দুষ্কর্মের সহযোগী যুক্তরাজ্য

ছোট শিশুরা পিকনিক শেষে বাসে করে বাড়ি ফিরছিল। কোনো সন্দেহ নেই যে তারা এ সময় খুব মজা করছিল, হাসতে হাসতে একে অপরের গায়ে গড়িয়ে পড়ছিল। হঠাৎ বিমান থেকে ফেলা এক বোমায় তারা স্তব্ধ হয়ে যায়। আগুনে পুড়ে তারা মারা যায়। গত বৃহস্পতিবার ইয়েমেনের সাদা প্রদেশের দাহিয়ান এলাকায় এ নির্মম হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছে। সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট এই বিমান হামলা চালায়। এতে বাসে থাকা ৪৩ জনের মৃত্যু হয়েছে, যার মধ্যে ২৯ জনই ছিল শিশু। দুঃখজনকভাবে এসব হামলায় সমর্থন আছে যুক্তরাজ্যের। নৈতিক সমর্থন তো রয়েছেই, পাশাপাশি তারা অস্ত্র দিয়ে এসব দুষ্কর্মে সহযোগিতা করছে। যুক্তরাজ্য যে শুধু সৌদি আরবের এসব হামলাকে সমর্থন করছে তা-ই নয়, ইসরায়েলিরা যে ফিলিস্তিনের বেসামরিক লোকজনকে হত্যা করছে, তার প্রতিও সমর্থন রয়েছে।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক বেসরকারি সংগঠন ক্যাম্পেইন অ্যাগেইনস্ট আর্মস ট্রেডের তথ্য অনুযায়ী, আমাদের সরকার ইয়েমেনে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে সৌদি আরবকে ৪ হাজার ৭০০ কোটি ডলার মূল্যের অস্ত্র সরবরাহ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে বিমান, হেলিকপ্টার, ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র ও বোমা। সম্ভবত এসব বোমার একটি ওই শিশুদের বাসে ফেলা হয়েছে।

মাত্র কয়েক মাস আগে ব্রিটিশ সরকার সৌদি একনায়ক মোহাম্মদ বিন সালমানকে ব্যাপক সম্মান দেখায়। শুধু তা-ই নয়, ১০ কোটি ডলারের একটি যৌথ সাহায্য চুক্তি করে বৈধতা দিয়েছে এই একনায়কের শাসনকে। একই সময় যুক্তরাজ্যভিত্তিক বহুজাতিক প্রতিরক্ষা প্রতিষ্ঠান বিএই সিস্টেমস ঘোষণা দেয় যে তারা সৌদি আরবের কাছে ৪৮টি টাইফুন জেট বিক্রি করেছে। এটা খুবই দুঃখজনক যে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা ইয়েমেনের যুদ্ধে সৌদি আরবকে সরাসরি সহায়তা করছে।

ইয়েমেনের যুদ্ধে এ পর্যন্ত হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। এদের বেশির ভাগই মারা গেছে সৌদির নেতৃত্বাধীন বাহিনীর হামলায়, যাদের আমরা অস্ত্র সরবরাহ করছি। এই যুদ্ধে ইতিমধ্যে লাখ লাখ মানুষ গৃহহীন হয়েছে এবং দেশটি দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে। কিন্তু এ নিয়ে যুক্তরাজ্যের কোথাও কোনো ক্ষোভ নেই কেন? কেন গণমাধ্যমগুলো এ ব্যাপারে নিশ্চুপ রয়েছে? আমাদের নামে যে নির্মম ঘটনাগুলো ঘটছে, কেন সেসব গণমাধ্যমে আসছে না?

ব্রিটিশ সরকারকে জবাবদিহি করাতে গণমাধ্যমগুলো ব্যর্থ হয়েছে। এটা ক্ষমার অযোগ্য। তাদের এই ব্যর্থতার কারণে এ দেশের বেশির ভাগ মানুষই জানে না যে এ রকম কোনো যুদ্ধ হচ্ছে। এটা যদি সৌদি আরব না হয়ে পশ্চিমাদের কোনো শত্রুদেশ হতো; যেমন ইরান—তাহলে বহু আগেই এই হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করার জন্য মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক বাহিনীকে হস্তক্ষেপ করার জন্য ডাকা হতো। কিন্তু সৌদি আরব তো আমাদের বন্ধু এবং সহযোগী, তাই আমরা চুপ করে আছি। সৌদির একনায়ক চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদকে রপ্তানি করছে, আর হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে।

ইসরায়েলিরা যে নিরীহ ফিলিস্তিনিদের হত্যা করছে, সেখানেও ব্রিটিশ সরকারের সরাসরি সম্পৃক্ততা রয়েছে। ইসরায়েলের কাছে যুক্তরাজ্য সমানে অস্ত্র বিক্রি করে যাচ্ছে। গাজায় গত সপ্তাহে ইসরায়েলি বিমান হামলায় ফিলিস্তিনের এক বেসামরিক অন্তঃসত্ত্বা নারী ও তাঁর দেড় বছর বয়সী কন্যাশিশু মারা যায়। এই হামলাকে হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে দ্বন্দ্বের ফল হিসেবে দেখানো হয়। কিন্তু আমি বলতে চাই, প্রতিটি মৃত্যু—কি ফিলিস্তিনির, কি ইসরায়েলির—খুবই শোকের। বেসামরিক লোকজনের ওপর প্রতিটি হামলা সেটা হামাস চালাক বা ইসরায়েল চালাক, কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।

মানবাধিকার সংগঠন বি সেলেমের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ১৮ বছরে যুক্তরাজ্যের সহযোগিতায় ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর হামলায় ৯ হাজার ৪৫৬ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। অন্যদিকে ফিলিস্তিনিদের হাতে ১ হাজার ২৩৭ জন সামরিক ও বেসামরিক ইসরায়েলি নিহত হয়েছে। অন্য এক হিসাবে দেখা গেছে, একই সময়ে নিহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা ৯ হাজার ৭৩০ জনের বেশি। এতে বোঝা যায়, ইসরায়েলই একতরফা হামলা চালাচ্ছে।

সৌদি আরব ও ইসরায়েল উভয়ই মনে করছে যে তারা যেকোনো কারণে নিরীহ লোকজনকে, এমনকি শিশুদেরও যখন-তখন হত্যা করতে পারে। তারা পশ্চিমাদের কাছ থেকে সামরিক ও কূটনৈতিক সমর্থন পাওয়াকে উপভোগ করছে। মাঝেমধ্যে তারা অবশ্য দুঃখ প্রকাশ করে, কিন্তু খুব দ্রুতই সেটা তারা ভুলে যায়। কিন্তু যত দিন যুক্তরাজ্য আর তার মিত্ররা দুষ্কর্মে সহযোগিতা করবে এবং যত দিন আমাদের গণমাধ্যমগুলো জনগণকে জানাতে ব্যর্থ হবে যে তাদের নামে আসলে কী ঘটছে—তত দিন এ ধরনের ভয়াবহ ঘটনা ঘটতেই থাকবে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত। দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া

ওয়েন জোনস দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার একজন কলামিস্ট