দুর্বল মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও বিপর্যস্ত গণতন্ত্র

কয়েক মাস আগে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত সম্পর্কে একটি আলোচনার আয়োজন করেছিলেন অধ্যাপক আলী রীয়াজ। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার বিশিষ্ট ব্যক্তিরা তাতে অংশগ্রহণ করেন।  আলোচকদের মূল বক্তব্য ছিল, আর্থসামাজিক উন্নতির সঙ্গে বাংলাদেশে একটি বড় মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠেছে। কথাটি আক্ষরিক অর্থে ভুল নয়। কিন্তু আমি ওই সভায় ভিন্নমত প্রকাশ করে বলেছিলাম, মধ্যবিত্ত শ্রেণি আর মধ্যম আয়ের মানুষের সমাজ এক জিনিস নয়। দুই শ্রেণিকে এক করে দেখা যায় না। বাংলাদেশে মধ্যম আয়ের মানুষের সংখ্যা গত চার দশকে নিঃসন্দেহে বেড়েছে।

একজন প্রায় অশিক্ষিত মানুষ ঝোলা গুড়ের ব্যবসা করে অথবা ইয়াবা বেচাকেনা করে বেশ টাকা করলেন। পাকা বাড়ি বানালেন। দামি সোফা ও আসবাব দিয়ে ঘর সাজালেন। বসার ঘরের শোকেসে বেশ কিছু বইও সাজিয়ে রাখলেন। ঘরগুলোর আগা–মাথায় বিদেশি দামি টাইলস লাগালেন। বাথরুমে মূল্যবান কমোড। হাঁকান নতুন মডেলের গাড়ি। চিকিৎসা করতে যান ব্যাংকক বা সিঙ্গাপুর। তঁাকে আমি মধ্যবিত্ত বলতে নারাজ। তিনি একজন অবস্থাপন্ন মানুষ। অন্যদিকে একজন মধ্যবিত্ত এমনও হতে পারেন, যিনি দিন এনে দিন খান। তঁার ভালো জামাকাপড় পর্যন্ত নেই। কিন্তু চৌকিতে তাঁর মলিন বিছানার বালিশের নিচে থাকে রাহুল সাংকৃত্যায়নের ভোলগা থেকে গঙ্গা কিংবা দামোদর ধর্মানন্দ কোশাম্বির প্রাচীন ভারতবর্ষের সংস্কৃতি ও সভ্যতা–সংক্রান্ত বইপত্র। তিনি সমকালীন লেখকদের বইপত্র পাঠ করেন, পত্রপত্রিকা পড়েন এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তা করেন। পথের পাশের সস্তা চায়ের দোকানে বসে অন্যের সঙ্গে মতবিনিময় করেন।

মার্ক্সীয় দর্শনের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি খুব শক্ত। সমাজে মানুষের শ্রেণিগত অবস্থানকে মার্ক্সীয় দর্শন বিশেষ গুরুত্ব দেয়। প্রত্যেক ব্যক্তির সমাজে একটি অর্থনৈতিক অবস্থান রয়েছে। সমাজে অর্থনৈতিক অবস্থানের কারণে তার মর্যাদা যে নির্ণীত হয়, তা–ই নয়, তার চিন্তা–চেতনা এবং সংস্কৃতিও ভিন্ন রূপ নেয়। শ্রেণিগত অবস্থানের কারণে রাজনীতিতেও তার ভূমিকা স্বতন্ত্র।

আধুনিক রাষ্ট্রের যখন থেকে উদ্ভব ঘটেছে, তখন থেকেই সমাজ দুটি প্রধান ভাগে বিভক্ত। একটি মালিকশ্রেণি, অন্যটি দৈহিক শ্রম বিক্রয়কারী শ্রমিকশ্রেণি। মালিকের রয়েছে সম্পদ ও পঁুজি। শ্রমিকের কিছুই নেই, বিক্রয় করার মতো আছে শুধু তার শরীরের শ্রম। সমাজ ও রাষ্ট্রের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে আরও একটি শ্রেণির উদ্ভব হয়েছে। উৎপাদনের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। তাদের বিত্ত খুব সামান্য। তারা কলকারখানা ও জমির মালিক নয়। তারা শিল্প-কারখানার শ্রমিকও নয়। কিন্তু তাদের ছাড়া রাষ্ট্র ও সমাজ, সভ্যতা ও সংস্কৃতি এগোতে পারে না। এই শ্রেণিটিই হলো মধ্যবিত্ত শ্রেণি। ইংরেজিতে তাদের বলে মিডল ক্লাস।

রাষ্ট্রীয় ও সমাজজীবনের সব ক্ষেত্রে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণির উপস্থিতি। প্রশাসনে তারা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তারা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তারা। তারা কমবেশি শিক্ষিত মানুষ। তারা সংগীতচর্চা করে, সাহিত্যচর্চা করে, শিক্ষকতা করে, দোকানদারির মতো ছোটখাটো ব্যবসাও করে। সে রকম কোনো উৎপাদনের মধ্যে তারা নেই। কিন্তু আধুনিক গণতান্ত্রিক রাজনীতির সূচনা তাদের দ্বারাই।

আজকের বাংলাদেশের গণতন্ত্রের শোচনীয় অবস্থার জন্য দায়ী সুবিধাবাদী মধ্যম আয়ের মানুষ। তারা জাতির অতীত জানে না। বর্তমান বলতে বোঝে শুধু নিজেকে। দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। আজ বাংলাদেশে নষ্ট মধ্য শ্রেণিতে এমন মানুষও আছে, যাকে নিকারাগুয়া বা এল সালভাদরের কেউ এসে যদি বলে, আপনি আমাকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও রমনা পার্ক ৯৯ বছরের ইজারার ব্যবস্থা করে দেন, আমি আপনাকে এক কোটি টাকা দেব। তিনি সানন্দে সম্মত হবেন। মুৎসুদ্দি মধ্য শ্রেণির কাছে দেশ বড় নয়।

শ্রমিকশ্রেণি তাদের বেতন-ভাতা ইত্যাদি নিয়ে দাবি-দাওয়ায় ঐক্যবদ্ধ হয়। তাদের থাকে শ্রমিক ইউনিয়ন। মালিক তার স্বার্থ রক্ষায় গঠন করে বণিকসভা। বিভিন্ন চেম্বার। মধ্যবিত্তের সে রকম কিছু নেই, যেমন কোনো ঐক্যবদ্ধ সংঘ। সে জন্য তাদের মধ্যে শ্রেণিস্বার্থগত ঐক্য বা সংহতি নেই। তবে কখনো তারা কোনো ইস্যুতে সংঘবদ্ধ হয়। যেমন একালের সিভিল সোসাইটি।

মধ্যবিত্তের কোনো অভিন্ন চরিত্র নেই। বিত্তবানশ্রেণির অনেকে ধন-সম্পদ হারিয়ে মধ্যবিত্তে পরিণত হয়। শ্রমিকশ্রেণি থেকে বিদ্যা অর্জন করে অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে একজন মধ্যবিত্ত হতে পারে।

শ্রমিকশ্রেণির হারাবার কিছু নেই বলে সে ইতিবাচক পরিবর্তনের আশায় বিপ্লবের পক্ষে জীবন দিতে পারে। মালিক তার কারখানা ও সম্পদ রক্ষায় বিপ্লবের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়। মধ্যবিত্তের অবস্থান তাদের বাইরে। তার সম্পদ তার বিদ্যা, বুদ্ধি, চাতুর্য, চাটুকারিতা প্রভৃতি। সেটা হারাবার বা রক্ষার বিষয় নয়। তাই তার বিপ্লবী ভূমিকা নেই। শান্তিপূর্ণ গণতন্ত্রই তার পছন্দ। মধ্যবিত্ত শিকড়বিহীন বৃক্ষের মতো। যার থেকে সে বেশি সুবিধা পাবে, সে তারই পক্ষে থাকবে ও পায়রবি করবে। তারই গুণ সে গাইবে। ধনিকশ্রেণির তাদের বন্ধুত্বের প্রয়োজন নেই। শ্রমিকদেরও সে বন্ধু নয়। মালিকশ্রেণি ও শ্রমিকশ্রেণির একটি বৈশিষ্ট্য হলো, তারা ঐক্যবদ্ধ হতে জানে।

মধ্য শ্রেণির বৈশিষ্ট্য হলো, যেদিকে বেশি শক্তি দেখে সেদিকে থাকার চেষ্টা করে। যদি দেখে শ্রমিক-কৃষক–জনতা বৈপ্লবিক পথে আছে, সে তখন সেদিকে থাকে। যদি দেখে প্রতিবিপ্লব হচ্ছে প্রতিক্রিয়াশীল নেতৃত্বে, সে সেদিকে থাকে। তাই বাঙালি মধ্যবিত্ত একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে ছিল, পঁচাত্তরে সামরিক শাসকদের সঙ্গেও ছিল।

খুবই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ১৯৭১। বাংলাদেশের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। যখন শ্রমিক-জনতা স্বাধীনতার জন্য পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে, তখন মধ্যবিত্তের একটি বড় অংশ তাতে শামিল হয়। কারণ, মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন দেওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না। টিক্কা-ফরমান এত হিংস্র রকমের শক্তিশালী ছিল যে তাঁদের কাছে যাওয়া তখন মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। মার খেলে নির্যাতিতের কাতারেই থাকতে হয়—ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক।

ষাটের দশকে একটি ছোট আকারের মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠেছিল বাংলাদেশে। তারা ছিল জাতীয়তাবাদী। তারা চেয়েছে গণতন্ত্র। তাদের কারণেই স্বাধীনতা ত্বরান্বিত হয়। আজ বাংলাদেশের বিপর্যস্ত গণতন্ত্রের জন্য দায়ী শুধু রাজনীতিকেরা নন, বাংলাদেশের দুর্বল মধ্যবিত্ত শ্রেণি এবং নষ্ট মধ্যম আয়ের সুবিধাবাদী গোত্র।

সৈয়দ আবুল মকসুদ : লেখক ও গবেষক