নিরামিষবাদ যখন রাজনৈতিক পণ্য

বিশ্বের অন্য সব অঞ্চলের মতো দক্ষিণ এশিয়াতেও বহু রাজনৈতিক মতবাদ সক্রিয়। এর মধ্যেই এল অভিনব আরেক তত্ত্ব, ‘নিরামিষবাদ’ (vegetarianism)। ভারতে আরএসএস-বিজেপি পরিবার থেকে এই মতবাদের প্রসার। বহুদিন থেকে তারা এ মতাদর্শের প্রচারক হলেও, ২০১৪ সালে বিজেপির বিজয় থেকে এর বিশেষ উত্থাপন।

নিরামিষ চর্চার কঠোর ধরন হিসেবে ‘ভেগানিজম’-এর কথা আমরা জানি, যা এমনকি মধু খেতেও নিষেধ করে। তবে তা ‘প্রাণ’ রক্ষাকারী ব্যতিক্রমী খাদ্যসংস্কৃতির অধিক মনোযোগ পায়নি। বিজেপির নিরামিষবাদ এসেছে রাজনৈতিক পণ্য আকারে। দলটি একে ‘গুজরাট মডেল’ও বলছে।

এত দিন গুজরাট মডেল বলতে মোদি শাসনের রাজনৈতিক অর্থনীতি বোঝানো হতো। বিজেপি এখন গুজরাট মডেলের সাংস্কৃতিক দিকটিকে নিরামিষবাদ আকারে হাজির করছে। ভারতীয় নিরামিষবাদের নতুন প্রতীক তাই মোদিজি। তিনি প্রায়ই বিদেশ সফরে তারকা রন্ধনবিদ সঞ্জীব কাপুরকে সঙ্গে নেন নিরামিষ রান্নার জন্য। প্রধানমন্ত্রী গণসংযোগ বিভাগের দায়িত্ব থাকে বিষয়টা যাতে প্রচারমাধ্যমে সংবাদ হয়ে ওঠে সেই ব্যবস্থা করা। বোধগম্য কারণেই সঞ্জীব কাপুর গত বছর ‘পদ্মশ্রী’ পেয়েছেন।

ধর্ম ও শারীরবিদ্যা এক কাতারে
রাজনৈতিক দর্শন হিসেবে নিরামিষবাদের মূলকথা মাংস ও ডিমের ওপর নিষেধাজ্ঞা। একে ‘পবিত্রতা’র আবরণ দিতেও ইচ্ছুক বিজেপি। খাদ্য ব্যক্তিগত রুচির বিষয় হলেও মোদির সহযোগীরা একে ভারতের রাষ্ট্রদর্শন আকারে দেখতে চান। বিজেপি এতে স্বাস্থ্যবিদ্যা যুক্ত করতেও বদ্ধপরিকর। তারা বলছে, ‘পবিত্র’ নিরামিষবাদ একই সঙ্গে স্বাস্থ্যের জন্যও অপরিহার্য। গোমূত্রকেও ফুড সাপ্লিমেন্ট আকারে হাজির করছে তারা। এভাবে ধর্ম ও শারীরবিদ্যাকে এক কাতারে শামিল করেই আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে মোদি নিজের মেয়াদ আরও পাঁচ বছর বাড়াতে চান।

নিরামিষবাদকে বিজেপি কীভাবে রাষ্ট্রচিন্তা আকারে হাজির করতে চায়, তার এক দৃষ্টান্ত হলো গত এপ্রিলে ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অভিনব এক টুইটে। সচিত্র ওই টুইট বার্তায় দুজন নারীর (একজন ভয়ানক মোটা, আরেকজন স্লিম) খাবার তালিকা দেওয়া হয়। মোটাজন খাচ্ছেন মাংস ও ডিম; স্লিম নারী খাচ্ছেন ফল ও সবজি। বিজ্ঞাপনের নাম ছিল ‘শাশ্বত ভারত’।

প্রোটিনহীনতাকে সুস্বাস্থ্যের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলা, শরীরী গঠনের জন্য কোটি কোটি নারীকে হেয় করা এবং বিশেষ কোনো খাবারকে ‘শাশ্বত ভারতবর্ষের খাদ্যরুচি’ আকারে হাজির করার কারণে সে সময় ব্যাপক বিতর্ক ওঠে। পরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় টুইটটি মুছে দেয়। তবে বিজেপি থামতে ইচ্ছুক নয়।

গত বছর এয়ার ইন্ডিয়া অভ্যন্তরীণ রুটের সব ফ্লাইটের ইকোনমি ক্লাসে আমিষ খাবার পরিবেশন পুরোই বন্ধ করে দেয়। মোদির গুজরাটের এয়ার রুটে প্রথম এটা শুরু। পরে কর্মসূচিটি জাতীয়করণ হয়। দেশে-বিদেশে ধর্মীয় উগ্রতার বিপক্ষে জনমত বাড়ায় বিজেপি তার রাজনীতিকে এভাবে দ্রুত নতুন মোড়কে হাজির করার চেষ্টা করছে। তারপরও বিজেপির নিরামিষবাদের আদল দাঁড়িয়েছে চরম কর্তৃত্ববাদী।

‘খাবারের রাজনীতি’ ভারতকে বিভক্ত করে ফেলেছে
শুরুতে গুজরাটসহ বিজেপি-প্রভাবিত অঞ্চলে নিরামিষবাদ মাংস ও ডিমের ওপর নিয়ন্ত্রণ দিয়ে শুরু হয়। এখন তা ঘরে ঘরে ঢুকছে নজরদারি করতে। ‘খাবারের রাজনীতি’ এভাবে ভারতকে দুই ভাগ করে ফেলেছে। এ কারণেই অতীতের ভেগানিজমের দর্শন থেকে তা একেবারেই আলাদা। একদিকে হিন্দু ও জৈনদের রেখে অন্যদিকে খ্রিষ্টান, মুসলমান, দলিত ও আদিবাসীদের দাঁড় করানো হয়েছে। শেষোক্তদের আমিষে পক্ষপাত, তাই তারা ‘ভারতবিরোধী’ বলে এখন বোঝানোর চেষ্টা চলছে।

এই দ্বিধাবিভক্তি, চিহ্নিতকরণ ও নিরামিষবাদিতা বিজেপির দিক থেকে সুপরিকল্পিত। বিজেপি-প্রভাবিত সংবাদমাধ্যম জোরেশোরে প্রচার করছে, যেসব স্থানে (পশ্চিম ও উত্তর ভারত) আমিষভোজী কম, সেখানে বিজেপি ভোটে ভালো করে। নিরামিষবাদ নিয়ে বিজেপি পরিবার এতই সিরিয়াস যে যেসব স্কুল বাচ্চাদের প্রোটিনের চাহিদা পূরণের জন্য দুপুরে খাবার দেয়, সেখানে এখন মেন্যু থেকে ডিম বাদ পড়েছে। বিজেপি-নিয়ন্ত্রিত মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ও ছত্তিশগড়ে এটা ঘটেছে। অপুষ্ট শিশুর সংখ্যায় এসব রাজ্য সর্বভারতীয় তালিকায় ওপরে চলে এসেছে এখন।

বছরজুড়ে হিন্দুধর্মীয় উৎসবের দিনগুলোতে আমিষের বেচাবিক্রিও অনেক রাজ্যে নিষিদ্ধ ঘোষণা হয়েছে। হরিয়ানা ও উত্তর প্রদেশে নবরাত্রি ও রাম-নবমীতে এ রকম ঘটেছে। আমিষ ‘ভারতীয়’ আবেগবিরুদ্ধ—এই মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করতেই এ রকম নিষেধাজ্ঞা। এ রকম চেষ্টার আরেকটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলো ‘গরু বিক্রেতা’ হিসেবে গুজব ছড়িয়ে বহু মানুষকে গণপিটুনিতে মেরে ফেলা।

নিরামিষবাদ ভারতজুড়ে খাবারভিত্তিক শ্রেণিবিন্যাসও শুরু করেছে। প্রচারের চেষ্টা চলছে যে নিরামিষভোজী মাত্রই সমাজে বিশেষ মর্যাদার সূচক। অথচ ৭০ ভাগ ভারতীয় আমিষভোজী।

দক্ষিণ দিল্লির স্থানীয় সরকার গত ডিসেম্বরে নির্দেশ জারি করে, আমিষ খাবার দোকানে প্রদর্শন করা যাবে না। এ নির্দেশের ব্যাখ্যায় বলা হয়, আমিষে নিরামিষভোজীদের আবেগের অমর্যাদা হয়। এ রকম সিদ্ধান্ত যে আমিষভোজীদের প্রতি ঘৃণাসূচক, সেই বিবেচনা অবশ্য নীতিনির্ধারকদের নেই। অথচ ভারতে আমিষভোজীরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। প্রায় সব সরকারি-বেসরকারি জরিপ বলছে, দেশটিতে ৭০ ভাগের বেশি মানুষ এখনো আমিষভোজী। তবে এ–ও লক্ষ করা গেছে, রাষ্ট্রীয় প্রচার বা ভীতি যে কারণেই হোক, নিরামিষভোজীর সংখ্যা বাড়ছে। বিজেপির ছাত্রসংগঠন ‘বিদ্যার্থী পরিষদ’ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হোস্টেলে যেকোনো মূল্যে নিরামিষবাদ কায়েম করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক নৃবিজ্ঞানী বলমুরলি নটরাজনের নেতৃত্বে একদল গবেষক এসব বিষয় নিয়ে বড় পরিসরে জরিপ চালিয়ে তার ফল প্রকাশ করেছেন এ বছর (ইপিডব্লিউ, মার্চ ২০১৮)। তাতে বিজেপির এই দাবি অসত্য প্রমাণিত হয়, ভারত একটি নিরামিষভোজী দেশ। ভারতের ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে এবং হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট সার্ভে অনুযায়ী, সেখানে নিরামিষভোজীর সংখ্যা জাতীয়ভাবে মাত্র ২০-৩০ শতাংশের মাঝামাঝি। খাবার জরিপে এ–ও শনাক্ত হয়, যেসব প্রদেশে নিম্নবর্গের রাজনৈতিক আন্দোলন দৃঢ় (অন্ধ্র, কেরালা, কর্ণাটক ও তামিলনাড়ু) সেখানে বেশি লোক গরুর মাংস খায় এবং জরিপকালে তারা সেটা প্রকাশ্যে জানায়।

মাংস, ডিম, সবজি ইত্যাদি নিয়ে এতসব গবেষণা-অনুসন্ধান-আলোচনা-বিতর্ক সাক্ষ্য দেয়, ভারতে খাবার আর ব্যক্তির পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার নেই, গভীর রাজনৈতিক ব্যঞ্জনা নিয়ে হাজির হয়েছে। এতে শ্রেণি উপাদানও যুক্ত হয়েছে। উচ্চবর্ণ ও উচ্চশ্রেণির মধ্যে নিরামিষ চিন্তার আধিক্য থাকলেও নিম্নবর্ণের মানুষ এ বিষয়ে নির্বিকার। ক্ষুধা সামলাতে তাদের একটা কিছু পেলেই হলো। নিরামিষভোজীদের মধ্যে ধনী ও উচ্চবর্ণের সংখ্যা অনেক। তাদের মধ্যে নিরামিষ সম্পর্কে ‘বিশুদ্ধতা’র ধারণা কাজ করে। নিম্নবর্গ মনে করে, খাবার তালিকায় আমিষ-নিরামিষ যা–ই থাকুক সে বরাবর ‘অপবিত্র’ ও ‘অচ্ছুত’ই থাকছে। খাদ্যরাজনীতি এভাবে নতুন এক শ্রেণি-রাজনীতির আদল নিয়েছে।

বলমুরলি নটরাজনদের গবেষণায় এ–ও জানা যায়, শুমারিগুলোতে ভয়ে মানুষ আমিষ খাওয়ার কথা জানায় না। আদিবাসী, দলিত ও মুসলমানরা খাবার পছন্দের কথা গোপন করছে। ফলে সরকারি তথ্য-উপাত্তের সঙ্গে বাস্তব খাদ্যসংস্কৃতির মিল নেই। নটরাজনেরা সার্ভেতে হিন্দু সম্প্রদায়ের মাঝেও অন্তত ৬৫ শতাংশ আমিষভোজীর সন্ধান পেয়েছেন। নিরামিষভোজী সংখ্যাগরিষ্ঠ পাওয়া গেছে কেবল জৈনদের মাঝে। উত্তর-পূর্ব ভারতের ছয়টি রাজ্যে নিরামিষভোজীর সংখ্যা ২ শতাংশের কম। তেলেঙ্গানায় মাত্র ১ শতাংশ। আসাম, পশ্চিমবঙ্গ, কেরালায় ৫ শতাংশের কম। তবে হরিয়ানা, রাজস্থান ও পাঞ্জাবে অনেক বেশি। রাজস্থানে প্রায় ৭৫ শতাংশ। খাদ্যরাজনীতির দৃষ্টিতে এভাবে ভারতকে নতুনভাবে বিভক্ত দেখা যাচ্ছে। বিজেপি এই বিভক্তি উসকে দিয়ে ভোটবাক্স ভরতে ইচ্ছুক।

বিজেপিবিরোধী শিবির বেকায়দায়
সংগত কারণেই মোদি ও বিজেপির নিরামিষবাদকে বিরোধীরা বলছে ‘ফুড হেজিমনি’। এই হেজিমনিতে ধর্ম ও রাজনীতি লেপটে আছে; সে কারণে ভোটের মৌসুমে বিজেপিবিরোধী শিবির কিছুটা বেকায়দায় রয়েছে। কংগ্রেসকে এ বিষয়ে বিব্রত করতেই হয়তো ভারতীয় রেলওয়ে প্রস্তাব দিয়েছে, এ বছর ও পরের দুই বছর ২ অক্টোবর গান্ধীর জন্মদিনে রেলযাত্রীদের নিরামিষ খাবার পরিবেশন করতে চায় তারা। তারা হয়তো ভবিষ্যতে এটাকে বছরের অন্য দিনের জন্যও প্রযোজ্য করে তুলতে চাইবে। অঙ্গসংগঠনগুলো দিয়ে আরএসএস সে রকম দাবি তোলাচ্ছে।
এসব তৎপরতায় স্পষ্ট, বিজেপি হিন্দুত্বের রাজনীতিকে খাবারের রাজনীতিতে রূপান্তরের কৌশল নিয়েছে। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে তার প্রতিপক্ষের পরিসরও অনেক বেড়ে গেছে। এত দিন মুসলমান ও খ্রিষ্টানরা প্রধান প্রতিপক্ষ থাকলেও নিরামিষবাদ কোণঠাসা করেছে দলিতদেরও। শেষোক্তরা মনে করছে নিরামিষের রাজনীতি বর্ণ ঐতিহ্যেরই নবায়িত এক রূপ।
আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক