কফি আনানের মৃত্যু

মৃদুভাষী ও সম্ভ্রান্ত হিসেবে সুপরিচিত বিশ্বের নক্ষত্রসম কূটনীতিক কফি আনানের জীবনাবসানে আমরা শোকাহত। গণহত্যা, যুদ্ধ ও ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যেও তিনি বিশ্বকে এক অবিস্মরণীয় ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্ব উপহার দিতে পেরেছিলেন। তাঁর বর্ণাঢ্য ও চ্যালেঞ্জপূর্ণ কর্মজীবন তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে উল্লেখযোগ্যভাবে বিবেক ও মানবতাবাদের সপক্ষে এক হিরণ্ময় কণ্ঠস্বরে পরিণত করেছিল। রুয়ান্ডা ও বসনিয়ায় গণহত্যা সংঘটনকালে তিনি জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনীর প্রধান ছিলেন। এ সময় শতচেষ্টা সত্ত্বেও কার্যকর ভূমিকা রাখতে না পারার জন্য তিনি তাঁর আত্মপীড়ন লুকাননি। জাতিসংঘের মহাসচিব হিসেবে তিনি ইরাক যুদ্ধ থামাতে পারেননি, কিন্তু আমেরিকাকে রুষ্ট করে তিনি ঠিকই একে ‘অবৈধ যুদ্ধ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন।

তিনি চেতনা ও দর্শনগতভাবে আন্তর্জাতিকতাবাদী, যিনি তাঁর জীবনকে একটি শান্তিপূর্ণ বিশ্ব গঠনে উৎসর্গ করেছেন। শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী এই রাষ্ট্রনায়কের জীবনের গোড়াতেই একটি মন্ত্র তাঁকে উজ্জীবিত করে যে, ‘দুর্ভোগ অত্র (একটি স্থানে), উদ্বেগ সর্বত্র’। সুতরাং মানবতার জয়গান গাইতে গিয়ে তিনি কোনো নির্দিষ্ট সীমান্ত দ্বারা কখনো নিজেকে চালিত করেননি। তবে জাতিসংঘের ইতিহাসের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ মহাসচিব হিসেবে আনান নিশ্চয় ‘দস্যু-পায়ের কাঁটা-মারা জুতোর তলায়’ থাকা আফ্রিকার উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন।

শান্তি, টেকসই উন্নয়ন, মানবাধিকার ও আইনের শাসনের চেতনার সলতেয় তিনি সতত আগুন জ্বেলেছেন। আর্তমানবতার প্রতি তাঁর যে নাড়ির টান ও আমৃত্যু অগ্রাধিকার, তা–ই তাঁকে মহিমান্বিত করে রাখবে। নেলসন ম্যান্ডেলা প্রতিষ্ঠিত দ্য এল্ডার্স এবং কফি আনান ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি শান্তির অন্বেষায় ক্লান্তিহীনভাবে বিশ্বময় চষে বেড়িয়েছেন। আনান তাঁর আশিতম জন্মদিনে রসিকতা করে বলেছিলেন, তিনি আবিষ্কার করেছেন যে, অবসর বড় কঠিন শ্রমসাধ্য।

বাংলাদেশের মানুষ তাঁকে আপনজন হিসেবেই বরণ করে নিয়েছিল। তাঁর মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ প্রধান দলগুলোর নেতাদের দেওয়া শোকবার্তাগুলোতে তাঁর প্রতি জনগণের ভালোবাসার প্রতিফলন ঘটেছে। ২০০১ সালে জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত জাতিসংঘ রিপোর্ট প্রকাশের পরপরই বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন কফি আনান। বাংলাদেশ যে সব থেকে ভঙ্গুর অবস্থায় আছে, তখনই তার উল্লেখ করে তিনি বিশ্বকে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন। রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে আনান কমিশনের সুপারিশ সার্বিক বিচারে বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে সমাদৃত হয়েছে।    

প্রথম আলো পরিবারের পক্ষ থেকে আমরা তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি। আমরা তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবার ও নিকটজনদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। আগামী নভেম্বরে আমাদের পত্রিকার ২০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে আমরা কফি আনানকে একজন বিশেষ অতিথি হিসেবে আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছিলাম। আমাদের সে আশা অপূর্ণই থাকল।

বিশ্বময় শান্তিকামীদের সঙ্গে আমরাও উচ্চারণ করি: আপনি শান্তির দূত ছিলেন। এবারে আপনি শান্তিতে ঘুমান।