নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের নানা রূপ

গত ৩০ জুলাই তিনটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচন সম্পন্ন হলো। জাতীয় নির্বাচনের আগে এই সরকারের আমলে এটা শেষ নির্বাচন। এর আগে গত মে ও জুনে হয় খুলনা ও গাজীপুর সিটি নির্বাচন। এই পাঁচ সিটি নির্বাচনের অভিজ্ঞতা জাতীয় নির্বাচনে কাজে লাগাতে পারে সরকার, রাজনৈতিক মহলে এমন আলোচনা আছে। নির্বাচন কমিশনের জন্যও এটা ছিল ত্রুটি-বিচ্যুতি সংশোধন ও সফলতা-ব্যর্থতার একটা পরীক্ষা।

পাঁচ সিটি নির্বাচনে আমরা প্রথম আলোর বেশ কয়েকজন সংবাদকর্মী পেশাগত দায়িত্ব পালন করি। আমাদের যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তাতে বলা যায়, সব জায়গায় বিরোধী দলের প্রার্থী, তাঁর লোকজন, সাধারণ ভোটার এবং গণমাধ্যমকর্মীদের নানাভাবে চাপে রেখে একটা নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন করার প্রবণতা ছিল স্পষ্ট। এই প্রবণতা একেক সিটিতে একের রকম দেখা গেছে। খুলনা ও গাজীপুরের মতো সর্বশেষ অনুষ্ঠিত বরিশাল, রাজশাহী ও সিলেট সিটি নির্বাচনেও বুথ দখল করে জাল ভোট, প্রতিদ্বন্দ্বী মেয়র প্রার্থীর এজেন্ট বের করে দেওয়া, পুলিশের বাড়াবাড়ি বা পক্ষপাতমূলক ভূমিকা ছিল। তবে মাত্রা ও কৌশলে কিছুটা ভিন্নতা ছিল।

খুলনায় প্রথম দেখা যায় প্রতিপক্ষের নির্বাচনী এজেন্টদের কেন্দ্রে ঢুকতে না দেওয়া বা কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়ার ঘটনা। তার সঙ্গে ছিল ভোটের আগে এজেন্ট বা নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার ও বিরোধী দলের নেতা-কর্মীর বাড়ি বাড়ি তল্লাশি বা শাসিয়ে আসার ঘটনা। এটা পরে অন্য সব সিটিতেও দেখা গেছে।

খুলনার পর গাজীপুরের নির্বাচনে আরও অভিনব ঘটনা দেখা যায়। সেখানে বিরোধী দলের নির্বাচনী এজেন্টদের ভোটের আগের রাতে ও ভোরে বাসা থেকে এবং ভোটের দিন সকালে কেন্দ্র থেকে ডেকে নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সারা দিন আটকে রাখে। সন্ধ্যার পর তাঁদের ছোট ছোট দলে ভাগ করে গাড়িতে তুলে অন্য জেলায়; একেক দলকে একেক জায়গায় ছেড়ে দেয়। তাঁদের বাড়ি ফেরার আগ পর্যন্ত তাঁর দলের লোকেরাও টের পাননি কী ঘটেছে।

পরের তিন সিটি নির্বাচনেও এজেন্টদের গ্রেপ্তার, হয়রানি, ভয় দেখানোর ঘটনা ছিল। তবে রাজশাহী, বরিশাল ও সিলেটের নির্বাচনে নতুন অনুষঙ্গ যুক্ত হয় পুলিশের বাড়াবাড়ি রকম ভূমিকা। এই তিন সিটিতে সংবাদকর্মীদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে পুলিশের পক্ষ থেকে যেভাবে বাধা দেওয়া হয়েছে, এমনটা আগে দেখা যায়নি। আর এসব করা হয়েছে কেন্দ্র দখল বা জাল ভোটের ঘটনাকে নির্বিঘ্ন করতে।

নির্বাচন কমিশনের পর্যবেক্ষক পাস বা যথাযথ অনুমতি থাকা সত্ত্বেও অনেক ভোটকেন্দ্রে সংবাদকর্মীদের ঢুকতে বাধা দেয় পুলিশ। যেসব কেন্দ্রে এমন দেখা গেছে, পরে ওই সব কেন্দ্রে জাল ভোট, কারচুপিসহ নানা অভিযোগ পাওয়া গেছে। কোথাও কোথাও প্রিসাইডিং কর্মকর্তাও পুলিশের সঙ্গে সুর মিলিয়েছেন। সিলেটের এমসি কলেজ কেন্দ্র ও অগ্রগামী বালিকা উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে প্রথম আলোর প্রতিবেদক ও আলোকচিত্রীকে পুলিশ প্রথমে ঢুকতে বাধা দেয়। পরে নির্দেশনা দেয় কেন্দ্রে ছবি তোলা বা ভিডিও করা যাবে না। দুই কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তাই দাবি করেন, সংবাদকর্মীদের বিষয়ে এমন নিষেধাজ্ঞা আছে।

সিলেটে একটি কেন্দ্রে সরকারি দলের কর্মীরা ব্যালটে সিল মারার দৃশ্য মুঠোফোনে ভিডিও করার সময় প্রথম আলোর একজন সাংবাদিককে পুলিশ বেধড়ক লাঠিপেটা করে। সরকারি দলের কর্মীরা তাঁর মুঠোফোন কেড়ে নিয়ে ভিডিও মুছে ফেলেন। সংবাদকর্মীদের কাজে বাধা দিলেও ভোট কারচুপি, জাল ভোট বা কেন্দ্র দখলের ক্ষেত্রে পুলিশকে বাধা দিতে দেখা যায়নি; বরং অনেক ক্ষেত্রে সহযোগীর ভূমিকায় দেখা গেছে।

বিরোধী দলের মেয়র প্রার্থীর নির্বাচনী এজেন্ট বের করার ক্ষেত্রেও সিলেট ও রাজশাহীতে নতুন কৌশল দেখা গেছে। ভোট গ্রহণ শুরুর আগে অনেক কেন্দ্রে এজেন্ট ঢুকতে গেলে পুলিশ আটকে দেয়। কোথাও বলা হয়, এজেন্ট কার্ডে সই ঠিক নেই। এটা যে সঠিক, তা প্রমাণ করতে হবে। এরপর প্রার্থী বা তাঁর প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট গিয়ে নিশ্চিত করলে তখন বলা হয়, সকাল আটটার মধ্যে প্রবেশের সময়, এখন সময় পার হয়ে গেছে, ঢোকা যাবে না। কোথাও কোথাও কেন্দ্রে প্রবেশের সময় এজেন্টকে বলা হয়, মোবাইল ফোন সঙ্গে রাখা যাবে না। ফোন রেখে আসার পর বলা হয়, ভোট শুরু হয়ে গেছে, এখন ঢোকা যাবে না। সবগুলো সিটিতেই স্থানীয় সংবাদকর্মী ও রাজনৈতিক কর্মীরা বলেছেন, ভোটের দিন দায়িত্ব পালনের জন্য বাইরের জেলা থেকে যাওয়া পুলিশ মূলত বাড়াবাড়ি করেছে।

বিএনপির মেয়র প্রার্থীদের অভিযোগ, বাছাই করা কিছু পুলিশ ভোটের দিনের দায়িত্ব পালনের জন্য সরকার পাঠিয়েছে। যাঁরা সরকারি দলের প্রার্থীকে বিজয়ী করতে নানা কৌশল বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখেন। খুলনা ছাড়া বাকি চার সিটিতেই বিরোধী দলের মেয়র প্রার্থীদের অভিযোগ ছিল, ভোটের আগের রাতে কিছু কিছু কেন্দ্রে নৌকা প্রতীকের ব্যালটে সিল মেরে রাখা হয়।

রাজশাহীতে এই অভিযোগ বেশি ছিল। সেখানে বিএনপির প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক মিজানুর রহমান মিনু অভিযোগ করেন, ভোটের আগের রাতে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ ভোট বাক্সে ভরে দেওয়া হয়। যে কারণে মেয়রের ব্যালট কোনো কেন্দ্রে ১১টায়, কোথাও ১২টায়, আবার কোথাও ২টার মধ্যে শেষ হয়ে যায়। এর মধ্যে বরিশালে আগে থেকে মেয়র প্রার্থীর ব্যালট বইয়ে নৌকা প্রতীকে সিল মারার ঘটনা মেয়র প্রার্থী মনীষা চক্রবর্তী হাতেনাতে ধরেন। যার একটি ভিডিও চিত্র পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। বরিশালের ভোট জালিয়াতিতে তেমন রাখঢাক ছিল না।

বরিশাল ছাড়া বাকি সিটিগুলোর কিছু কেন্দ্রে ভালো ভোটের চিত্রও ছিল। এর মধ্যে সিলেটে এক-তৃতীয়াংশ কেন্দ্রের ভোট নিয়ে অভিযোগ থাকলেও বাকি কেন্দ্রগুলো নিয়ে বেশি অভিযোগ ছিল না। সব সিটিতেই অনেক কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ করা হয় ধীরগতিতে। এই সুযোগে জাল ভোট দেওয়া হয়-এমন অভিযোগ আছে। আবার কেন্দ্র দখলের ক্ষেত্রে একটানা দীর্ঘ সময় কোনো কেন্দ্র দখলে রাখা হয়নি। একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বুথ দখল করে সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভর্তি করা হয়। সেটা শেষ হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যাপক তৎপরতা শুরু করে শৃঙ্খলা ফেরাতে।

সব সিটিতেই কোনো না কোনো কেন্দ্রে দুপুরের আগে ব্যালট পেপার শেষ হয়ে গেছে, যদিও ভোটার ছিলেন লাইনে।

টিপু সুলতান: প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি