পররাষ্ট্রমন্ত্রীর রাখাইন সফর

গত বছরের আগস্টে রোহিঙ্গাদের বাস্তুচ্যুত করার পর সম্প্রতি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর রাখাইন পরিদর্শন একটি ইতিবাচক অগ্রগতি। কিন্তু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে কেবল আশ্রয়স্থল বা বাড়িঘর নির্মাণের অগ্রগতি–সংক্রান্ত তথ্য রয়েছে। মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অবিলম্বে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করার যে বিশেষ তাগিদ দিয়েছেন, তাতেও বিস্ময় নেই। কারণ, প্রতীয়মান হচ্ছে যে রোহিঙ্গাদের স্থায়ীভাবে নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়ার জরুরি প্রশ্নটি ঊহ্য রেখেই মিয়ানমার প্রত্যাবাসন শুরু করতে চাইছে। কারণ, ভাবমূর্তির সংকটে থাকা মিয়ানমার বিশ্বকে দেখাতে চায় যে রোহিঙ্গা সংকটের নিরসনে তারা উদাসীন নয়। তাদের ওপর অবরোধসহ নানামুখী যেসব চাপ রয়েছে, তা থেকে বেরিয়ে আসাটাই তাদের জন্য জরুরি।

অন্যদিকে বাংলাদেশের সামনে রূঢ় বাস্তবতা হলো, কোনো বিবেচনাতেই মিয়ানমারের প্রায় ১০ লাখ মানুষকে অনির্দিষ্টকাল ধরে আশ্রয় দেওয়া সম্ভব নয়। যতই দিন গড়াবে, ততই তাদের মানবিক পুনর্বাসনের দাবি জোরালো হবে। রোহিঙ্গাদের খেয়ে-পরে থাকতেই যে পরিমাণ সাহায্য দরকার, তার থেকে দাতাগোষ্ঠীর কাছ থেকে মোট সাহায্যপ্রাপ্তি অপ্রতুল। সে কারণে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের রাখাইন সফরের ফলাফল সম্পর্কে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেওয়া বিজ্ঞপ্তিকে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত হবে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে মূল্যায়ন করা। তাদের বুঝতে হবে, বরফ যেটা জমেছে, সেটা যে তার নিজের পক্ষে গলানো কঠিন, সেটাই প্রমাণিত হলো। তুর্কি সংবাদ সংস্থা বলেছে, বাংলাদেশি দল শূন্য হাতে ফিরেছে। ভরা হাত কি আশা করেছে? যেখানে বিশ্ব জানে যে মিয়ানমারের নীতির কোনো বদল ঘটেনি।

সার্বিক বিচারে স্বেচ্ছামূলক প্রত্যাবাসনের অনুকূল পরিবেশ তৈরি হওয়া থেকে পরিস্থিতি এখনো অনেক দূরে। কারণ, মূল প্রশ্ন হলো নাগরিকত্ব যাচাই। নাগরিকত্ব ও কর্মসংস্থানের সম-অধিকার নিশ্চিত করা হলে বহু রোহিঙ্গা অর্থ উপার্জন করে নিজেরাই মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিতে পারবে। আর নাগরিকত্ব ফয়সালা না করে আপাতত তাদের ফিরিয়ে নিলে অতীতের মতো একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে।

বাংলাদেশকে এখন বিশ্বকে সঙ্গে নিয়ে মিয়ানমারের ওপর চাপ বাড়িয়ে নিশ্চিত করতে হবে যে তাদের জাতীয়তা যাচাইয়ের প্রক্রিয়া বা ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড (এনভিসি) এভাবে বহাল রাখা যাবে না। তাদের নীতি পাল্টাতে হবে। স্বেচ্ছা প্রত্যাবাসনের পরিবেশ তৈরি করে রোহিঙ্গাদের আস্থা অর্জন করতে হবে। এনভিসির ব্যাপারে রোহিঙ্গাদের অনীহা স্বাভাবিক। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যথার্থই ‘সহায়ক পরিবেশ’ তৈরির ওপর জোর দিয়েছেন। কিন্তু এনভিসি আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ সনদের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করা পূর্বশর্ত। সাম্প্রতিক কালেও যঁারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন, এমন রোহিঙ্গারা অভিযোগ করেছেন, রাখাইনের কর্মকর্তারা হুমকি দিয়েছেন যে ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড (এনভিসি) না নিলে তাঁদের রাখাইনে থাকতে দেওয়া হবে না। হত্যার হুমকির অভিযোগও রয়েছে। মিয়ানমার বলছে, এনভিসি হলো নাগরিকত্ব যাচাইয়ের প্রাথমিক পদক্ষেপ। আর পোড় খাওয়া রোহিঙ্গারা বলছে, এটা প্রতারণার কূটকৌশল হতে পারে। এই প্রক্রিয়ায় একবার নাম লেখালে আদৌ কখনো নাগরিকত্ব মিলবে—তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। সুতরাং এ জন্য দরকার একটি উপযুক্ত নাগরিকত্ব আইন।

এ বিষয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধিদলের সফর শেষে ঢাকায় দেওয়া বিবৃতি সাক্ষ্য দিচ্ছে যে নাগরিকত্ব যদি উদ্বাস্তু সংকটের অন্যতম মুখ্য কারণ হয়ে থাকে, তাহলে এর সুরাহার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেই এগিয়ে আসতে হবে। আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি, রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা দিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উদ্বেগ প্রকাশ করলেও এনভিসি নিয়ে তাদের কারও কোনো উদ্বেগ আছে বলে মনে হয় না। অথচ এই এনভিসি-প্রক্রিয়া কফি আনান কমিশনের সুপারিশের সঙ্গেও সংগতিপূর্ণ নয়। সুতরাং বাড়ি বা পুনর্বাসনের আগে এনভিসির ফয়সালাটা জরুরি।