এখনো খাঁড়ার ঘায়ের অপেক্ষায়

ঘোষণা দেওয়া ছিল ৮ আগস্ট সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার কমিয়ে দেওয়া হবে। এ উপলক্ষে সেদিন একটি সভাও ডাকা হয়েছিল। তবে সভা শেষে বলা হয়, এ নিয়ে একটি কমিটি হয়েছে। তারা রিপোর্ট দেবে। আর সে রিপোর্টের ভিত্তিতে আগামী জাতীয় নির্বাচনের পর সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার কমিয়ে দেওয়া হবে। কয়েক লাখ লোকের জীবিকার অবলম্বন বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়পত্র। কোনোটি মাসিক আর গোটা দুই ত্রৈমাসিক মুনাফা দেয়। ৫ বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্র আগে ভাঙিয়ে না ফেললে মেয়াদান্তে মেলে মুনাফা। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের যেকোনো শাখায় কৌতূহল নিয়ে কেউ কোনো দিন গেলে দেখবেন কতশত লোক বসে বা দাঁড়িয়ে আছেন লাইন ধরে। আর তাঁদের প্রায় সবাই বৃদ্ধ, অনেকেই অন্যের সহায়তা নিয়ে লাইন ধরেছেন। এসব সঞ্চয়পত্রে মুনাফার হার ব্যাংকের স্থায়ী আমানতের চেয়ে বেশি। আরও বেশি ছিল। কয়েক বছর আগে ২ শতাংশ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন সঞ্চয়পত্রগুলোর মুনাফার হার মোটামুটি ১১ শতাংশের কিছু ওপরে। তবে ৫ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রের এ হার ১০ শতাংশের কিছু ওপরে। তাই এসব সঞ্চয়পত্রও বিনিয়োগের বিবেচনায় আকর্ষণীয়। ফলে গ্রাহক বাড়ছে। এর মাঝে ব্যাংকগুলো তাদের ঋণের সুদের হার এক অঙ্কে নামিয়ে আনতে স্থায়ী আমানতের মুনাফার ঊর্ধ্ব হার নির্ধারণ করেছে ৬ শতাংশে। দেশে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য ব্যবসায়ী–শিল্পপতিরা যত কম সুদে ঋণ পাবেন, তত কমবে তাঁদের ব্যয়। আর এটা করতে গিয়ে ব্যাংকগুলো, বিশেষ করে বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে সরকার প্রভূত সুবিধা দিয়ে চলছে। এসব ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালকেরা এক পরিবার থেকে থাকতে পারবেন চারজন। আর একনাগাড়ে ৯ বছর। ব্যাংকের ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও এবং আয়করের হারও কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। তদুপরি সরকারি আমানতের অর্ধেক পরিমাণ টাকা সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ সুদে বেসরকারি ব্যাংকে রাখা একরূপ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এর ফলে ওই ব্যাংকগুলোর আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য বাড়ার কথা। কমার কথা তাদের কস্ট অব ফান্ড। ফলে কম সুদে অধিক পরিমাণ ঋণ দেওয়ার সামর্থ্য তাদের এমনিতেই হওয়ার কথা।

তাতেও হচ্ছে না। বলা হচ্ছে, সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ব্যাংক থেকে বেশি হওয়ায় সেখানে চলে যাচ্ছে সব আমানত। এ মুনাফার হার বরাবরই ব্যাংক থেকে বেশি ছিল। এক বছর আগেও বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে ছিল না কোনো তারল্যসংকট। বরং তারা অলস টাকার ওপর বসে আছে—এমনটাই জানা যেত। এখনো রাষ্ট্রমালিকানাধীন বৃহৎ ব্যাংকগুলোতে কোনো তারল্যসংকট নেই। প্রকৃতপক্ষে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর কয়েকটি কিছু আস্থার সংকট সৃষ্টি করায় তারল্য পরিস্থিতি এমনটা হয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন। তদুপরি তাদের কোনো কোনোটি আমানতের সঙ্গে সামঞ্জস্য না রেখে ঋণ দিয়েছে। বলা হয়, সরকারি ব্যাংকগুলোতে রাজস্ব থেকে মূলধন জোগান দেওয়া হচ্ছে। আয়কর রেয়াত দিয়ে বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে পরোক্ষভাবে তা–ই করা হবে। তদুপরি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলো হাজার হাজার কোটি টাকা প্রতিযোগিতামূলক মুনাফায় আমানত রাখত। এখন মুনাফার সর্বোচ্চ সীমা বেঁধে দিয়ে অর্ধেক পরিমাণ বেসরকারি ব্যাংকে রাখা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এতে এসব সংস্থার আয় কমে যাবে। সংস্থাগুলোর ব্যবস্থাপনার সুবিধার্থে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হলেও প্রকৃতপক্ষে সরকারই মালিক। অর্থাৎ এভাবেও বেশ কিছু সরকারি টাকা বেসরকারি ব্যাংকে চলে গেল। বিনিয়োগকারীরা এর সুফল কতটা পাবে, তা ভবিষ্যৎ বলবে।

সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার নিয়ে বিভিন্ন অর্থনৈতিক বিশ্লেষণও হয়। এটা সরকারি ঋণের বোঝা বৃদ্ধি করে, এ কথা অনস্বীকার্য। বাড়ে সরকারের দায়। তবে সরকার সে ঋণের টাকা তো জনকল্যাণেই ব্যয় করে। সঞ্চয়পত্রের খাত থেকে না নিয়ে ব্যাংক থেকে এত টাকা নিলে এগুলোর তারল্যসংকট আরও বৃদ্ধি পাবে। এটা অবশ্য অর্থনীতিবিদেরা ভালো বলতে পারবেন। তবে ৮ আগস্টের সভা শেষে স্বয়ং অর্থমন্ত্রী বলেছেন সঞ্চয়পত্র একটি সামাজিক নিরাপত্তাবলয়ের মতো কাজ করে। তাহলে সরকারের ওই অতিরিক্ত ব্যয়টিকে সামাজিক খাতে বিনিয়োগ বলেই ধরে নেওয়া যায়। সঞ্চয়পত্র নিয়ে এত কিছু বলা বা লেখার প্রয়োজন হতো না, যদি আমানতকারীদের বিনিয়োগের ভিন্ন ভালো উৎস থাকত। ব্যাংকে সর্বোচ্চ মুনাফা ৬ শতাংশ। তার মধ্যে আয়করসহ অনেক চার্জ কাটা হয়। নিট মুনাফা ৫ শতাংশের কিছু ওপরে থাকে। আর মুদ্রাস্ফীতিও সে পরিমাণই। শেয়ারবাজার! সেখানে ২০১০-এ যে ধ্বংসযজ্ঞ চলে এরপর আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। শিগগির পারবে—এমনটাও মনে হয় না। সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকারীদের অনেকেই একসময় শেয়ারবাজারে ছিলেন। কেউ সর্বস্বান্ত হয়েছেন। আর কেউবা তা হওয়ার পথে পাততাড়ি গুটিয়েছেন। সরকার পদক্ষেপ নিলে এটা এত দিনে একটা ভিতের ওপর দাঁড়াতে পারত। কিন্তু এর ভাগ্য ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বাজার অর্থনীতির ওপর। আর এ বাজার অর্থনীতি ব্যাংকের আমানত ও ঋণের সুদহার নির্ধারণ করার কথা, তার দায়িত্ব নিয়েছে সরকার।

বিনিয়োগ আমাদের অর্থনীতির জন্য অপরিহার্য। এর নিয়মিত জোগান নিশ্চিত হওয়া আবশ্যক। আর যতটা সুলভ হয় ততই শিল্প–বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে। বিনিয়োগ আসে উদ্যোক্তাদের নিজের টাকা ছাড়াও ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও পুঁজিবাজার থেকে। তারা দিয়েও চলছে। তবে এবারের তারল্যসংকট কোথাও যেন একটা চক্রের অংশ হয়ে পড়েছে। বেসরকারি কিছু ব্যাংকের ওপর আস্থার সংকটের পাশাপাশি ঋণ ফেরতে অনীহার বিষয়টিও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। খেলাপিদের আইনের আওতায়ও আনা যাচ্ছে না বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতার জন্য। তদুপরি বিদেশে মূলধন পাচারের অভিযোগও প্রায়ই শোনা যায়। পানামা পেপারসে বাংলাদেশি যাঁদের নাম আছে, তাঁদের সবার বিষয়ে দুদক তদন্ত করেছে কি না, তা অস্পষ্ট। খেলাপি ঋণ সংস্কৃতি তারল্যসংকটের বিপর্যয়কর পরিস্থিতির জন্য বড় ধরনের ভূমিকা রয়েছে। সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে অনেকগুলো হিসাব ‘কসমেটিক সার্জারি’ করে দেখানো হচ্ছে। বিশাল অঙ্কের ঋণ পুনঃ তফসিল বা সুদীর্ঘ মেয়াদে নিয়মিত দেখানো হয়। কখনো বা চলে যায়। সত্যিকার অর্থে ব্যাংক খাত থেকে বের হয়ে যাওয়া এসব টাকার কিস্তি নিয়মিত না আসায় সংকটটি ঘনীভূত করে চলছে। আর এর দায়ভার চাপানো হচ্ছে এদিক-সেদিক। এখন সরকারি আমানত বা কখনো সঞ্চয়পত্রের টাকাগুলো এভাবে নিতে পারলে ষোলোকলা পূর্ণ হবে। আমাদের সৌভাগ্য পড়তে পড়তেও খাঁড়ার ঘা এ যাত্রায় পড়েনি। তবে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার নির্বাচনের পরপরই বেশ কমানো হবে—এমনটাই বোঝা যাচ্ছে অর্থমন্ত্রীর কথা শুনে। ব্যাংকের হার থেকে ১-২ শতাংশ বেশি রেখে পুনর্নির্ধারণ করা হবে এ হার। একদিকে তিনি বলছেন এটা একটা সামাজিক নিরাপত্তাবলয়। অন্যদিকে তাঁর ইঙ্গিত এর সুফল অনেক কমিয়ে আনা। তিনি অবশ্য বলেছেন, আগামী জানুয়ারির মধ্যে গোটা ব্যবস্থাটি ডিজিটাল হয়ে যাবে। এটা খুবই জরুরি। আর তাহলেই হবে না।

সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকৃত বড় অঙ্কের টাকার উৎস খতিয়ে দেখার ব্যবস্থাও নিতে হবে। বাড়ি করার জন্য সরকারের ভর্তুকি দেওয়া সুদে ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে সঞ্চয়পত্রে চলে যায় কি না, সেদিকে নজর রাখুন। খোঁজ নিন বিনা সুদে দেওয়া গাড়ি কেনার টাকাও কিছু গেছে কি না। কথাটা আন্দাজে বলছি না। ব্যাংকগুলো অনেক আগে থেকেই কম সুদে বাড়ি করার টাকা দিয়ে আসছিল। এর একটি অংশের এরূপ অপব্যবহার নিয়ে কিছু অভিযোগ আছে। দেশে ধনিকশ্রেণির একটি অংশও নামে-বেনামে ৫ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রে বেশি টাকা নিরাপত্তা বিনিয়োগের জন্য রাখতে পারে। তাই এর ঊর্ধ্বসীমা ও টাকার উৎস যাচাই অনিয়ম রোধে সহায়ক হবে। তবে ঘরভাড়া, ওষুধপথ্য বা খাবার জোগানোর ব্যবস্থার জন্য যে পেনশন সঞ্চয়পত্র, পরিবার সঞ্চয়পত্র ও ৩ মাস মেয়াদি সঞ্চয়পত্র, সেখানে আমানতকারীদের অনিয়মের সুযোগ খুব কম। প্রকৃত
পক্ষেই এটা একটি সামাজিক নিরাপত্তাবলয়। এর মুনাফার হারের ওপর দয়া করে হাত দেবেন না। অনেকের জীবিকার উৎস এ টাকাটাই।

আলী ইমাম মজুমদার সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব