখেছিলেন।

রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর হাতেখড়ি হয় ১৬ বছর বয়সে, মাদারীপুরে পিতার কর্মস্থলে থাকার সময়। তিনি সে সময় সম্পূর্ণ কাকতালীয়ভাবে সুভাষ বসুর অনুপ্রেরণায় যুক্ত হন স্বদেশি আন্দোলনের সঙ্গে। বঙ্গবন্ধু অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইতে স্মরণ করেছেন, ইংরেজদের প্রতি বিরাগ থেকে তিনি সুভাষ বসুর ভক্ত হয়ে ওঠেন। পরে, কলকাতায় কলেজে পড়তে গিয়ে সুভাষ ও তাঁর আজাদ হিন্দ ফৌজের কথা গভীরভাবে জেনেছিলেন। তখনো তাঁর বিশ্বাস ছিল, সুভাষ বসু সঠিক কাজটিই করছেন। হিন্দু ও মুসলমান উভয়কে নিয়ে ভারতীয় মুক্তি বাহিনী গড়ে তুলেছেন, তিনি একজন প্রকৃত অসাম্প্রদায়িক পুরুষ। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘যে নেতা দেশ ত্যাগ করে দেশের স্বাধীনতার জন্য সর্বস্ব বিলিয়ে দিতে পারেন, তিনি কোনো দিন সাম্প্রদায়িক হতে পারেন না। মনে মনে তাই সুভাষ বাবুকে শ্রদ্ধা করতাম।’

সন্দেহ নেই, বঙ্গবন্ধু ত্যাগের মন্ত্র নেতাজির কাছ থেকে পেয়েছিলেন। কিন্তু রাজনীতিতে ব্যক্তিস্বার্থের চেয়ে আদর্শ অনেক বড়, এই চেতনা তিনি অর্জন করেছিলেন নিজের সংগ্রামের ভেতর দিয়ে। এদিক দিয়ে তাঁর সঙ্গে মিল রয়েছে ম্যান্ডেলার। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী সরকার ম্যান্ডেলাকে বারবার প্রস্তাব দিয়েছে, রাজনৈতিক বিরোধিতা ত্যাগ করো, তাহলে আগামীকালই তুমি মুক্তি পাবে। ম্যান্ডেলা রাজি হননি। ১৯৮৫ সালে, সে সময় তিনি পোলসমুর জেলে, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রধানমন্ত্রী বোথা আবার তাঁকে সে প্রস্তাব পাঠালেন। ম্যান্ডেলা জেল থেকে গোপনে পাঠানো এক চিঠিতে কন্যা জিঞ্জির মাধ্যমে সে প্রস্তাবের জবাব দিলেন—‘নিজের মুক্তি আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ আমার জনগণের মুক্তি। আমি আমার জন্ম-অধিকার বিক্রি করতে পারি না, যেমন বিক্রি করতে পারি না আমার মানুষের মুক্ত হওয়ার অধিকার। আমি জেলে আসার পর অসংখ্য মানুষ নিহত হয়েছেন। সেসব সন্তানহীন বাবা-মা, স্বামীহারা বধূ ও বাবাহারা সন্তানদের প্রতি আমার ঋণ ভুলে এই মুক্তি আমি চাই না।’

প্রকৃত মুক্তির জন্য ম্যান্ডেলাকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল আরও পাঁচ বছর। আপসের পথ অনুসরণ করলে বঙ্গবন্ধুকেও কারান্তরালে দিনের পর দিন কাটাতে হতো না, চাইলে তিনি অনায়াসে ক্ষমতার ভাগীদার হতে পারতেন। ১৯৫৩ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের আইনমন্ত্রী হিসেবে যোগ দেন। শেখ মুজিব তখন নবগঠিত আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সোহরাওয়ার্দী সে দলের প্রধান। মুজিব কারাগার থেকে নেতার মন্ত্রিত্বের খবর পেলেন, মোটেই খুশি হলেন না। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি স্মরণ করেছেন: ‘জেলের ভেতরে বসে আমরা খুবই কষ্ট পেলাম। আমি নিজে কিছুতেই তাঁর আইনমন্ত্রী হওয়া সমর্থন করতে পারলাম না। এমনকি মনে মনে ক্ষেপে গিয়েছিলাম। আমাকে অনুরোধ করেছিলেন শহীদ সাহেব, রোগমুক্ত হয়ে ফিরে এসেছেন দেশে, তাঁকে টেলিগ্রাম করতে। আমি বলে দিলাম, “না, কোন টেলিগ্রাম করব না, আমার প্রয়োজন নাই।”’

নেতাজি, বঙ্গবন্ধু অথবা ম্যান্ডেলা—কেউই এখন আর আমাদের মাঝে নেই। মুক্ত স্বদেশের যে স্বপ্ন তাঁদের ত্যাগে উদ্বুদ্ধ করেছিল, তা এখনো আমাদের পাথেয়। কীভাবে তাঁদের মনে রাখব, তার দায়ভার তাঁদের নয়, আমাদের। এ ব্যাপারে আমাদের পথ দেখাতে পারেন দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষ, যাঁরা ম্যান্ডেলার জন্মদিনকে নাগরিক সেবায় ব্যয় করে থাকেন। ম্যান্ডেলা জীবনের ২৭ বছর কারান্তরালে কাটিয়েছেন, সে কথার স্মরণে তাঁরা ১৮ জুলাই ম্যান্ডেলার জন্মদিনে অন্তত ২৭টি মিনিট কোনো সাধারণ কল্যাণের লক্ষ্যে সমবেত হন, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে শ্রমদান করেন। স্কুলঘর নির্মাণ, ভাঙা রাস্তা মেরামত, আবর্জনা পরিষ্কার, উদ্যান পরিচর্যা—এমন কিছু, যার ফলে সবার কম-বেশি কল্যাণ হয়, তাঁরা সেই কাজের সঙ্গে যুক্ত হন। পৃথিবীর অন্য অনেক দেশেও ম্যান্ডেলা দিবস এভাবে পালিত হয়ে থাকে।

বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনের ১২ বছর জেলে কাটিয়েছেন। আরও ১২ বছর কাটাতে হয়েছে পুলিশি নজরদারিতে। শুধু কথার তুবড়ি না ছুটিয়ে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ১৭ মার্চ, অথবা তাঁর মৃত্যুদিবস ১৫ আগস্ট, আমরাও কি ম্যান্ডেলা দিবসের মতো জনকল্যাণকর কিছু করতে পারি না? বঙ্গবন্ধুর জন্য কি আমাদের ২৪টি মিনিট দেওয়ার মতো অবসরও নেই?

হাসান ফেরদৌস, যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি