ঈদের আগেই মুক্তি দিন

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

রাজনৈতিক আন্দোলন তথা রাজনীতি বন্ধ অনেক দিন। ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের বিচিত্র রকম তৎপরতা আছে, রাজনীতি নেই। বিরোধী দলের স্বনামধন্য নেতাদের কেউ বার্ধক্যজনিত অবসরে, কেউ সংবাদপত্রে মস্ত মস্ত কলাম লেখায় মগ্ন, কেউ প্রতিদিন টিভি টক শোতে একাধিক কেন্দ্র থেকে বাণী বিতরণ করছেন, কেউবা ঘন ঘন বিদেশ সফর উপভোগ করছেন, শিল্প-কারখানা ও বাণিজ্য নিয়ে ঘর্মাক্ত কেউ কেউ।

অন্যদিকে জনগণ ইতিহাসের সবচেয়ে প্রশান্ত সময় পার করছে। বিরোধী নেতা-কর্মীদের অনেকে অবশ্য কাশিমপুর বা কেরানীগঞ্জের নতুন ভবনে রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে দিন যাপন করছেন। রাজনীতিকরনেওয়ালাদের ওরকম আতিথেয়তা গ্রহণ করতে হয়। কখনো পালিয়ে থাকাও প্রচলিত রীতি।

গত কয়েক মাসে যে দুটি আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে, তার প্রকৃতি ভিন্ন। বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে পেশাজীবীরা যে আন্দোলন বা ‘আমরণ অনশন’ করেন, তার সঙ্গেও এই দুই আন্দোলনের কোনো মিল নেই। আন্দোলন দুটি আদৌ সরকারবিরোধী ছিল না। আন্দোলনে যারা অংশ নিয়েছিল, তাদের পরিবারের কারও কোনো না কোনো দলের প্রতি সমর্থন থাকলেও থাকতে পারে। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক ছিল না। বহু দিন ধরে শিক্ষার্থীরা চাইছিল সরকারি চাকরিতে কোটা সংরক্ষণের যে ব্যবস্থা রয়েছে, তার সংস্কার। নীতিনির্ধারকেরা যুক্তিবাদী মন নিয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসলে আন্দোলনের জন্য কোটাব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে তরুণসমাজের রাস্তায় নামার প্রয়োজনই হতো না।

তারপরও কোটা সংস্কারের আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ। আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলার পর তারা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তা শান্ত করাও কঠিন হতো না। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সরকার-সমর্থক ছাত্র-যুবসংগঠনের ক্যাডাররা তাদের আক্রমণ করে। তারুণ্যকে শক্তি প্রয়োগের দ্বারা প্রশমিত করা যায় না। তা আরও প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। তারপর ধরপাকড়, জেল-জুলুম।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে কিশোর-কিশোরীদের কথিত আন্দোলনটি ছিল একেবারেই নির্দোষ আন্দোলন। বাসের চাপায় বন্ধুদের মৃত্যুতে রাস্তায় দাঁড়িয়েছিল তারা শোক ও সমবেদনা জানাতে। এবং আর একটি বার্তা দিতে, যেন আর কারও মৃত্যু ওইভাবে না হয়।

দ্বিতীয় দিনই তারা ক্লাসে ফিরে যেত, কিন্তু একটি হাসি ও নির্দয় উক্তি শুধু শিক্ষার্থীদের মধ্যে নয়, সব স্তরের মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করে। তখন গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরানোর দাবিতে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় অবস্থান নেয়। তারা দেখিয়ে দেয়, সড়কে অনিয়ম ও অনাচার হচ্ছে এবং তা সংশোধন করা সম্ভব। কয়েক দিন ছাত্ররা বড় বড় কর্তাকে এমনকি নিজের বাবাকেও গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়ে কোনো অন্যায় করেনি, বরং দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে গুজব বড়ই মুখরোচক। কারও কারও জন্য গুজব খুব উপকারীও হতে পারে। এখন গুজব রটানোর জন্য যন্ত্র বেরিয়েছে। আড়াই শ বছর আগেও গুজব ছিল। সিরাজউদ্দৌলাকে বিপদে ফেলতে অন্ধকূপ হত্যার সংখ্যা বহু গুণ বাড়িয়ে বলা যে গুজব বা ‘অত্যুক্তি’ ছিল, তা রবীন্দ্রনাথ বলে গেছেন। ১৮৫৭-তে সিপাহি বিদ্রোহের সময় গুজবে সয়লাব হয়ে যায় দেশ। গুজবের কারণে রবীন্দ্রনাথের পিতৃদেব রাতের খাবারসহ মধ্য গঙ্গা নদীতে পুত্রকন্যাদের নিয়ে নৌকায় রাত কাটাতেন। গুজব ছড়ানো নিন্দনীয় কাজ। তবে তাতে কান না দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ।

গুজব ছড়িয়ে সরকারকে বিব্রত করা যেতে পারে, কোনো ক্ষতি করা সম্ভব নয়। গুজব ছড়ানোর অভিযোগে ৯৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তাদের অনেকে এখন কারাগারে। কেউ রিমান্ডে।

সরকারে, প্রশাসনে ও পুলিশে যাঁরা আছেন, তাঁরা সবাই সন্তানের মা-বাবা অথবা কোনো শিক্ষার্থীর অভিভাবক। আমাদের নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা উচ্চশিক্ষা নিতে এগিয়ে এসেছে, যা জাতির উন্নতির লক্ষণ। কত যে কষ্ট করে তারা লেখাপড়া শিখছে, তা কারও অজানা নয়। উচ্চশিক্ষা নিয়ে তারা পরিবারের এবং দেশের উপকার করবে, সেটাই প্রত্যাশা। আবেগের বশে সামান্য ভুলভ্রান্তির জন্য তাদের যাত্রাপথে কাঁটা পুঁতে দেওয়া ঘোরতর নির্মমতা।

দেশে খুনের আসামি দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। ব্যাংকের শত শত কোটি টাকা আত্মসাৎ করে দিব্যি আছে অনেকে। এসব কৈশোর-উত্তীর্ণ ছেলেমেয়েদের ভুল বা অপরাধ ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখা মানবিক রাষ্ট্রের কর্তব্য। এদের মুক্তি দিন-নাগরিক অভিভাবকদের পক্ষ থেকে এই আমাদের আবেদন।

সন্তানকে জেলে রেখে মা-বাবা, ভাই-বোন ঈদের আনন্দ করতে পারে না।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক