তিস্তার পানি কত দূর?

তিস্তায় পানির প্রাপ্যতা নিয়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের আলোচনা অনেক পুরোনো
তিস্তায় পানির প্রাপ্যতা নিয়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের আলোচনা অনেক পুরোনো

চলতি সপ্তাহে কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট ও নীলফামারী জেলায় তিস্তা নদীর পাঁচটি পয়েন্টে অনেক মানুষের সঙ্গে তিস্তা নিয়ে কথা বলি। কুড়িগ্রামের চিলমারী, রাজারহাট, লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ এবং নীলফামারীর ডিমলা উপজেলায় নদী তীরবর্তী মানুষ বলেছেন তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা। তাঁদের সবার বক্তব্যে একটি বিষয় পরিষ্কার—তিস্তা নদীতে সারা বছর পানির স্রোতোধারা বজায় রাখতেই হবে। শুষ্ক মৌসুমে তিস্তায় পানি না থাকার ভোগান্তি পোহাতে হয় বর্ষা মৌসুমেও। ২০১৪ সাল থেকে ভারত তিস্তার পানি একতরফা প্রত্যাহার করছে। ফলে এই নদীর ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠী বিপদে পড়েছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক দৃশ্যমান হলেও নদীর পানি প্রসঙ্গে সেই বন্ধুত্ব ফুটে ওঠেনি।

তিস্তায় পানির প্রাপ্যতা নিয়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের আলোচনা অনেক পুরোনো। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরের বছরই বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ নদী কমিশনের দ্বিতীয় সভায় তিস্তার পানিবণ্টন বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। তারও প্রায় ১০ বছর পর ১৯৮৩ সালে ২ বছরের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন একটি চুক্তিও হয়েছিল। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশের জন্য ছিল ৩৬ শতাংশ, ভারতের জন্য ৩৯ শতাংশ এবং তিস্তার নাব্যতা বজায় রাখার জন্য ২৫ শতাংশ পানি রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছিল।

১৯৮৫ সালে মেয়াদ শেষ হয়। পরে আরও ২ বছর সেই চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছিল। ১৯৮৭ সালের পর তিস্তা নিয়ে আর কোনো চুক্তি হয়নি। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি হওয়ার কথা ছিল। সে সময় আমরা তিস্তার পানিতে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যার দাবি করছিলাম। ন্যায্য হিস্যা তো দূরের কথা, আরও ৭ বছর পেরিয়ে গেলেও তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি আজ পর্যন্ত হয়নি। নিকট ভবিষ্যতে কোনো সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না।

১৯৯৭ সালের আন্তর্জাতিক পানিপ্রবাহ কনভেনশন অনুযায়ী, ২০১৪ সালের ১৭ আগস্ট অভিন্ন নদীতে অভিন্ন অধিকার প্রতিষ্ঠায় আইন প্রণীত হয়েছে। ওই বছর থেকে দিবসটি ‘নদী অধিকার দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। দুঃখজনক বিষয়, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার সেই আইনটিতে অনুসমর্থন করেনি। ফলে জাতিসংঘে বাংলাদেশ যে অভিন্ন নদীতে অভিন্ন অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য দাবি জানাবে, তার কোনো ক্ষেত্রও প্রস্তুত হয়নি।

তিস্তা মানে শুধু তিস্তা নয়। বাংলাদেশ যদি তিস্তায় অভিন্ন অধিকার প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়, তাহলে বাংলাদেশ-ভারত স্বীকৃত আরও যে ৫৩টি নদীর পানি ভারত থেকে আসে, সেগুলোতেও অধিকার প্রতিষ্ঠা করা অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। বাংলাদেশ-ভারত স্বীকৃত অভিন্ন ৫৩টি নদী ছাড়াও আরও অন্তত ৫০টি অভিন্ন নদী আছে। ভারত ক্রমান্বয়ে সব নদীর পানি প্রত্যাহার করবে। সময় থাকতেই তিস্তায় অভিন্ন অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

সম্প্রতি ভারত থেকে কয়েকজন নদীকর্মী এসেছিলেন। এনার্জি অ্যান্ড ক্লাইমেট গ্রুপের আহ্বায়ক সৌম্য দত্ত, ইন্টারন্যাশনাল রিভার্সের আয়শা ডিসুজা এবং নর্থ ইস্টার্ন সোসাইটি ফর প্রিজারভেশন অব নেচার (নেসপন)-এর সহকারী সম্পাদক অর্ণব ভট্টাচার্য এসেছিলেন বাংলাদেশ অংশে তিস্তার অবস্থা বোঝার জন্য। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রিভারাইন পিপলের সংগঠকদের সঙ্গে বৈঠককালে ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের বিষয়ে তাঁরা কী করছেন এমন প্রশ্নের জবাবে সৌম্য দত্ত বলেন, ‘আমরা বলে আসছি ব্যারাজগুলো নদীর ক্ষতি করছে। সব ব্যারাজ তুলে ফেলা হোক। কল্যাণ রুদ্রের তিস্তাবিষয়ক পর্যালোচনা পাবলিক করা হোক। নদীর পানি পরিমাণ অনুযায়ী বণ্টন করা হোক। ভারতে আমরা এসব কথা বলি। সে কারণে আমাদের বাংলাদেশের এজেন্ট বলে, দেশদ্রোহীও বলে।’ অর্ণব ভট্টাচার্য বলেন, ‘গজলডোবা দিয়ে জল সরে যাওয়ার ফলে শুধু বাংলাদেশের লোকজন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তা নয়, আমাদের দেশের পশ্চিমবঙ্গের লোকজন একই সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। ১৯৭৯ সালে গজলডোবায় বাঁধ দেওয়ার পর সেসব অঞ্চলে মানুষের দুঃখ-কষ্ট, নদীর ভাঙন বেড়ে গেছে।’

বাংলাদেশ-ভারত কারও জন্য বাঁধ কল্যাণ বয়ে আনছে না। ভারত এখন উপলব্ধি করছে গঙ্গার ওপর বাঁধ দেওয়া তাদের জন্য লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি হচ্ছে। তিস্তার উজানে ভারতের ব্যারাজ নির্মাণ করারও ফল ভালো হয়নি। বাংলাদেশের যে বাঁধ আছে, তারও ফল ভালো নয়। বাঁধ দেওয়ার কারণে ভারতের শিলিগুড়িতে সমতলভূমির চেয়ে নদীর তলদেশ উঁচু হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের অনেক স্থানে একই অবস্থা দেখা দিচ্ছে। পানির স্বাভাবিক প্রবাহ না থাকার কারণে পলি সরছে না। এ রকম চলতে থাকলে তিস্তা হয়ে উঠবে অভিশাপ।

১৯৯০ সালেও তিস্তায় অনেক পানি ছিল। তিস্তা সেচ প্রকল্পের প্রথম শ্রেণির ঠিকাদার গোলজার হোসেন। ১৪ আগস্ট তিস্তা সেচ প্রকল্পসংলগ্ন কার্যালয়ে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি বলছিলেন, যখন তিস্তা সেচ প্রকল্প চালু হয়, সে সময় চৈত্র মাসে শুষ্ক মৌসুমে যে পরিমাণ পানি থাকত, এখন বর্ষা মৌসুমে কখনো কখনো ওই পরিমাণ পানি থাকে। সেই সময় তিস্তা ছিল অনেক গভীর। লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার উত্তর ডাউয়াবাড়ির বাসিন্দা ছাদেকুল ইসলাম বলেন—তিস্তা ব্যারাজ এখনই তুলে দেওয়া দরকার। ব্যারাজের ভাটিতে পানি একেবারেই থাকে না। ফলে ব্যারাজের ভাটিতে কৃষি ও জনজীবন বিপন্ন হয়ে উঠছে।

তিস্তার মোট দৈর্ঘ্য ৩১৫ কিলোমিটার। বাংলাদেশ অংশে ১১৫ কিলোমিটার। তিস্তা সেচ প্রকল্পের ব্যারাজের উজানে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার। প্রায় ৭০ কিলোমিটার ভাটিতে। এ অংশ কখনো কখনো একেবারেই শুকিয়ে যায়। বাংলাদেশ অংশে মার্চ-এপ্রিল মাসে ভারত থেকে কখনো কখনো মাত্র ১৫০-২০০ কিউসেক পানি আসে।

তিস্তার মতো একটি আন্তসীমান্তীয় নদীর পানি ভারত একতরফা প্রত্যাহার করছে। বাংলাদেশ সেখানে নতজানু নীতি গ্রহণ করলে তার ফল কিছুতেই ভালো হবে না। তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তির ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্মত নন বলে করা যাচ্ছে না, এ কথা বলে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বিষয়টি এড়িয়ে যাবে তা হয় না। বাংলাদেশের কূটনৈতিক তত্পরতা বৃদ্ধি করা জরুরি। বছর দুয়েক আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তিস্তার পানির বিকল্প হিসেবে জলঢাকা, তোরসা নদীর পানির কথা বলেছেন। তিস্তার পানির বিকল্প হিসেবে অন্য নদীর পানি কখনোই হয় না। আইনি প্রক্রিয়ায় হোক কিংবা কূটনৈতিক তৎপরতায় হোক, তিস্তায় পানির কোনো বিকল্প নেই।

তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং রিভারাইন পিপলের পরিচালক