নির্বাচন ও নির্বাচনী আইনের প্রয়োগের প্রশ্ন

এবারের নির্বাচনে নারী ভোটারদের উপস্থিতি বেড়েছে
এবারের নির্বাচনে নারী ভোটারদের উপস্থিতি বেড়েছে

২০১৮ সালে পাকিস্তানের নির্বাচনে সাবেক ক্রিকেটার ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হলেও এককভাবে সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেনি। সরকার গঠনের জন্য পিটিআইকে ছোট ছোট দলের সহযোগিতা নিতে হচ্ছে। ইতিমধ্যেই মুসলিম লিগ (এন) এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) সংসদে বিরোধী হিসেবে একযোগে কাজ করার অঙ্গীকার করেছে। পাকিস্তানের অন্যান্য প্রদেশের অন্যতম খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশে পিটিআই এককভাবে সরকার গঠনের যোগ্য। অপরদিকে পিপিপি সিন্ধু প্রদেশে সরকার গঠনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। বেলুচিস্তানে পাকিস্তানের কোনো বড় দলের অস্তিত্বই যেন নেই। তবে পাকিস্তানের সবচেয়ে জনবহুল ও গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশ পাঞ্জাবে নওয়াজ শরিফের মুসলিম লিগ (এন) প্রাদেশিক সরকার গঠনের পথে।

ইতিমধ্যেই এমকিউএম-পিসহ অন্যান্য ছোট ছোট ও বেশির ভাগ স্বতন্ত্র নির্বাচিত সদস্যরা পিটিআইকে সরকার গঠনে সমর্থন দেওয়ার কারণে ১১৬ আসন নিয়ে পিটিআই-ই পাকিস্তানে সরকার গঠন করছে। ১৮ আগস্ট শপথ নেওয়ার মধ্য দিয়ে ইমরান খান হতে চলেছেন প্রধানমন্ত্রী। ইমরান খানের রাজনৈতিক জীবন খুব দীর্ঘ সময়ের নয়, তবে নতুন দল গঠনের ২২ বছরের মাথায় পাকিস্তানের পুরোনো দুটি দলকে পেছনে ফেলে এগিয়ে আসাকে অনেকে অন্যভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। পশ্চিমা গণমাধ্যমসহ এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশের গণমাধ্যমের বিশ্লেষণের সারমর্ম হলো, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর প্রচ্ছন্ন মদদে ইমরান খান প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন। পাকিস্তানের গণতন্ত্র যে সেনাবাহিনীর প্রচ্ছন্ন মদদ ছাড়া অচল, এটা সবাই বিশ্বাস করেন।

পাকিস্তানের রাজনীতিতে অলিখিত হলেও সব সময়ই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইচ্ছার প্রতিফলন হয়েছে। এর প্রথম কারণ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত প্রত্যক্ষভাবে সামরিক শাসন চলেছে। এবং পরে পাকিস্তানে বিভিন্ন সময়ে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এলেও পর্দার আড়ালে সামরিক বাহিনী সব সময়ই সক্রিয় থেকেছে। এই প্রভাব থেকে বের হতে গিয়েই দ্বিতীয় মেয়াদের পর নওয়াজ শরিফকে দুর্নীতির দায়ে জেলে যেতে হয়েছে বলে উপমহাদেশের অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন। নওয়াজ শরিফের প্রথম দফার সরকারের সময়ে কারগিল যুদ্ধ নিয়ে দ্বন্দ্বের জের হিসেবে পারভেজ মোশাররফ পাকিস্তানের চতুর্থ সামরিক শাসক হিসেবে ক্ষমতা দখল করেন এবং দীর্ঘদিন ক্ষমতায় ছিলেন।

পাকিস্তান সামরিক বাহিনী যেসব জায়গায় সরকারের নিঃশর্ত সমর্থন চায় বা যেসব বিষয়ে সরকারের কোনো হস্তক্ষেপ আশা করে না, এমন বিষয় মোটাদাগে তিনটি। এক. পারমাণবিক অস্ত্রের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ, দুই. সামরিক বাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ, তিন. কাশ্মীর ইস্যু। অনেকে অবশ্য এই কয়েকটি বিষয়ের সঙ্গে আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ও যুক্ত করেন। ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের মূল ইস্যু কাশ্মীর। কাশ্মীর ঘিরে জঙ্গি হামলা ও প্রায় যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যেই পাকিস্তানের সরকারগুলো ভারতের সঙ্গে যতটুকু সম্ভব সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করে। এসব বিষয় নিয়ে পিপিপি সরকারের সঙ্গে সেনাবাহিনীর তেমন টানাপোড়েন ছিল না। কিন্তু নওয়াজ শরিফ এ ধরনের পরিবেশ থেকে বের হতে চেয়েছিলেন। এ বিষয়টিই নেওয়াজের বর্তমান পরিণতির জন্য দায়ী বলে মনে করা হয়।

যা–ই হোক, পাকিস্তানের ২০১৮ সালের নির্বাচনে কারচুপির প্রশ্ন তুলে পিপিপি এবং মুসলিম লিগ (এন) প্রথমে ফলাফল প্রত্যাখ্যান করার ঘোষণা দিলেও পরে নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তবে পরে ফলাফল একপ্রকার মেনেই নিয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, পাকিস্তানের ২৭০ আসনের সংসদ নির্বাচনে প্রায় ৩৫ থেকে ৪০টি আসনে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। নির্বাচন কমিশনকে অবশ্যই এসব আসনের অভিযোগগুলো তদন্ত করে পুনরায় নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে—এমন দাবি উঠেছে। এসব আসনের বিজয়ী প্রার্থীরা সিংহভাগ পিটিআইয়ের। নির্বাচন কমিশনের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগও উত্থাপন করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, অনেক কেন্দ্র থেকে বিরোধী প্রার্থীদের বের করে দেওয়া হয়েছে এবং আইনানুগ প্রক্রিয়ায় কেন্দ্রের ফলাফল এজেন্টদের দেওয়া হয়নি। এসব অভিযোগের তেমন কোনো কার্যকরী জবাব নির্বাচন কমিশন থেকে পাওয়া যায়নি। অবশ্য পিটিআইয়ের প্রধান এবং পাকিস্তানের হবু প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বলেছেন, নির্বাচন কমিশন অধিকতর তদন্ত করতে চাইলে তিনি সহযোগিতা করবেন।

১৯৫৬ সালে গঠিত পাকিস্তান নির্বাচন কমিশন ১৯৭০ সালে প্রথম সাধারণ নির্বাচন করার সুযোগ পায়। এরপর দীর্ঘদিন সামরিক শাসনের সময় তথাকথিত নির্বাচনে পার্লামেন্ট হয়েছে। প্রকৃত অর্থে গণতান্ত্রিক নির্বাচন করতে কমিশনকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। এর মধ্যে পাকিস্তানের নির্বাচনী আইনে বহু সংযোজন–বিয়োজন হলেও ভারতের তুলনায় অনেক পিছিয়ে ছিল। এমনকি বাংলাদেশের নির্বাচন পরিচালনার আইন ও বিধির তুলনায় যথেষ্ট পিছিয়ে ছিল। নির্বাচন কমিশনকে অধিক ক্ষমতায়নের জন্য নাগরিক সমাজ থেকে ক্রমাগত চাপের মুখে নির্বাচিত সরকার আইন কমিটির মাধ্যমে নতুন আইন ইলেকশন অ্যাক্ট ২০১৭ গত সংসদে অনুমোদিত হয়। এই সংশোধিত আইনের নতুন সংযোজিত অনুচ্ছেদগুলো নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করেছে। পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন বিধি তৈরির পুরো ক্ষমতা পায়। আগে প্রেসিডেন্টের অনুমতি সাপেক্ষে তা তৈরি করতে হতো। এই অনুচ্ছেদের মাধ্যমে পাকিস্তান নির্বাচন কমিশন যথেষ্ট শক্তিশালী হয়েছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন এ স্বাধীনতা বহুদিন ধরে ভোগ করে আসছে। এ ক্ষমতা এখন পর্যন্ত ভারতীয় নির্বাচন কমিশন পায়নি, যদিও গত ২০ বছর ভারতের নির্বাচনী আইনের সংস্কারের দাবি চলমান। এমনকি ভারতের পার্লামেন্ট কর্তৃক গঠিত নির্বাচন আইন সংস্কার কমিটিও একাধিকবার এ বিষয়ে সুপারিশ করেছে।

পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশনকে অ্যাক্টের অনুচ্ছেদ ৮ (বি) অনুযায়ী যেকোনো ব্যক্তির নির্বাচনসংক্রান্ত আদেশ পর্যালোচনা, তদন্তের মাধ্যমে প্রমাণিত হলে, ওই কর্মকর্তার জারি করা নির্দেশনা বাতিল হয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে তেমন কোনো সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়নি। এ কারণেই বিরোধী দলগুলো নির্বাচন কমিশনকে ওই কয়েকটি সংসদীয় আসনের ফলাফল বাতিল করে নতুনভাবে ওই সব জায়গায় নতুনভাবে নির্বাচন করার তাগিদ দিলেও নির্বাচন কমিশন এই দাবি মানবে কি মানবে না, সে ব্যাপারে কোনো বিবৃতি দেয়নি।

নতুন আইনে পাকিস্তানে নারী ভোটারদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে কোনো কেন্দ্র অথবা সংসদীয় আসনে ন্যূনতম নারী ভোটারদের উপস্থিতি একপ্রকার বাধ্য করা হয়েছে। এই অনুচ্ছেদের অধীন কোনো কেন্দ্র অথবা সংসদীয় আসনে মোট প্রদত্ত ভোটের ১০ শতাংশ নারী ভোটারের ভোট গৃহীত না হলে ওই সব কেন্দ্র এবং প্রয়োজনে পূর্ণাঙ্গ সংসদীয় আসনের নির্বাচন বাতিল করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। পাকিস্তানের বহু এলাকায় সামাজিক এবং কোথাও কোথাও ধর্মীয় অনুশাসনের কারণে নারী ভোটার উপস্থিতি কম হয়ে আসছিল, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে। এ কারণেই এবারের নির্বাচনে নারী উপস্থিতি আগের তুলনায় অনেক বেশি হয়েছে বলে বিভিন্ন তথ্যে প্রকাশ।

যা–ই হোক, পাকিস্তানের নির্বাচন আইন, ২০১৭ যথেষ্ট শক্তিশালী। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সেখানকার নির্বাচন কমিশনকে আরও ক্ষমতা দিলেও কি কমিশন সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবে? এটা মনে রাখতে হবে যে পাকিস্তানের এই নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই হয়েছে এবং এরপরও প্রশ্ন উঠেছে।

কাজেই শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা কঠিন নির্বাচনী আইন থাকলেই যে নির্বাচন সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য হবে বা হতে পারে, বিষয়টি তা নয়। সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের অন্যতম উপাদান হচ্ছে নির্বাচনী পরিবেশ। সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সে পরিবেশ তৈরি করা যাদের দায়িত্ব, তারা তা করতে সক্ষম কি না, পাকিস্তানের এবারের নির্বাচন সেই প্রশ্নকেই সামনে নিয়ে এসেছে। তবে সবকিছুর পরও যা গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে, পাকিস্তানের মতো দেশে
লাগাতার তৃতীয় বেসামরিক সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।

 এম সাখাওয়াত হোসেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার, কলাম লেখক ও পিএইচডি গবেষক