স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের 'গণশত্রু' অভিধা

একটি অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে যুক্তরাষ্ট্রে। ১৬ আগস্ট বৃহস্পতিবার এ দেশের প্রায় সাড়ে তিন শ পত্রপত্রিকা নিজেদের সম্পাদকীয় স্তম্ভে সংবাদপত্রের 

স্বাধীনতার ওপর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ক্রমাগত আক্রমণের বিরুদ্ধে একযোগে প্রতিবাদ জানিয়েছে। তাদের প্রতিটির বক্তব্য, গণতন্ত্রের জন্য সংবাদপত্রের স্বাধীনতা অপরিহার্য।

ক্ষমতা গ্রহণের আগে থেকেই ট্রাম্প তাঁর যেকোনো সমালোচনাকে ‘ফেইক নিউজ’ দাবি করে সংবাদপত্র ও টিভির ওপর ঢালাও আক্রমণ করে আসছেন। সিএনএন বা নিউইয়র্ক টাইমস-এর মতো সংবাদমাধ্যমকে তিনি ‘এনিমি অব দ্য পিপল’ বা গণশত্রু নামে অভিহিত করেছেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক সভায় তাঁর সমর্থকেরা প্রকাশ্যে এই সব সংস্থার সংবাদকর্মীদের বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়েছেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে হাতাহাতিও করেছেন। সংবাদকর্মীদের দিকে আঙুল তুলে ট্রাম্প নিজেও সেই কাজে সমর্থন জুগিয়েছেন।

সংবাদমাধ্যমের ওপর মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই অব্যাহত আক্রমণ গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর-এই যুক্তিতে সম্মিলিত প্রতিবাদের প্রস্তাবটি করে বোস্টন গ্লোব পত্রিকা। পত্রিকাটির বক্তব্য ছিল, আজকের আমেরিকায় এমন একজন প্রেসিডেন্ট ক্ষমতাসীন, যিনি প্রতিনিয়ত সংবাদপত্রকে গণশত্রু নামে অভিহিত করে যাচ্ছেন। তাঁর কাজ বা কথাকে যারা সমর্থন করে না, তারাই তাঁর কাছে ‘গণশত্রু’। এর প্রতিবাদ হওয়া উচিত। কারণ সংবাদপত্র জনগণের শত্রু নয়।

যে সাড়ে তিন শ পত্রিকা এই প্রতিবাদে অংশ নেয়, তারা কেউ এ কথা বলেনি যে সংবাদপত্র কখনো ভুল সংবাদ পরিবেশন করে না। নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছে, আমরা সাংবাদিকেরা মানুষ, ভুল আমরাও করি। কিন্তু সে ভুল ধরিয়ে দিলে তা আমরা শুধরেও নিই। তাই বলে সরকারের সব সমালোচনাকে ঢালাওভাবে ‘ফেইক নিউজ’ বলে অহোরাত্র চিৎকার করা হবে, আর আমরা তা মেনে নেব, সেটি গণতন্ত্রের জন্য বিপজ্জনক।

সোভিয়েত আমলে অথবা সাম্প্রতিক সময়ে চীন, রাশিয়া ও তুরস্ক-যেখানেই কর্তৃত্ববাদী কোনো নেতা ক্ষমতায় এসেছেন, সেখানেই সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর আঘাত নেমে এসেছে। এ ব্যাপারে অন্য সবার চেয়ে এগিয়ে আছে পুতিনের রাশিয়া। সেখানে সবচেয়ে উচ্চকণ্ঠ যেসব সাংবাদিক, তাঁদের জন্য অঘোষিত শাস্তি হলো মৃত্যু। সরকারের ভেতর দুর্নীতির খবর প্রকাশ করেছেন একের পর এক এমন সাংবাদিকের মৃত্যু হয়েছে, অথচ কোনো একজন অপরাধীকেও খুঁজে পাওয়া যায়নি। একজন মারা গেছেন ৫ তলার জানালা গলে, আরেক জন ১৪ তলা থেকে পা হড়কে। পুলিশ বলে আত্মহত্যা, সহকর্মীদের বক্তব্য খুন।

পৃথিবীর সব দেশেই, তা রাশিয়ার মতো বৃহৎ দেশ হোক অথবা বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র-প্রতিটি সরকারই চায় নিজেদের ব্যর্থতার ও দুর্নীতির খবর লুকিয়ে রাখতে। আমেরিকা, যেখানে সংবাদপত্র বরাবরই স্বাধীনভাবে কাজ করেছে, সেখানেও ক্ষমতাধরেরা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ঠেকানোর চেষ্টা করেছেন। ট্রাম্পের বক্তব্যের প্রতিবাদে নিউইয়র্ক টাইমস যে সম্পাদকীয়টি লিখেছে, তাতে টমাস জেফারসনকে নিয়ে একটি গল্প বলা হয়েছে। মার্কিন শাসনতন্ত্র রচনায় তাঁর অবদান সুবিদিত। ১৭৮৭ সালে তিনি এক বন্ধুকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন, আমাকে যদি সংবাদপত্রবিহীন সরকার ও সরকারবিহীন সংবাদপত্র-এই দুইয়ের মধ্যে বেছে নিতে বলা হয়, তাহলে আমি সংবাদপত্রকেই বেছে নেব। কিন্তু প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর সেই জেফারসনের সুর বদলে গেল। তখন তিনি বললেন, পত্রিকায় যা পড়ি, তার কোনো কিছুই বিশ্বাস করা যায় না। সেখানে ছাপা হওয়ামাত্রই সত্য আর সত্য থাকে না।

ক্ষমতাধরেরা যে সংবাদপত্রের অবাধ স্বাধীনতার বিরোধিতা করেন, তার কারণটা খুব সরল। তাঁরা সত্যকে ভয় পান। উদাহরণ হিসেবে ট্রাম্পের কথা ভাবুন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার দিন থেকেই এই লোকটা সমানে মিথ্যা বলে চলেছেন। শপথ গ্রহণের পর তিনি দাবি করেছিলেন, আমেরিকার ইতিহাসে এত লোক কোনো শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে আসেনি। বারাক ওবামার শপথ অনুষ্ঠানে তো নয়ই। কথাটা মিথ্যা, ট্রাম্পের তুলনায় ওবামার শপথে প্রায় দ্বিগুণ লোক এসেছিল। এ কথাটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে কে? সিএনএন থেকে শুরু করে টাইমস ও পোস্ট-এর মতো পত্রিকায় দুই অনুষ্ঠানের ছবি পাশাপাশি রেখে সেই সত্যটা প্রতিষ্ঠিত করা হলো।

বলাই বাহুল্য, ট্রাম্পের মতো আত্মম্ভর মানুষ, তাঁকে এভাবে মিথ্যুক প্রমাণিত করায় খুশি হননি। তখন থেকেই তাঁর প্রিয় কৌশল হলো, যারাই তাঁর সমালোচনা করবে অথবা সত্য ফাঁস করবে, তারাই ‘ফেইক নিউজ’। সর্বক্ষমতাধর এই প্রেসিডেন্টের অহর্নিশ ক্রোধাগ্নি বর্ষণ সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদপত্র তাদের দায়িত্ব পালনে ভীত হয়নি। যেমন ওয়াশিংটন পোস্ট এক ডেটাবেস তৈরি করেছে, যেখানে ট্রাম্পের বলা প্রতিটি মিথ্যা অথবা আংশিক সত্যের বিবরণ ক্রমানুসারে ধরে রাখা আছে। এই ডেটাবেস অনুসারে গত ৫৫৮ দিনে ট্রাম্পের বলা মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর কথার সংখ্যা ৪ হাজার ২১৯। অবাক কী যে সম্ভব হলে ট্রাম্প আজই ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতেন!

চাইলেও আমেরিকার প্রেসিডেন্ট সে কাজটি করতে পারেন না। কারণ তাঁকে কংগ্রেস সামলাতে হয়, আদালতের সমন সহ্য করতে হয়। কিন্তু তুরস্কের এরদোয়ান বা ফিলিপাইনের দুতার্তের সেই সমস্যা নেই। পছন্দ না হলে তাঁরা যখন-তখন পত্রিকা বা ওয়েবসাইট বন্ধ করে দিতে পারেন। টুইটার বা ফেসবুক থামিয়ে দিতে পারেন। তাঁদের কাছে ট্রাম্প একজন ‘রোল মডেল’। গত বছর ট্রাম্প ম্যানিলা গিয়েছিলেন। সেখানে প্রেসিডেন্ট দুতার্তের সঙ্গে এক সংবাদ সম্মেলনে তাঁকে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, ফিলিপাইনে মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়ে প্রেসিডেন্ট দুতার্তেকে তিনি কিছু বলেছেন কি না। প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই দুতার্তে সেই সাংবাদিককে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘তুমি থামো, যত্তসব বিদেশি চর।’ ট্রাম্প তাঁর সে কথা শুনে হেসেছিলেন।

কিন্তু ব্যাপারটা মোটেই হাসির নয়। মার্কিন সিনেটর ম্যাককেইন বলেছেন, একনায়কতন্ত্রের শুরু হয় সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রুদ্ধ করে। তিনি ট্রাম্পের নাম উচ্চারণ না করেই এ কথা বলেছেন। কিন্তু ট্রাম্পের নিজের দলের আরেক নেতা, সিনেটর জেফ ফ্লেক তাঁর নাম নিয়েই বলেছেন, সত্যের ওপর, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর ট্রাম্পের ক্রমাগত আক্রমণ জোসেফ স্তালিনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। স্তালিনই সংবাদপত্রকে ‘গণশত্রু’ নামে অভিহিত করেছিলেন। ফ্লেক মনে করিয়ে দিয়েছেন, দেশের প্রেসিডেন্ট যখন একনায়কসুলভ ব্যবহার করেন, তখন গণতন্ত্রের স্বার্থে উচিত তার প্রতিবাদ করা। এই কাজটা সংবাদপত্র নিজেরা একা করতে পারে না, তাদের মিত্রের প্রয়োজন আছে। আমরা, অর্থাৎ কংগ্রেস, সেই মিত্রের ভূমিকা পালন করতে পারি।

আমেরিকায় কংগ্রেস বা আদালত সংবাদপত্রের মিত্রের ভূমিকা পালনে সক্ষম। দেশের শাসনতন্ত্রও তাদের মিত্র, কিন্তু বাংলাদেশে কে হবে সংবাদপত্রের মিত্র?

এটা কোনো গোপন ব্যাপার নয় যে আজকের বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত হয়ে আসছে। পত্রপত্রিকায়, টিভিতে অথবা ইন্টারনেটে স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের অধিকার খর্ব করতে নতুন নতুন আইন হচ্ছে। সাংবাদিকের গায়ে লাঠির বাড়ি দেওয়া অথবা তাঁদের গারদে ঢোকানো এখন মোটেই কোনো অভাবিত ব্যাপার নয়। যেখানে পুলিশ নেই, সেখানে রাজনৈতিক কর্মীরা আছেন তাঁদের রামধোলাই দেওয়ার জন্য। এই সবের একটাই উদ্দেশ্য, ভীতি সৃষ্টি করা। কখনো কখনো এত খোলামেলাভাবে স্বাধীন মতপ্রকাশকে ঠেকানোর চেষ্টা হচ্ছে যে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক চরিত্র নিয়েই প্রশ্ন উঠছে।

চিত্রসাংবাদিক ও নাগরিক অধিকারকর্মী শহিদুল আলমের গ্রেপ্তারের ঘটনা এই বাস্তবতাকে আমাদের নতুন করে দিয়ে দেখিয়ে দিল। আল-জাজিরার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে এই খ্যাতনামা চিত্রগ্রাহক কঠোর ভাষায় সাম্প্রতিক সময়ে ছাত্রদের ওপর পুলিশি হামলার সমালোচনা করেছিলেন। ছাত্রদের বিক্ষোভ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, দেশের চলমান পরিস্থিতির সার্বিক প্রতিবাদ, এই ছিল তাঁর মূল্যায়ন। তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন, মুক্ত-স্বাধীন নির্বাচন হলে ক্ষমতাসীন দল ফের ক্ষমতায় ফিরতে পারবে না।

এর সবই তো রাজনৈতিক বক্তব্য, একজন বাংলাদেশি নাগরিক দেশের চলমান অবস্থা নিয়ে নিজের মূল্যায়ন প্রকাশ করেছেন। শুধু এ কথা বলার জন্য যদি কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়, তাহলে বাংলাদেশের সঙ্গে স্বৈরতান্ত্রিক কোনো দেশের তফাত খুঁজে পাওয়াই কঠিন হয়ে পড়বে।

হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি