'গণ' ছাড়া ভোট 'জন' ছাড়া আন্দোলন

নেতা–নেত্রীরা দেশবাসীকে ঈদের শুভেচ্ছা জানানোর পাশাপাশি নিজের ও দলের অবস্থান শক্ত করতে ব্যস্ত ছিলেন ঈদের ছুটিতে। অধিকাংশ নেতা-নেত্রী নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় গিয়েছেন ভোটারদের সঙ্গে মোলাকাত করতে। সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। দেড়–দুই মাসের মধ্যে তফসিল ঘোষণা হতে পারে।

পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যে নেতা যেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন, সেখান থেকে নির্বাচন করেন। আর বাংলাদেশে শতকরা ৮০ ভাগ কিংবা তারও বেশি সাংসদের বাস ঢাকায়; কিন্তু তাঁরা নির্বাচন করেন ঢাকার বাইরে, যাঁর যাঁর পৈতৃক বা বৈবাহিক সূত্রে পাওয়া ঠিকানা থেকে। মন্ত্রীদের এই হিসাব থেকে রেয়াত দেওয়া যায়, সরকারের দায়িত্ব পালন করতে তাঁদের ঢাকায়ই থাকতে হয়।

নির্বাচন আসন্ন বলে নেতা–নেত্রীদের কণ্ঠের জোর বাড়ছে। প্রথমে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বললেন, ২০১৪ সালের মতো নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করলে বিএনপিকে এবার দাঁতভাঙা জবাব দেওয়া হবে। এর মাধ্যমে তিনি নিশ্চয়ই বিএনপি নেতাদের দাঁত ভাঙার কথা বলেননি। সমুচিত জবাব দেওয়ার কথা বলেছেন।

এরপর দিনই বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ বললেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচন করতে চাইলে দুর্বার আন্দোলন হবে। বৃহস্পতিবার দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীও জানালেন, আওয়ামী লীগকে এবারে আর ফাঁকা মাঠে গোল করতে দেওয়া হবে না। ওদিকে আগামী নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি তাদের জোটের সীমা বাড়াতে চাইছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এই লক্ষ্যে দেখা করেছেন সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি আবদুল কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিকল্প ধারার সভাপতি অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীসহ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলেছেন। ইতিমধ্যে ৫৪ সালের আদলে যুক্তফ্রন্ট গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে কয়েকটি দল। আবার সিপিবি-বাসদ-জনসংহতিসহ ৬টি বাম দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে জোট গঠন করেছে।

এই যে রাজনৈতিক দলগুলো নানামুখী তৎপরতা চালাচ্ছে, সেসবই কিন্তু একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। কিন্তু নির্বাচনের মূল নিয়ামক শক্তি হলো জনগণ। তারা নির্বাচন সম্পর্কে কী ভাবছে, তা নিয়ে নেতা-নেত্রীরা আদৌ ভাবিত বলে মনে হয় না। রাজনীতিকেরা জনগণ তথা ভোটারদের নিয়ে ভাবলে হুমকি-ধমকি ও পাল্টা হুমকি দিয়ে পরিবেশকে উত্তপ্ত করতেন না।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলীয় নেতা কর্মীদের নিজ নিজ এলাকায় গিয়ে সরকারের উন্নয়নকাজ তুলে ধরার কথা বলেছেন। কিন্তু দলের নেতা-মন্ত্রীদের কথায় উন্নয়নের চেয়ে ধমকের সুরই লক্ষ করা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের কোনো নেতা আজ বিএনপিকে হুমকি দিয়ে কথা বললে পরদিন বিএনপির নেতা পাল্টা হুমকি দেবেন। ৪৭ বছর ধরেই এই হুমকি-ধমকির রাজনীতি চলছে। কেউ সরকার উৎখাত করতে চায়। কেউ উৎখাতকারীদের ধ্বংস কামনা করে। কিন্তু এতে জনগণের কোনো লাভ হয় না। পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচন যে অভিজ্ঞতা আমাদের সামনে হাজির করেছে, তাতে এ কথা জোর দিয়ে বলা যায় না, ভোটাররা নির্বিঘ্নে ও নির্ভয়ে ভোট দিতে পারবেন। প্রতিটি সিটি নির্বাচনই নতুন নতুন অভিজ্ঞতা ও ঘটনার জন্ম দেয়। খুলনার সঙ্গে যেমন গাজীপুরের মিল নেই, তেমনি বরিশাল ও সিলেটের নির্বাচন হয়েছে সম্পূর্ণ বিপরীত ধারায়। বরিশালের নির্বাচনকে মেনে নিলে সিলেটকে অস্বীকার করতে হয়। সিলেটকে সাধুবাদ জানালে বরিশালকে নিন্দা করতে হয়।

নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলই দোটানায় আছে। কেউ কেউ বলবেন, সরকারি দল দো-টানায় কেন থাকবে? ২০১৪ সালে শত অনুরোধ সত্ত্বেও বিএনপির নির্বাচনে না আসাটা আওয়ামী লীগের জন্য আশীর্বাদ হয়েছিল। এবারে তারা মনস্থির করতে পারছে না। বিএনপির নেতারা একদিকে বলছেন, খালেদা জিয়াকে জেলে রেখে তাঁরা নির্বাচনে যাবেন না। আরেক দিকে আওয়াজ তুলছেন, এবারে ফাঁকা মাঠে গোল দিতে দেবেন না। এর অর্থ হলো, বিএনপি নির্বাচনে যাবে। জাতীয় পার্টির নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও বলেছেন, বিএনপি নির্বাচনে এলে তাঁরা আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করবেন। আর না এলে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেবেন। বিএনপি জোটের শরিক জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন না থাকায় স্বনামে নির্বাচন করতে পারবে না। তবে সিলেটের মতো জামায়াতের নেতারাও স্বতন্ত্র প্রার্থী দিতে পারবেন। আর জনসমর্থন থাকলে জামায়াতের বিরোধিতা উপেক্ষা করেও যে বিএনপি জিততে পারে, সেটা সিলেটে আরিফুল হক দেখিয়ে দিয়েছেন। সমস্যা হলো, বিএনপিতে যেমন আরিফুল হক একজনই, তেমনি আওয়ামী লীগেরও দ্বিতীয় সেলিনা হায়াৎ আইভীর মতো প্রার্থী বেশি নেই।

এ কারণেই দুই দলের নেতারা কথার মারপ্যাঁচে একে অপরকে ঘায়েল করতে ব্যস্ত। প্রতিপক্ষকে গালমন্দ করেই নিজের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর চেষ্টা করছেন।

আওয়ামী লীগের দাঁত ভাঙার হুংকারের জবাবে বিএনপি দুর্বার আন্দোলন করার ঘোষণা দিচ্ছে। কিন্তু কে কাকে নিয়ে নির্বাচন বা আন্দোলন করবেন, সেটি পরিষ্কার নয়। আন্দোলন ও ভোট দুটোই করতে হয় জনগণকে নিয়ে। কিন্তু রাজনীতির অভিধান থেকেই সেই জনগণ এখন বাদ পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।

মাঝখানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সংলাপের কথা উঠেছিল। কিন্তু এখন সেই সংলাপই হুমকি–পাল্টা হুমকিতে রূপ নিয়েছে। নির্বাচন হতে আরও কয়েক মাস বাকি।
উল্লেখ্য আওয়ামী লীগের যেই নেতা বিএনপিকে দাঁতভাঙা জবাব দেওয়ার, আর বিএনপির যেই নেতা সরকারের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলার কথা বলেছেন, তাঁরা একই নির্বাচনী এলাকার। ওবায়দুল কাদের বনাম মওদুদ আহমদ। ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগাম উত্তাপটা শুরু হয়েছে সেখান থেকেই।
দেখা যাক, এর মধ্যে কোথাকার পানি কোথাও গড়ায়।

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক।