ইমরান খানের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ

ইমরান খান
ইমরান খান

শনিবার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন ইমরান খান। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁকে এখন বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে।

পাকিস্তান এখন গুরুতর অর্থনৈতিক সংকটে রয়েছে। এ ছাড়া চ্যালেঞ্জের তালিকায় রয়েছে ভঙ্গুর পররাষ্ট্রনীতি পরিবর্তন, কাশ্মীর নিয়ে ভারতের সঙ্গে অচলাবস্থা কাটিয়ে ওঠা, সন্ত্রাসবাদ প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বন্দ্বের অবসান ঘটানো।

সামরিক-বেসামরিক অনেক পাকিস্তানির মতে, এসব সমস্যার জন্য অযোগ্য ও অর্থলোলুপ রাজনীতিকেরা দায়ী। তাই তাঁরা এমন একজনের সন্ধানে ছিলেন, যিনি পাকিস্তানকে আর্থিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং সামরিকভাবে শক্তিশালী একটি দেশে পরিণত করবেন, যা বিশ্বব্যাপী সম্মানিত হবে এবং সবার আস্থা অর্জন করবে। তাঁরা মনে করছেন, ইমরান খান হচ্ছেন সেই যোগ্য ব্যক্তি।

নির্বাচনে বিজয়ের পর প্রথম ভাষণে ইমরান এই আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, একটি দুর্নীতিবিরোধী প্ল্যাটফর্মের ওপর তিনি তাঁর রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত করবেন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ভিত্তিতে কাজ করবেন, যাতে সারা বিশ্বের কাছে পাকিস্তানের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়। ইমরান খান, যিনি কিনা সেনাবাহিনীর সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন, তিনি নরম সুরে বিশ্ব ও আঞ্চলিক নীতির কথা বলেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়নে কাজ করার আগ্রহের কথা বলেছেন; ভারতের সঙ্গে আলোচনা ও আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করবেন বলেও প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন।

জাতিগত পশতুন পরিচয়ের জন্য ইমরান খান সব সময় গর্ব করেন। তাঁর পৈতৃক বাসস্থান আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্তের কাছে ওয়াজিরিস্তানে। এমনও অভিযোগ আছে, তাঁর সঙ্গে আফগান ও পাকিস্তানি তালেবানদের সখ্য রয়েছে, সে জন্য কেউ কেউ তাঁকে ‘তালেবান খান’ও বলে। তিনি হয়তো আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য একটি শান্তি আলোচনা শুরু করতে চাইবেন, যেখানে আফগান তালেবানদের অন্তর্ভুক্ত করা হবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি হয়তো তালেবানের সঙ্গে সরাসরি কথা বলাকে সমর্থন দেবেন।

পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রীর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও আফগানিস্তান—এই তিন দেশের প্রত্যাশা পূরণ করা। তালেবানকে আলোচনার টেবিলে বসানোর জন্য পাকিস্তানকে হয়তো কোনো বেগ পেতে হবে না। ইমরান খান বলেছেন, শান্তিপূর্ণ পাকিস্তানের জন্য দরকার শান্তিপূর্ণ আফগানিস্তান। ইমরানের পূর্বসূরিরা যা করেননি, ইমরান তা-ই করেছেন। তিনি আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়নে ব্যক্তিগতভাবে বিনিয়োগ করেছেন, যা কাবুলের প্রশংসা পেয়েছে। স্বয়ং প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি ইমরানকে টেলিফোন করে অভিনন্দন জানিয়েছেন।

ইমরান খানের পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) পার্টির উত্থান খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশে। দলটি সেখানে সাফল্য পাওয়ার পর জাতীয় রাজনীতিতে আসে। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সন্ত্রাসী হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে যে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান চালায়, তার প্রভাব পড়ে পাকিস্তানে খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশে। এই অঞ্চলের মানুষদেরও এ জন্য ভুগতে হয়। এ জন্য পিটিআই মনে করে, আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠা করাটা খুব জরুরি।

ইমরান খানকে খুব সতর্কতার সঙ্গে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী মনে করে, ভারত প্রচ্ছন্নভাবে পাকিস্তানে একাধিক বিদ্রোহের আগুন উসকে দিয়েছে। ভারতীয় কর্মকর্তারা এ অভিযোগ অস্বীকার করলেও কখনো পাকিস্তানের পক্ষ থেকে হাজির করা তথ্যপ্রমাণ খণ্ডন করতে পারেননি। এই সন্দেহ ও অবিশ্বাস আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠার বিষয়টিকে কেবল জটিলই করেনি, এটা ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার সম্পর্কে বৈরিতার আরেকটি মাত্রাও যোগ করেছে।

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার সমস্যার মূল কারণ হচ্ছে কাশ্মীর। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া ব্যক্তিগতভাবে এই ইঙ্গিত দিয়েছেন যে তিনি ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটাতে চান। ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর ও পাকিস্তাননিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের বিতর্কিত সীমানা লাইন অব কন্ট্রোলের কাছে পাকিস্তানি ও ভারতীয় সেনাদের গোলাগুলি থামানোর জন্য অনেকে তাঁকে কৃতিত্ব দেয়।

জেনারেল বাজওয়ার উদ্যোগে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পেছনের চ্যানেলে যেসব আলোচনা হয়েছে, তা দুই দেশের জন্য হয়তো নতুন দ্বার উন্মোচনের ইঙ্গিত। যদি ইমরান খান ও দেশটির প্রভাবশালী সামরিক বাহিনী একই পথে হাঁটে, তাহলে পাকিস্তান হয়তো সামরিক-বেসামরিক বিভাজন থেকে মুক্তি পাবে।

ইমরান খান যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও পাকিস্তানের সম্পর্কের উন্নয়ন চান। আফগানিস্তান বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দাবি পাকিস্তান মেনে না নেওয়ায় ওবামা প্রশাসন যেমন হতাশ হয়েছিল, তেমনি ট্রাম্প প্রশাসনও এখন হতাশ। ইমরান খানকে এ সমস্যা মোকাবিলা করতে হবে দক্ষতার সঙ্গে।

ইমরানের আরেক বড় চ্যালেঞ্জ দুর্বল অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা। পাকিস্তানের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ২০১৭ সালে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে ২০১৮ সালে ৫ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০১৯ সালেও এটা বাড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। অর্থনীতির ধস এড়াতে হলে পাকিস্তানের প্রয়োজন এক হাজার কোটি ডলার। এ জন্য দেশটিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের শরণাপন্ন হতে হবে, যেখানে কিনা যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও ইতিমধ্যে পাকিস্তানকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সমর্থন থাকবে না বলে জানিয়ে দিয়েছেন।

ইমরান খান খুব দ্রুতই বুঝতে পারবেন যে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুসারে স্বচ্ছ সরকার গড়ে তোলা কত কঠিন। তাঁর ক্রমবর্ধমান উচ্চাভিলাষের সঙ্গে তাঁর বেসামরিক শাসনযন্ত্র তাল মিলিয়ে চলতে পারবে না।

তবে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সক্ষমতা অনেক। ইমরান খান যদি সামরিক বাহিনীকে একজন অংশীদার করে নেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পারস্পরিক লাভজনক সম্পর্ক গড়ে তোলা ও ভারতের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তোলাসহ তার ভঙ্গুর পররাষ্ট্রনীতিকে নতুন করে নির্মাণ করতে পারেন, তাহলে তিনি যোগ্য নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবেন। তিনি যদি এসব করতে পারেন, তাহলে এ অঞ্চলে নজিরবিহীনভাবে আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হবে। 

ইংরেজি থেকে অনূদিত। নিউইয়র্ক টাইমস থেকে নেওয়া

মোশাররফ জাইদি, পাকিস্তানের ইসলামাবাদভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক