'ফুটন্ত কড়াইয়ে' ইমরান!

ইমরান খান। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়ে বিশ্বের কঠিনতম দায়িত্ব সামলানোর চাপ নিলেন তিনি। ছবি: এএফপি
ইমরান খান। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়ে বিশ্বের কঠিনতম দায়িত্ব সামলানোর চাপ নিলেন তিনি। ছবি: এএফপি

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়ে দেশ পরিচালনার আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব পেয়েছেন ইমরান খান। যেকোনো রাজনীতিকের জন্য প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়াটা অসাধারণ এক ব্যাপার। বিশেষ করে পারিবারিক কোনো রাজনৈতিক ঐতিহ্য ছাড়া এই পদ অর্জন করতে পারাটা আরও বিশেষ কিছু। এই বিশেষ কাজটিই করতে পেরেছেন ইমরান।

বিবিসি বলছে, শপথ নেওয়ার অনুষ্ঠানে ইমরানের চোখে ছিল জল, মুখে হাসি। সত্যিই তাঁর জন্য আবেগময় এক মুহূর্ত। তবে একে আমরা বাস্তবের সঙ্গেও মেলাতে পারি। যেকোনো বড় অর্জনই মানুষকে হাসিখুশি করে, ইমরান প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, তিনি তো হাসবেনই! আর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে তাঁকে পাকিস্তান পরিচালনায় ‘ফুটন্ত কড়াইয়ে’ উঠে বসতে হলো, এটা মনে হলে তো কাঁদতেই হবে ইমরানকে!

পাকিস্তানের ইতিহাস বলছে, দেশটির প্রধানমন্ত্রী পদটি যেন ‘ফুটন্ত কড়াই’! কেউই টিকতে পারেন না। এর পক্ষে একটি উদাহরণই যথেষ্ট। ৭১ বছর বয়সী দেশটির কোনো বেসামরিক প্রধানমন্ত্রীই এখন পর্যন্ত পাঁচ বছরের পুরো মেয়াদ পূরণ করতে পারেননি। ইমরান খান দেশটির ২২তম প্রধানমন্ত্রী। এর মধ্যে নওয়াজ শরিফ তিন আর বেনজির ভুট্টো দুই দফায় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বলাই বাহুল্য, তাঁরা কোনোবারই পাঁচ বছরের মেয়াদ পূরণ করতে পারেননি। কখনো সরাসরি সামরিক অভ্যুত্থান, কখনো বা বিচার বিভাগকে সামনে রেখে সেনাবাহিনীর কলকাঠি নাড়ায় পদ ছাড়তে হয়েছে ইমরানের পূর্বসূরি ২১ জনকে। এ ক্ষেত্রে পাকিস্তানের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, পাকিস্তানের পরদিন জন্ম নেওয়া ভারতে এ পর্যন্ত ১৪ জন প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। ১৪তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন নরেন্দ্র মোদি। আর এই সময়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মেসহ যুক্তরাজ্যে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন মোট ১৫ জন। ইন্ডিয়া টুডের এক প্রতিবেদনে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকে বিশ্বের সবচেয়ে কঠিনতম কাজ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

ইমরান প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পর তাঁর সমর্থকেরা করাচিতে মিষ্টি বিতরণ করেন। করাচি, পাকিস্তান। ছবি: রয়টার্স
ইমরান প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পর তাঁর সমর্থকেরা করাচিতে মিষ্টি বিতরণ করেন। করাচি, পাকিস্তান। ছবি: রয়টার্স

এ তো গেল পাকিস্তানের একটি দিক। এ ছাড়া পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে সব সময় যে চ্যালেঞ্জগুলোর সামনে দাঁড়াতে হয় তার মধ্যে রয়েছে দুর্নীতি, দারিদ্র্য, জঙ্গিবাদ, লোডশেডিং, রাজনৈতিক ডামাডোল, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক এবং অবশ্যই সেনাবাহিনী ও বিচার বিভাগ। ইমরানকে এগুলোর পাশাপাশি মোকাবিলা করতে হবে চলমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতির বিরুদ্ধেও। তাই নির্বাচনের আগে জনগণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলো পূরণে হয়তো কঠিন বিপত্তিতেই পড়তে হবে তাঁকে।

ইমরান এমন সময় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিলেন যখন দেশটির রিজার্ভ ৯০০ কোটি ডলারে নেমে এসেছে। এই অর্থ দিয়ে পাকিস্তান বড়জোর দুই মাসের আমদানির চাহিদা মেটাতে পারবে। নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছে, দেশটির আমদানি-রপ্তানির পার্থক্য দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৮০০ কোটি ডলারে। পাকিস্তানের ইংরেজি দৈনিক ডন-এর অনলাইনে এক প্রতিবেদন বলা হয়েছে, পাকিস্তানের একটি শিশু দেড় লাখ রুপি বৈদেশিক ঋণ মাথায় নিয়ে জন্মায়। এমন পরিস্থিতিতে ইমরানের বৈদেশিক ঋণের জন্য অন্যের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া উপায় নেই। নির্বাচনী ইশতেহারে ইমরান পাকিস্তানকে ‘ইসলামভিত্তিক কল্যাণ রাষ্ট্র’ গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, যার মাধ্যমে দেশে দারিদ্র্য দূর হবে। ইমরানের স্ত্রী বুশরা শপথ অনুষ্ঠানে বার্তা সংস্থা এএফপিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আবারও ইসলামভিত্তিক কল্যাণ রাষ্ট্রের কথাই বললেন। বুশরা বলেন, তাঁর প্রত্যাশা ইমরানের নেতৃত্বে পাকিস্তান হবে মদিনার মতো কল্যাণকর এক রাষ্ট্র। কিন্তু অর্থনৈতিক এই নাজুক পরিস্থিতি ইমরানের সেই প্রতিশ্রুতি পূরণে বাধা হয়ে দাঁড়াবে।

জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া। সমীকরণ মেলাতে চাইবেন অনেক কিছুর। ছবি: এএফপি
জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া। সমীকরণ মেলাতে চাইবেন অনেক কিছুর। ছবি: এএফপি

ক্রিকেট জীবনে ‘প্লেবয়’ ভাবমূর্তি আর পাকিস্তানকে বিশ্বকাপ জিতিয়ে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ওঠেন ইমরান। যদিও দল গঠনের পর প্রথম দিকে কঠিন বেগ পেতে হয় তাঁকে। এরপর দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করে তরুণ ও মধ্যবিত্তদের মনে জায়গা করে নেন তিনি। পার্লামেন্ট সদস্য হিসেবে শপথ নেওয়ার পর ইমরান তাঁর সমর্থকদের উদ্দেশে বলেন, দুর্নীতি করে কেউ পার পাবে না। আপনারা মাঠে নামুন, দাবি তুলুন—প্রত্যেক দুর্নীতিবাজকে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। ইমরান এ ক্ষেত্রে কতটা সফল হবেন, সে প্রশ্ন উঠছে। কারণ নির্বাচনের আগেই ইমরান দলে ভিড়িয়েছেন নওয়াজ শরিফের দল (পিএমএল-এন) ও বিলাওয়াল ভুট্টোর দলের (পিপিপি) অনেক নেতাকে; যাঁদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। আর ক্ষমতা পেলে নিজের নেতা-কর্মীরাই বা কতটা দুর্নীতিমুক্ত থাকবেন, তা-ও ভাবার বিষয়। নেতা-কর্মীদের কীভাবে দুর্নীতিমুক্ত রাখবেন, তার কোনো দিকনির্দেশনাও জনসমক্ষে প্রকাশ করেননি তিনি।

পাকিস্তানের অন্যতম সমস্যা সন্ত্রাসবাদ তথা জঙ্গিবাদ। এটা মোকাবিলা করতে উভয়সংকটে পড়তে হবে ইমরানকে। আন্তর্জাতিক বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি উন্নয়নের জন্য জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়তে হবে তাঁকে। এটা না করতে পারলে পশ্চিমাদের কাছে ঘেঁষতে পারবেন না তিনি। কিন্তু কট্টরপন্থী বিশেষ করে তালেবানদের প্রতি সহানুভূতিশীল ইমরান। পাকিস্তানে জঙ্গিবিরোধী মার্কিন ড্রোন হামলার কট্টর সমালোচকদের একজন। এ কারণে ইমরানকে বহির্বিশ্বে কেউ কেউ ‘তালেবান খান’ নামে ডাকেন। জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিশ্লেষক সি ক্রিস্টিন ফেয়ার নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, ‘ইমরান জঙ্গিদের বিপজ্জনকভাবে কাছে টেনেছেন। যাঁরা ইমরানকে চেনেন, তাঁরা সবাই-ই এটা জানেন।’

চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক সব সময় পাকিস্তানের জন্য স্পর্শকাতর ইস্যু। ইমরান নির্বাচনে জয়লাভের পরপর বলেছিলেন, বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে ভারত এক পা এগিয়ে এলে ইমরান দু-পা এগিয়ে যাবেন। এরপর তিনি ঘোষণা করেছিলেন, তাঁর শপথ অনুষ্ঠানে বিভিন্ন দেশের নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হবে। শোনা যাচ্ছিল, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যাবেন সেই অনুষ্ঠানে। পরে অবশ্য পিটিআই ঘোষণা দেয়, কোনো রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধানকে আমন্ত্রণ জানানো হবে না। ভারতের সাবেক ক্রিকেটার নভোজিৎ সিং সিধু অবশ্য যোগ দিয়েছিলেন সেই অনুষ্ঠানে। এটা অনেকটাই স্পষ্ট যে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক চায় না, যেটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন বর্তমানে কারাবন্দী সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ। বলা হয়ে থাকে, নওয়াজ যখন থেকে নয়াদিল্লির প্রতি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছেন, তখন থেকে সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাঁর দূরত্বের সূচনা হয়। সেনাবাহিনীর একসময়ের ‘পরম বন্ধু’ নওয়াজের পরের পরিণতি সবারই জানা।

ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীদের মূল চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দেয় সামরিক বাহিনী ও বিচার বিভাগ। ইমরানের ক্ষেত্রেও সেটা প্রযোজ্য। এখন সামরিক বাহিনীর সঙ্গে ইমরানের সম্পর্কের ‘মধুরতম পর্যায়’ চলছে। নির্বাচনে সামরিক বাহিনীর আশীর্বাদ পাওয়া ইমরানকে দিয়ে শিগগিরই হয়তো নিজেদের সমীকরণ মেলানোর ছক কষতে নামবেন জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া। কিন্তু রাজনীতিক হিসেবে ইমরান চাইবেন জনগণকে দেওয়া তাঁর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে। তখনই ঘটবে বিপত্তি। ইমরানকে চাপে ফেলতে প্রয়োজনে ব্যবহার করা হবে বিচার বিভাগকে। তাই ব্যতিক্রম কিছু না ঘটলে হয়তো ইমরানকেও মেনে নিতে হবে পূর্বসূরিদের পরিণতি। পাকিস্তানের ইতিহাস মেনে প্রধানমন্ত্রীর পদ ‘ফুটন্ত কড়াই’ থেকে ছিটকে পড়তে হবে ইমরানকেও!

মাহফুজার রহমান: সাংবাদিক
[email protected]