যুবরাজ সালমান: শুরুটা এমন, শেষটা কী?

যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান (রয়টার্সের ফাইল ছবি)
যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান (রয়টার্সের ফাইল ছবি)

মোহাম্মদ বিন সালমান সৌদি সিংহাসনের উত্তরাধিকারী নিযুক্ত হওয়ার এক বছর পেরিয়েছে। এই সময়ের মধ্যেই তাঁর নেওয়া নানা নীতির কারণে দেশের ভেতরে ও বাইরে আলোচিত হচ্ছে তিনি। তাঁর এসব নীতি আগ্রাসী এক যুবরাজের চরিত্রকেই ফুটিয়ে তোলে। বিশেষ করে সৌদি সাম্প্রতিক পররাষ্ট্রনীতি অন্তত সেটাই বলছে।

সৌদি আরব ‘রক্ষণশীল সমাজের’ দেশ বলে পরিচিত। গত বছরে জুনে ক্রাউন প্রিন্স সালমান সিংহাসনের উত্তরাধিকারী নিযুক্ত হওয়ার পর বদলের হাওয়া বইতে শুরু করে দেশটিতে। এ সময়ে নারীরা গাড়ি চালানোর অনুমতি, ফুটবল মাঠে বসে খেলা দেখা, সরাসরি সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার অধিকার পান। শুধু তাই নয়, একজন রাজকন্যার নেতৃত্বে ফ্যাশন জগতেও পা রেখেছেন সৌদি নারীরা। যদিও অধিকারকর্মীদের বিরুদ্ধে নতুন করে দমন-পীড়ন শুরু হওয়ায় প্রকৃতপক্ষে এসব অধিকার দেওয়া হবে কি-না তা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করছেন কেউ কেউ।

সৌদি অর্থনীতিও ঢেলে সাজাচ্ছেন যুবরাজ সালমান। এ জন্য তেলভিত্তিক অর্থনীতির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে পর্যটন ও শিল্পায়নে গুরুত্ব দিয়ে নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করছেন। তবে দেশের ভেতরে সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা দিয়েছেন তিনি দুর্নীতি বিরোধী অভিযান করে। সেই অভিযানে বেশ কয়েকজন প্রিন্সসহ, কোটিপতি ব্যবসায়ী ও প্রভাবশালী কর্মকর্তাকে পাঁচ তারকা হোটেলে বন্দী করেছিলেন তিনি। এরপরে তো গুজব রটে গেল, যুবরাজ সালমানকে হত্যা করা হয়েছে। রাজপ্রাসাদে সংঘটিত এক বিদ্রোহে তিনি প্রাণ হারিয়েছেন। পরে জনসমক্ষে এসে তিনি প্রমাণ করেছেন, সেটা ছিল গুজব।

যাই হোক, এ-তো গেল সৌদি আরবের ভেতরের পরিস্থিতির কথা। এখন পররাষ্ট্রনীতির দিকে তাকানো যাক। এখানে যুবরাজ সালমান যেন আরও আগ্রাসী। শুরু কাতারে অবরোধ দিয়ে। প্রতিবেশী কাতারের বিরুদ্ধে আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা তৈরি, সন্ত্রাসবাদে উসকানি ও জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটকে (আইএস) মদদ দেওয়ার অভিযোগ আনে সৌদি আরব। পরে কাতারের ওপর অবরোধ আরোপ করে। সঙ্গে নেয় সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও মিসরকে। প্রায় এক বছর ধরে কাতারের ওপর সেই অবরোধ অব্যাহত রয়েছে।

সিংহাসনের উত্তরাধিকারী নিযুক্ত হওয়ার আগেই ২০১৫ সালে দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পান সালমান। ৩০ বছর বয়সে এই দায়িত্ব পেয়ে তিনি বিশ্বের সবচেয়ে কমবয়সী প্রতিরক্ষামন্ত্রী হয়ে যান। তাঁর সিদ্ধান্তেই মূলত ইয়েমেনে সামরিক অভিযান চালায় সৌদি আরব। সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের সেই অভিযান এখনো চলছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত ইয়েমেনে দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছে। জাতিসংঘ ইয়েমেনের পরিস্থিতিকে মানবিক বিপর্যয়কর বলে উল্লেখ করেছে। কিন্তু সৌদি জোট যুদ্ধ বন্ধ করতে অনড়। কয়েক দিন আগেও সৌদি বাহিনীর হামলায় ইয়েমেনে অন্তত ৪০ শিশু নিহত হয়েছে।

ইরানের সঙ্গে সৌদি আরবের দ্বন্দ্ব বেশ পুরোনো। যুবরাজ সালমান সেই দ্বন্দ্ব উসকে দিয়েছেন লেবাননকে কেন্দ্র করে। লেবাননের শক্তিশালী কট্টরপন্থী সংগঠন হিজবুল্লাহ। শিয়া মতাদর্শে বিশ্বাসী এই সংগঠন ইরানের কাছ থেকে সরাসরি সহায়তা পায়। গত বছরের নভেম্বরে লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরি সৌদি আরবে গিয়ে ‘প্রাণভয়ে’ প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণা দেন। কারণ হিসেবে লেবাননে হিজবুল্লাহর প্রভাব ও তাঁর জীবনাশঙ্কার কথা উল্লেখ করেন। পরে সৌদি থেকে ফ্রান্স হয়ে লেবাননে ফিরে গিয়ে সাদ হারিরি তাঁর পদত্যাগের ঘোষণা স্থগিত করেন। এখনো তিনি প্রধানমন্ত্রী পদে আছেন। বলা হয়, ইরানকে আন্তর্জাতিকভাবে বেকায়দায় ফেলতে সাদ হারিরিকে দিয়ে ফাঁদ পেতেছিল সৌদি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সফল হতে পারেনি। এ ছাড়া সিরিয়া, ইয়েমেনের ইস্যুতে সৌদি-ইরান মুখোমুখি। সিরিয়ায় ক্ষমতাসীন বাশার আল-আসাদকে হটাতে বিদ্রোহীদের সমর্থন দেয় সৌদি আরব। সেখানে বাশারের পক্ষে ইরান। আর ইয়েমেনে সৌদি জোটের বিরুদ্ধে লড়াইরত হুতি বিদ্রোহীদের ইরান সমর্থন দিচ্ছে বলে অভিযোগ। বলা হচ্ছে, বর্তমানে যে কোনো সময়ের চেয়ে ইরান-সৌদি সম্পর্ক সবচেয়ে তলানিতে।

সর্বশেষ কানাডার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে সৌদি আরব। চলতি মাসেই এ সিদ্ধান্ত নেয় রিয়াদ। অভিযোগ, কানাডার রাষ্ট্রদূত সৌদি আরবের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেছে। কানাডার রাষ্ট্রদূত ডেনিস হরাককে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দেশ ছাড়ার নির্দেশ দিয়ে নিজের রাষ্ট্রদূতকেও কানাডা থেকে প্রত্যাহার করে নেয় সৌদি। মূলত, সৌদি আরবে গ্রেপ্তার হওয়া অধিকারকর্মীদের মুক্তি দিতে আহ্বান জানিয়েছিল কানাডা। এটাকে সৌদি সরকার কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত ও অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ বলে মনে করেছে।

প্রায় নয় দশক ধরে সৌদি আরবের ক্ষমতায় রয়েছে বর্তমান রাজবংশ। দেশটির অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে যুবরাজ সালমান এরই মধ্যে যেমন আগ্রাসী নীতি নিয়েছেন, এর আগে কোনো সৌদি নেতা বোধ হয় এর কাছাকাছিও যাননি। তিনি যেভাবে এগোচ্ছেন তাতে ভবিষ্যতে তাঁর আরও নানা আগ্রাসী নীতি হয়তো দেখতে হবে বিশ্ববাসীকে এবং অবশ্যই সৌদি নাগরিকদেরও।

মাহফুজার রহমান: সাংবাদিক
[email protected]