বার্তাকক্ষে বেঁচে থাকবেন গোলাম সারওয়ার

গোলাম সারওয়ার
গোলাম সারওয়ার

স্বনামধন্য মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক গোলাম সারওয়ার ঘুমিয়ে গেছেন। আর জাগবেন না। কিন্তু তিনি তাঁর বর্ণাঢ্য কর্মমুখর জীবনে যেসব কাজের উদাহরণ তৈরি করে গেছেন, তা তাঁকে স্মরণীয় করে রাখবে। যুগান্তর ও সমকাল–এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন তিনি। কিন্তু নিজেকে চূড়ান্ত বিচারে বার্তা সম্পাদকই ভাবতেন। যেন ‘মোর নাম এই’ বলে খ্যাত হোক। তিনি ইত্তেফাক–এ ২৭ বছর বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন গদ্যশিল্পী। আমরাও হুমায়ূন আহমেদের মূল্যায়নের সঙ্গে একমত। ২০০৩ সালে চিঠিটি যুগান্তর–এ এলে আমি তাঁকে পড়ে শোনাই। হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন, ‘আপনার গদ্য তো সাংবাদিকতার গদ্য না, সহজ নির্ভার আনন্দময় গদ্য, এই খবরটা কি আপনাকে কেউ দিয়েছে?’

তাঁর অগোচরে তাঁরই লেখাগুলোর সংকলন করেছিলাম। ষাটের দশকে পূর্বাণীর লেখা থেকে পরের তিন দশকের লেখা জমিয়ে দুটি বই বের হলো। সারওয়ার ভাই লিখলেন, আমি তাঁকে ‘জবরদস্তি’ বই লেখক বানিয়েছি। মৃত্যুর আগে অবশ্য তিনি একটি স্মৃতিকথা লেখার আগ্রহ ব্যক্ত করেছিলেন। যুগান্তর ও সমকাল–এ তাঁর সহকর্মী ছিলাম। সবকিছু ছাপিয়ে দেখেছি একজন সংবাদ অন্তপ্রাণ, সংবাদই ছিল তাঁর ধ্যানজ্ঞান। তাঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি। খবরের পরিবেশনায় তাঁর নৈপুণ্য জাদুকরি, ইত্তেফাক–এর হিরণ্ময় পর্বে তাঁর উদ্যোগে প্রকাশ করা টেলিগ্রামগুলো উদ্ভাবনী সাংবাদিকতার নজির হয়ে থাকবে। তিনি বলতেন, প্রতিবেদনে প্রতিবেদকের ঘামের গন্ধ থাকতে হবে। যুগান্তর–এ তিনি আমাকে কলাম লেখার অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন।

সিনেমা-নাটক থেকে সংগীত, রাজনীতি থেকে আদালত, বিদেশনীতি থেকে ক্রীড়া—সবকিছুতেই তাঁর পদচারণ ছিল। প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা ছিল তাঁর সাংবাদিকতার জগৎ। প্রধান প্রধান খবরের সূচনা লেখা ছিল তাঁর এক নম্বরের নেশা। এরপর তাঁর একটা জুতসই শিরোনাম দেওয়া এবং অঙ্গসজ্জায় তাকে ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অসামান্য। ইত্তেফাক, যুগান্তর ও সমকাল–এর, বিশেষ করে প্রথম পৃষ্ঠার কত শত রিপোর্টের প্রথম ভাগ যে তাঁরই লেখা, তার সাক্ষী দেবে বার্তাকক্ষের চেয়ার-টেবিল।

চলচ্চিত্র ও খেলাধুলাকে মূলধারার সাংবাদিকতায় নিয়ে আসার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা ছিল অসামান্য। বিশ্বকাপ ফুটবলের খবর দিয়ে পাঠকদের মাত করার ধারা শুরুর অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন তিনি। নব্বইয়ে ইতালির বিশ্বকাপে মতিউর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে ম্যারাডোনার সাক্ষাৎপর্বের খবর ইত্তেফাক–এ তিনি প্রথম পৃষ্ঠায় ছেপেছিলেন। ১৯৯৮ সালের ২৪ অক্টোবর ইত্তেফাক–এ তিনি লিখলেন, ‘সব ভুলতে পারি কিন্তু ক্রিকেট নয়।’ আমাদের চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় নায়িকা ববিতা, শাবানা ও কবরীকে তিনি তাঁর লেখালেখির উপজীব্য করেছিলেন।

গত ১ এপ্রিল তাঁর ৭৫তম জন্মবার্ষিকীতে কবরী শুভেচ্ছা জানাতে এসে তাঁর বিখ্যাত হাসি ছড়িয়ে টিপ্পনী কাটেন। বলেন, শাবানার প্রতি সারওয়ার ভাইয়ের পক্ষপাত তিনি ভুলতে পারেন না! সারওয়ার ভাই তা খণ্ডন করে বলেছিলেন, কবরী জানেন এই অভিযোগ সঠিক নয়। চার দশক আগে তিনি পূর্বাণীতে সারেং বউ ছবি প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, ‘কবরী যেন কবরী নন, এ যেন শহীদুল্লা কায়সারের মানসকন্যা, বিরহিণী, দুঃখিনী, স্বামী সোহাগে গরবিনী নবিতুন স্বয়ং।’ শাবানা জননী ছবির পার্শ্বচরিত্রে অভিনয়ের জন্য পুরস্কার পেয়েছেন। সেটা সারওয়ার ভাইয়ের মনঃপূত হয়নি। শাবানার অম্লমধুর সমালোচনা, ‘এ পুরস্কারপ্রাপ্তির অগৌরব জানি না শাবানাকে কতখানি সংকুচিত করেছে। সমস্ত অগৌরব ম্লান করে দিয়ে শাবানা প্রমাণ করুন, অভিনয়নৈপুণ্যেই প্রশংসার উজ্জ্বল মুহূর্ত সৃষ্টি করতে আপনি সক্ষম। সেই অনাগত উজ্জ্বল মুহূর্তের জন্য আপনার পুরস্কারপ্রাপ্তির অভিনন্দন জমা থাকল।’ (পূর্বাণী, ১৩৮৫)

সংবাদপত্রের পাতায় কেবল রাজনৈতিক দুর্যোগের ঘনঘটা। ক্রিকেটে ১৯৯৬ সালে এক বড় জয় এল। জনতা জনার্দনকে তিনি উদ্বেলিত করছেন: ‘অশ্রুসজল ভৈরবীর’ সুর ইথারে মিলাইয়া গেল—বাতাসে ছড়াইয়া গেল আনন্দের লহরী। যেন নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ হইল।’ লেখায় কাব্য ব্যঞ্জনা দেওয়ার দিকে তাঁর ঝোঁক স্বাভাবিক। ‘জনগণের হৃদয়ের রানি’ ডায়ানা–বন্দনায় তিনি রবীন্দ্রনাথের শরণ নেন, ‘নহ মাতা, নহ কন্যা, নহ বধূ সুন্দরী রূপসী হে নন্দন বাসিনী উর্বশী।’

১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন নিয়ে গোটা দেশ অগ্নিগর্ভ। তিনি লিখলেন, ‘নানা বাহারী পুষ্পের চমৎকৃত সুগন্ধ হৃদয়-মন ভরানোর এই মায়াময় ঋতুর অপেক্ষায় যাহারা অধীর, তাহাদের চোখে বসন্তের আবেশে নয়, কাঁদানে গ্যাসের ঝাঁজের দুঃসহ যন্ত্রণা।’ (ইত্তেফাক, ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬)। ২০০০ সালের ১ ফেব্রুয়ারিতে যুগান্তর–এ তিনি লিখেছিলেন, ‘বিরোধী দলশূন্য সংসদ এখন সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা পূরণের করুণ প্রতীকে পরিণত হইয়াছে।’ ১৯৯৬ সালের ২৬ মার্চ লিখেছেন, ‘সামনে সম্ভবত অপেক্ষা করছে আরও সংঘাত আরও সংকট।’ কবি শামসুর রাহমান থেকে তাঁর উদ্ধৃতি, ‘প্রবল ঝাঁকুনি লাগে মানবিকতার দৃঢ় ভিতে/ শ্রেয়বোধ লুপ্তপ্রায়, সহিংসতা নাচে দিন রাতে।’ ভেজাল সোনা নিয়ে তাঁর বচন, ‘গৌরী প্রসন্ন মজুমদার (সোনার হাতে সোনার কাঁকন গানখ্যাত) এখন বেঁচে থাকলে প্রিয়তমার সুন্দর হাতটাই অলংকার মনে করতেন, হাতের সোনার কাঁকনকে নয়।’ পরিবেশদূষণ নিয়ে তাঁর বঙ্কিম কটাক্ষ, ‘যে কোকিলটি পথ ভুলে রমনা পার্কের বনেদি গাছের শাখায় বসে প্রাণ উজাড় করে গেয়ে উঠল কুহু, কুহু—ও তো জানে না খানিকটা বিষ ওর গলাতেও জড়িয়ে গেছে!’

এর আগে মৃত্যুকে তিনি বারবার রুখে দিয়েছেন। গলব্লাডার, অ্যাপেনডিক্স ও হার্নিয়া অস্ত্রোপচারের মধ্য দিয়ে তাঁকে যেতে হয়েছে। ১৯৯৪ সালে ক্যানসারে আক্রান্ত হন। কলকাতার উডল্যান্ডস হাসপাতাল নাকি বলেই দিয়েছিল, ছয় সপ্তাহ বাঁচবেন, তাই তাঁকে তারা কেমোথেরাপি না দিয়েই ফেরত পাঠাল। আমেরিকার হাসপাতালে ৬টি কেমো কাজ দিল, স্প্লিনের টিউমারটারও অপসারণ ঘটল। কিন্তু পুনরায় ক্যানসারে আক্রান্তের আশঙ্কা থাকল, সেটা ঘোচাতে তাঁর পুত্রতুল্য জামাতা মিয়া নাইম হাবিবের টিস্যু নিয়ে বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশন হলো। ২০১৩ সালে হলো সফল ওপেন হার্ট সার্জারি। ২০১৮ সালের শুরু থেকেই অসুস্থ বোধ করছিলেন। কিন্তু বার্তাকক্ষের টান তাঁকে কিছু স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করাল। তাঁর অন্তিম ইচ্ছা ছিল বার্তাকক্ষেই যেন তাঁর মৃত্যু ঘটে। সেই ইচ্ছাটা এক অর্থে পূরণ হয়েছে। ২৮ জুলাই রাতে সমকাল–এ কাজের টেবিলে দুর্বল বোধ করায় উত্তরার বাসায় যান, পরদিন ল্যাবএইডে, সেখানে তাঁকে শেষবারের মতো দেখি। ৩ আগস্ট এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে সিঙ্গাপুরে যান। নিউমোনিয়া তাঁর ফুসফুসকে আক্রান্ত করেছিল, আর সেটাই কাল হলো।

তিনি প্রধান শিক্ষক ছিলেন। বিদ্যোৎসাহী ছিলেন। কিন্তু সাংবাদিকতায় পরিচয়টাই তাঁর বড়। তাঁর পেশাদারত্ব, কর্তব্যপরায়ণতা ও শ্রমশীলতা আমার মতো আরও অনেক অনুজকে মুগ্ধ ও ঋদ্ধ করেছে। তাঁর সংবাদ পরিবেশনার কৌশল, তাঁর লেখনশৈলী আমাদের সাহস ও শক্তি জুগিয়েছে। সংবাদকক্ষই ছিল তাঁর ধ্যানজ্ঞান। আপনি উত্তরা থাকেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি সহাস্যে বলতেন, উত্তরায় ঘুমাই। যে গোলাম সারওয়ার ৭৫ বছরের জীবনের মধ্যে পাঁচ দশকের বেশি সময় বার্তাকক্ষেই কাটিয়ে গেলেন, তাঁর মৃত্যু নেই। তিনি আমাদের নিত্যপ্রেরণা হয়ে থাকবেন।

 মিজানুর রহমান খান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক