বিএনপিকে দায় নিতেই হবে

গ্রেনেড হামলার আগমুহূর্তে সমাবেশে ভাষণ দিচ্ছিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা  l ফাইল ছবি
গ্রেনেড হামলার আগমুহূর্তে সমাবেশে ভাষণ দিচ্ছিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা l ফাইল ছবি

কবি টি এস এলিয়ট লিখেছিলেন, এপ্রিল নিষ্ঠুর মাস। কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসে আগস্টই নিষ্ঠুরতম মাস। ট্র্যাজেডির মাস। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালিয়ে দুর্বৃত্তরা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে শেষ করে দেওয়ার চেষ্টা চালায়।

দুই হামলার মধ্যে কি কোনো যোগসূত্র আছে? যদি আমরা হত্যাকারীদের উদ্দেশ্য ও হত্যার কারণ বিশ্লেষণ করি, যোগসূত্র পাওয়া যাবে। দুটি হত্যাকাণ্ডের টার্গেট ছিল আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব। যারা হত্যা, ষড়যন্ত্র ও বলপ্রয়োগের মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শেষ করে দিতে চায়, তারাই এ ঘটনা ঘটিয়েছে।

২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে হরকাতুল জিহাদের জঙ্গিরা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী) শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। সেদিন তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেও ২২ জন নেতা-কর্মীকে জীবন দিতে হয়। এখনো শরীরে স্প্লিন্টার নিয়ে আহত অনেকে দুঃসহ যন্ত্রণা ভোগ করছেন। অনেকে পঙ্গু হয়ে গেছেন। এর আগে ও পরে এই জঙ্গিগোষ্ঠী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের নেতাদের ওপর
অনেকবার হামলা চালিয়েছে। শাহ এম এস কিবরিয়াকে হত্যা করেছে।

২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা যখন ঘটে, তখন বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ক্ষমতায়। খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাঁরই দায়িত্বে ছিল। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ছিলেন লুৎফুজ্জামান বাবর। তারেক রহমান দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব। দল ও সরকারে তাঁর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ছিল। বিএনপির নেতাদের দাবি, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলায় তারেক রহমানসহ দলের নেতাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে জড়ানো হয়েছে। তাঁদের এই বক্তব্যের সত্যাসত্য আদালত বিচার করবেন।

কিন্তু বিএনপির নেতাদের কাছে সরাসরি একটি প্রশ্ন রাখতে চাই। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা ও হত্যাকাণ্ডের পরও বিএনপি দুই বছর তিন মাস ক্ষমতায় ছিল। তারা কেন বিচার করল না? বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতার কথা আমরা জানি। কিন্তু মামলার একটি সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্তকাজ শেষ করার জন্য দুই বছর তিন মাস কম সময় নয়।

বিএনপি মামলার সুষ্ঠু তদন্ত তো করেইনি, বরং সেই তদন্তে এফবিআই ও ইন্টারপোল থেকে যে প্রতিনিধিদল এসেছিল, তারাও সহযোগিতা না পেয়ে তদন্তকাজ শেষ না করে দেশে ফিরে গিয়েছিল।

২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনাটি শুধু দেশের ভেতরে নয়, বহির্বিশ্বেও বিরাট চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল। বিদেশি রাষ্ট্রনেতারা টেলিফোন করে, বার্তাযোগে হামলায় আক্রান্ত তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা শেখ হাসিনার প্রতি সমবেদনা জানিয়েছিলেন। তাঁরা সরকারের কাছে ন্যায়বিচার দাবি করেছিলেন। কিন্তু বিএনপি সরকার এসব কিছুই আমলে নেয়নি। তখন সরকারের রাজনৈতিক মঞ্চ, জাতীয় সংসদ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা থেকে প্রায় অভিন্ন সুরে বক্তব্য আসতে থাকল। আর সেটি হলো আওয়ামী লীগই জনগণের সহানুভূতি আদায় করতে গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে। এমনকি সে সময়ে এখানে দায়িত্ব পালনরত পাকিস্তানের হাইকমিশনারের বক্তব্যও আশ্চর্যজনকভাবে বিএনপি নেতাদের সঙ্গে মিলে গিয়েছিল।

যখন মানুষ নির্বাহী বিভাগের ওপর আস্থা হারায়, তখন সত্য উদ্‌ঘাটনে বিচার বিভাগীয় কমিশনের ওপর ভরসা রাখে। কিন্তু ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনা তদন্তে বিচারপতি জয়নাল আবেদিনের নেতৃত্বে যে এক সদস্যের কমিশন গঠন করা হয়েছিল, সেই কমিশন আরেক ধাপ এগিয়ে বলল, এই হামলার পেছনে প্রতিবেশী শক্তিশালী দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত এবং তারা ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী শীর্ষ সন্ত্রাসীদের দিয়ে এই হামলা চালিয়েছে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বিএনপি-জামায়াত সরকারকে হটিয়ে এখানে একটি পুতুল সরকার বসানো। মাননীয় বিচারক এখানেই থেমে থাকলেন না। সেই সঙ্গে তিনি এ–ও জানিয়ে দিলেন যে এই হামলার সঙ্গে বিএনপি-জামায়াত সরকার কিংবা ডিজিএফআই, এনএসআই কিংবা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কোনো সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। এটি অনেকটা ‘ঠাকুর ঘরে কে রে, আমি কলা খাই না’র মতো বয়ান।

এরপর সিআইডি যে তদন্ত রিপোর্ট দিল তাতে জজ মিয়া নামে এক তরুণ ভবঘুরেকে খুঁজে বের করা হলো। সিআইডি কর্মকর্তা তাঁকে দিয়ে বলিয়ে নিলেন, ‘....অমুকের নির্দেশে আমিই আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা করেছি।’ এর বিনিময়ে পুলিশের কর্মকর্তারা তাঁর মাকে মাসে মাসে টাকা দিতেন। তদন্তের নামে কত বড় জালিয়াতি!

২০০৫ সালের ২৯ জুন প্রথম আলোই প্রথমে জজ মিয়ার মায়ের জবানিতে প্রকৃত ঘটনা ফাঁস করে দেয়। সেদিন সত্য প্রকাশের জন্য আওয়ামী লীগ প্রথম আলোকে বাহবা দিলেও আজ অনেক অপ্রিয় সত্য উচ্চারণের জন্য ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে থাকে। অন্যদিকে এখন সরকারের ব্যর্থতা-দুর্বলতার খবর প্রকাশ পেলে বিএনপি খুশি হয়। সংবাদমাধ্যমের কাজ সত্য প্রকাশ করা। সেখানে কে খুশি বা বেজার হলেন, দেখার বিষয় নয়।

বিএনপির সরকারের তদন্ত নিয়ে আরও প্রশ্ন আছে। এই ভয়াবহ হামলা ও হত্যাকাণ্ডের পরপরই সরকার সব আলামত নষ্ট করে দিল। যেকোনো মামলার তথ্য-প্রমাণের জন্য আলামত প্রয়োজন। গ্রেনেডের ঘায়ে আহত মানুষগুলো যখন কাতরাচ্ছিল, পুলিশ তাদের উদ্ধার না করে উদ্ধারে এগিয়ে আসা লোকজনের প্রতি টিয়ার গ্যাস ছোড়ে। এরপর গ্রেনেড সরবরাহকারী মাওলানা তাজউদ্দিনসহ কোনো কোনো অপরাধীকে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হলো।

বিএনপির নেতারা এখন বলছেন, জঙ্গি ভাইয়ের অপরাধের দায় আবদুস সালাম পিন্টু নেবেন কেন? কিন্তু তাঁর সরকারি বাসভবনে যখন গ্রেনেড হামলার হোতা ও পরিকল্পনাকারীরা বৈঠক করেন, তখন তিনি কীভাবে দায় এড়াবেন? একই কথা প্রযোজ্য লুৎফুজ্জামান বাবরের বেলায়ও। তিনি বিভিন্ন জঙ্গি হামলার ‘শত্রুজ’ খুঁজে বেড়ালেও এই সন্ত্রাসী হামলার হোতাদের কাউকে ধরেননি। অপরাধীদের বাঁচাতে নানা অপকৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন। সাংবাদিকেরা জজ মিয়ার কাহিনির সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি তঁাদের চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি প্রমাণ করে দেব ভারত থেকে আসা শীর্ষ সন্ত্রাসীরাই হামলা চালিয়েছে।’ খালেদা জিয়া কিংবা বাবর কেউ প্রমাণ দিতে পারেননি। বরং বিএনপি ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার আসল রহস্য বেরিয়ে আসে। প্রমাণিত হয় তারা তদন্তের নামে প্রহসন করেছিল।

বাংলাদেশের ইতিহাসে কিছু বড় ট্র্যাজেডি আছে। যেমন ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যা এবং ৩ নভেম্বরের জেল হত্যা। ৩০ মে জিয়াউর রহমান হত্যা। তেমনি ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা ও হত্যাও একটি বড় ট্র্যাজেডি। বিএনপির নেতারা মনে করেন, ৩০ মের অভ্যুত্থানের পেছনে তৎকালীন সেনাপ্রধান এরশাদের ইন্ধন ছিল। কিন্তু তারপরও এরশাদ চট্টগ্রামে সেনা বিদ্রোহ তথা জিয়া হত্যার বিচার করেছেন এবং ১৩ জন সেনা কর্মকর্তাকে ফাঁসি দিয়েছেন। বিএনপি সরকার ২১ আগস্টের ঘটনার সঙ্গে নিজদের দায় অস্বীকার করলেও তদন্তের নামে কেন জজ মিয়া কাহিনি সাজাল সেই প্রশ্ন তাদের আরও অনেক দিন তাড়া করবে।

আমরা ভুলে যাইনি যে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার নিয়েও বিএনপি অযথা কালক্ষেপণ করেছে। শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের আমলে হাইকোর্টে এই মামলার বিচার হয়েছিল। এরপর বিএনপি ক্ষমতায় এসে তাদের পাঁচ বছরে একবারও সেটি শুনানির জন্য আপিল বিভাগে তোলেনি। বিএনপি সরকারের আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমদ তাঁর বইয়ে এ নিয়ে আক্ষেপও করেছেন।

রাজনীতি এত নিষ্ঠুর হবে কেন? হত্যার বিচারের পথ রুদ্ধ করবে কেন সরকার? কেনই–বা তদন্তের নামে প্রহসন করবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা? বিচার বিভাগীয় কমিশনই বা কেন সরকার যা শুনতে চায় সেটাই প্রচার করবে, চরম অসত্য হওয়া সত্ত্বেও?

২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার বিচারের কাজ শেষ পর্যায়ে। শিগগিরই হয়তো মামলার রায় হবে। অপরাধীরা শাস্তি পাবে। কিন্তু ২১ আগস্টের হামলার দায় বিএনপি অস্বীকার করতে করতে পারবে না। এর সঙ্গে দলের যেসব নেতা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত তাঁদের বিযুক্ত করলেও এই গ্লানি তাকে বইতেই হবে।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি