ঈদে ঘরে ফেরা

লেখিকা
লেখিকা

একসময় ঈদে ঘরে ফিরতাম। যখন রোকেয়া হলে থাকতাম প্রথম রোজা থেকেই দিন গোনা শুরু হয়ে যেত, কবে বাড়ি যাব। অনেক সময় এমন হতো যে, শেষের দুই-তিনটা ক্লাস না করে বাড়ি চলে যেতাম। আব্বা যে টাকা দিতেন তা থেকে বাঁচিয়ে আম্মার জন্য একটা প্রাইড শাড়ি, আব্বার জন্য গ্রামীণের শোরুম থেকে একটা ফতুয়া আর ছোট ভাই আর বোনের জন্য গাউছিয়া মার্কেট থেকে কিছু কিনতাম। এই সামান্য জিনিস কিনেই তখন মনে হতো অনেক কিছু করে ফেলেছি। বিজয়ের হাসি হেসে মাগুরার ঊদ্দেশে রওনা হতাম।
হলে আমাদের যাদের বাড়ি মাগুরা, যশোর, খুলনা ও সাতক্ষীরায় ছিল তারা অনেকেই একসঙ্গে যেতাম। গাবতলীতে গিয়ে গাড়িতে ঊঠতাম। দৌলতদিয়া ঘাট পার হলেই মনে হতো এই তো চলে এলাম বাড়ি। তারপর রাজবাড়ী, ফরিদপুর, মধুখালী পার হয়ে যখনই কামারখালী পৌঁছাতাম মনটা আনন্দে নেচে উঠত। কত দিন পর বাবা-মা, ভাইবোনকে দেখব। গাড়ি আমাদের বাড়ির সামনেই নামিয়ে দিত। তখন তো আর মোবাইল ছিল না। তাই বাড়িতে জানানোর উপায় ছিল না আমরা কবে বাড়ি যাচ্ছি। হঠাৎ​ করে যখন বাড়িতে উপস্থিত হতাম সবাই খুব খুশি হতো। একে একে সব ভাইবোন বাড়িতে আসত। আম্মা রান্না করতেন আর আমরা তা সাবাড় করতাম। আহা কত দিন পর আম্মার হাতের রান্না আর মনে হতো সব চেটেপুটে খেয়ে ফেলি। ঈদকে ঘিরে আমাদের বাড়ি চলত আনন্দ, ঘর পরিষ্কার করা, ঝুল ভাঙা, নতুন পর্দা লাগানো, সোফার কভার চেঞ্জ করা। কাজ যেন শেষ হতো না। মনের আনন্দে আম্মার সঙ্গে আমরা তিন বোন সব কাজ করতাম। বাড়ি ফেরার আনন্দ ছিল অনেক মধুর।

তারপর কি হলো? মাস্টার্স পাস করলাম, বিয়ে হলো, নতুন জীবন শুরু হলো। আর কোনোদিন সেই ভাবে ঈদে বাড়ি ফেরা হলো না। গেলেও ঈদের পরের দিন। আমাদের দেশের মেয়েরা এ ভাবেই মেনে নিয়েছি যেন বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়ি ঈদ করতে হবে। না করলে মনোমালিন্য। কিন্তু সত্যি বলতে কি মন পড়ে থাকত বাবার বাড়ি। মনে মনে কল্পনায় ঈদের দিন আমি যেন আমার বাবার বাড়িতেই ঘোরাঘুরি করতাম। আব্বা আর ভাইদের পাঞ্জাবি এগিয়ে দিতাম, বাড়ির সামনের ঈদগাহ থেকে বারো ভাজা কিনে খেতাম, এ সবই করতাম কল্পনায়। আসলে ২৪ বছর যে বাড়িতে ঈদ করেছি তা কি আর একদিনে ভোলা যায়? না কি মন থেকে মুছে ফেলা যায়। আমার ছোট ভাই তখন খুব ছোট। আমরা তিন বোনের যখন কোনো বোনই ঈদের দিন আসতাম না ওর মন খারাপ হতো। বলত আপনাদের আসার দরকার নেই, শুধু আপনাদের বিয়ে হয়েছে আর কারও বিয়ে হয়নি। কি দিয়ে বোঝাব ওকে, কী ভাবে বোঝাব যে বিয়ের পর মেয়েদের দায়িত্ব অনেক বেড়ে যায়, আমাদের অনেক কিছু করার ইচ্ছা থাকলেও আমরা করতে পারি না।
তারপর তো একদিন দেশের সীমানা ছেড়ে একেবারে বাইরে চলে আসলাম। প্রবাসে ঈদের আনন্দ বড় আপেক্ষিক। আমাদের কাছে ঈদের দিন অন্য দশটা দিনের মতোই। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের প্রধান ধর্মীয় উৎসবের দিন সরকারি ছুটি থাকে। এ সব দেশে তা দেওয়া হয় না। ঈদের দিন আমাদের মন পড়ে থাকে দেশে। ঈদের দিন দেশ, আত্মীয়স্বজন ও ঈদের আনন্দের জন্য মন কেমন-কেমন করে। কেমন জানি খুব অসহায় লাগে। মনে হয় কোথাও কেউ নেই। রাতে ফোনে বা স্কাইপে দেশে থাকা সবার সঙ্গে। আর এই ফোন আর স্কাইপের মাধ্যমে কিছুটা হলেও ঈদের আনন্দ পাওয়ার চেষ্টা করি।
কত দিন ঈদে ঘরে ফিরিনি। খুব ইচ্ছা করে ঘরে ফিরতে। সবাই যখন ঈদে ঘরে ফেরে আমার দুই চোখ দিয়ে তখন পানি পড়ে আর মনে হয় যদি পাখির মতো দুটো ডানা থাকত, তাহলে কাউকে না বলে হঠাৎ করে সবার জন্য গিফট কিনে ঈদের আগের দিন উপস্থিত হতাম আমাদের মাগুরার ওই ছোট বাড়িতে, এক এক করে সবাইকে গিফটগুলো বের করে দিতাম, সবার মন খুশিতে ভরে উঠত। আব্বা খুশি হতেন সবচেয়ে বেশি, বলতেন দেখ দেখ কত কিছু এনেছে। নিজে নিজেই সবকিছু নিয়ে আলমারিতে গুছিয়ে রাখতেন। বের করে দিতেন ঈদের দিন সকালে, আম্মা সেমাই রান্না করতেন, সবাই মিষ্টি মুখ করে ঈদের নামজ পড়তে যেত। সারা দিন সব ভাইবোন এক সঙ্গে খুনসুটি করতাম আব্বার বিছানায় বসে। আম্মা মজার মজার রান্না করতেন আর আমরা তা চেটেপুটে খেতাম।
কবে আসবে সে দিন, আর আসলেও তো বাবা মাকে পাব না। সব যে এখন স্মৃতি হয়ে গেছে। এখন ঈদে বাড়ি গেলেও সেই আনন্দ কি আর পাব? এখন বাড়ি শূন্য, ঘর শূন্য, চারদিকে শুধুই শূন্যতা। মনে হয় কেউ কোথাও নেই।