সব আন্দোলন কি সরকারবিরোধী?

দলনিরপেক্ষ ছাত্রসমাজের ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন ইদানীং দৃশ্যমান হচ্ছে
দলনিরপেক্ষ ছাত্রসমাজের ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন ইদানীং দৃশ্যমান হচ্ছে

বাংলা সিনেমার কাহিনি অনেক ক্ষেত্রেই নির্দিষ্ট একটি ছকে বাঁধা। শুরুর দিকে প্রেম থাকে। তারপর হঠাৎ উদয় হয় ভিলেনের। মারামারি-কাটাকাটি, মান-অভিমান আর রাগারাগিতে মুখ দেখাদেখি বন্ধ। তারপর একজন বিবেক এসে হাজির হন। তিনি সবাইকে মিলিয়ে দেন। সিনেমার শেষ দৃশ্য হলো সব আত্মীয়-কুটুম আর বন্ধুবান্ধব নিয়ে হাস্যোজ্জ্বল একটি গ্রুপ ছবি। একটি মধুর মিলন, মধুরেণ সমাপয়েৎ।

সম্প্রতি ছাত্রবিক্ষোভের শেষ দৃশ্যটি অনেকটাই এ রকম। যাঁরা গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, তাঁদের সবাই একে একে জামিনে ছাড়া পেলেন। শেষ কয়েকজনের মুক্তি হলো ঈদের আগের দিন। ২৯ জুলাই দুপুর সাড়ে ১২টায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী দিয়া খানম মিম এবং দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবদুল করিম রাজীব বাসচাপায় নিহত হওয়ার পর রাজপথে যে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছিল, তার আপাতপরিসমাপ্তি ঘটল। এর মধ্যে ঘটে গেছে অনেক কিছুই। রাজপথে পরিবহননৈরাজ্য আগের মতো ফিরে এলেও বদলে গেছে অনেক কিছুই। পাল্টে গেছে ছাত্রবিক্ষোভের সনাতন অনেক নিয়ম বা বৈশিষ্ট্য। ক্ষেত্রবিশেষে প্রশাসনের প্রতিক্রিয়ায়ও এসেছে পরিবর্তন।

মিম-রাজীবের অকালমৃত্যু আমাদের অনেক প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। জুলাই-আগস্টের বিক্ষোভ ছিল অনেক দিনের জমে যাওয়া ক্ষোভের বিস্ফোরণ। আপাতত এটির সমাধান হয়েছে বলে তৃপ্তির ঢেকুর তোলার কারণ নেই। গণপরিবহনব্যবস্থার আমূল সংস্কার না হওয়া পর্যন্ত এ ধরনের ঘটনা মাঝেমধ্যেই ঘটবে।

কোনো অঘটন ঘটলেই আমরা এর মধ্যে একটি ভিলেন খোঁজার চেষ্টা করি। এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। জাবালে নূর বাসের চালক কিংবা মালিক, মন্ত্রী শাজাহান খান, বিআরটিএ ইত্যাকার ব্যক্তি ও সংস্থার মধ্যে সমস্যা খোঁজার চেষ্টা হয়েছে। আসলে সমস্যা অন্য জায়গায়। পুরো ব্যবস্থাটি পচে গেছে। সংস্কারের আর জায়গা নেই। এটা বদলাতে হবে।

ঈদের আগে আটক হওয়া ছাত্ররা জামিনে মুক্ত হওয়ায় তাঁদের পরিবারে স্বস্তি ফিরে এসেছে। আমরা সবাই খুশি। কেউ কেউ বলছেন, প্রধানমন্ত্রী এ ক্ষেত্রে উদারতা দেখিয়েছেন, ছাত্রদের ব্যাপারে তিনি খুবই সহানুভূতিশীল। সবাই ছাড়া পেয়ে পরিবারের সঙ্গে ঈদের আনন্দে শরিক হতে পারছেন। এ জন্য অনেকেই প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। প্রশ্ন এখানেই।

আটক ছাত্ররা জামিনে ছাড়া পেয়েছেন—এর অর্থ হলো তাঁদের ‘অপরাধ’ জামিনযোগ্য ছিল। এটা নিতান্তই আদালতের এখতিয়ার। সরকারের নির্দেশে বা ইঙ্গিতে তাঁরা জামিন পেয়ে থাকলে বুঝতে হবে, আদালতের স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ নেই। এ নিয়ে ফেসবুকে নানা মন্তব্য দেখেছি। একটি মন্তব্যে বলা হয়েছে, ‘বিচার বিভাগ ও অ্যাটর্নি জেনারেলকে ধন্যবাদ।’ আরেকটি মন্তব্যে বলা হয়েছে, ‘সরকার চাইলে কী না হয়।’

সরকারের ইচ্ছায় ছাত্রদের জামিন হয়েছে—এটা মেনে নিলে বিচার বিভাগের ওপর আস্থা কমে যায়। সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর জামিন নির্ভর করে না—এটা মনে করলে স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, তাঁদের কেন আগেই জামিন দেওয়া হলো না। জামিনের আবেদন থাকা সত্ত্বেও আগে জামিন না পাওয়া এবং ঈদের ঠিক আগের দিন হঠাৎ জামিন পেয়ে যাওয়ায় এ সন্দেহ তৈরি হয়েছে। ‘অপরাধ’ জামিনযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও তাঁদের জামিন না দিয়ে আদালত কি ন্যায়বিচারের পরিপন্থী কাজ করেছিলেন? এখানে আমরা মডেল ও অভিনেত্রী কাজী নওশাবার উদাহরণটি টেনে আনতে পারি।

নওশাবার বিরুদ্ধে গুজব ছড়ানোর অভিযোগ ছিল। তিনি গ্রেপ্তার হন ৫ আগস্ট। ২০ আগস্ট আদালত তাঁর জামিনের আবেদন নাকচ করে দেন। কিন্তু নওশাবা ২১ আগস্ট জামিন পেয়ে যান। অভিযোগটি কী কারণে ২০ আগস্ট জামিন-অযোগ্য ছিল এবং ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তা জামিনযোগ্য হয়ে গেল, তার রহস্য ভেদ করা আমার কর্ম নয়। এখানে কি তৃতীয় পক্ষের কোনো ভূমিকা আছে?

আদালতে সরকারি কৌঁসুলি সাধারণত জামিনের বিরোধিতা করে থাকেন। প্রথমে জামিনের বিরোধিতা করা এবং পরে জামিন পাওয়ার ক্ষেত্রে আপত্তি না জানানোয় এটা মনে করা স্বাভাবিক যে আদালত সরকারের চাওয়া বা না চাওয়ার সংকেতটি বোঝেন এবং সে অনুযায়ী রায় দেন। আমাদের বিচার বিভাগ, বিশেষ করে নিম্ন আদালতের ওপর নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণ বেশ প্রবল—এ অভিযোগ বেশ পুরোনো।

সাম্প্রতিক ছাত্রবিক্ষোভের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী সম্ভবত চিত্রগ্রাহক শহিদুল আলম। আল-জাজিরায় তাঁর একটি সাক্ষাৎকার প্রচারিত হওয়ার পর ৫ আগস্ট রাতে তিনি গ্রেপ্তার হন। পরদিন তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নেওয়া হয়। আটকাবস্থায় তাঁকে নির্যাতন করা হয়েছে বলে তিনি অভিযোগ করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় মামলা হয়েছে। এই ধারা নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। এখনো হচ্ছে। তাঁর পক্ষে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন চলাকালে বিচারক একটি মন্তব্য করেছেন, ‘ভাগ্য ভালো, তিনি গুম হয়ে যাননি।’ মন্তব্যটি তাৎপর্যপূর্ণ। ৫৭ ধারায় মামলা হলেও আল-জাজিরায় তিনি যেসব কথা বলেছেন, তাতে সরকার বেশি রুষ্ট হয়েছে বলে কানাঘুষা আছে। তাঁর জামিন হয়নি।

ঘুরেফিরে একটি প্রশ্নই আসে। যিনি অভিযুক্ত, তাঁর জামিন পাওয়া কি ‘অধিকার’, না সরকারের ‘দাক্ষিণ্য’। ফেসবুকে শহিদুল আলমকে নিয়ে
নানা মন্তব্য দেখছি। অনেকেই তাঁর প্রতি সহানুভূতিশীল এবং তাঁর মুক্তি চেয়েছেন। অনেকেই তাঁর প্রতি ক্ষুব্ধ এবং তাঁর ‘উচিত বিচার’ চাইছেন। দেশের চলমান রাজনীতির বিভাজনটি এসব মন্তব্যে অত্যন্ত স্পষ্ট।

প্রসঙ্গটি শুরু করেছিলাম ছাত্রবিক্ষোভ নিয়ে। সব সরকারের আমলেই ছাত্রবিক্ষোভকে সুনজরে দেখার রেওয়াজ নেই। বিক্ষোভের রাজনৈতিকীকরণ হয় এবং আন্দোলনে ‘তৃতীয় পক্ষ’ ঢুকে যায়।

ছাত্রদের সঙ্গে প্রশাসনের আড়াআড়ি কোনো নতুন বিষয় নয়। পাকিস্তান আমলে ছাত্রসমাজই ছিল প্রকৃত অর্থে প্রধান বিরোধী দল। এ দেশে গত কয়েক দশকে ছাত্ররাজনীতি পচে গেলেও দলনিরপেক্ষ ছাত্রসমাজের ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন ইদানীং দৃশ্যমান হচ্ছে। তাদের প্রতিপক্ষ বানানো হবে ভুল। তারা আইনের শাসন চায়, চায় সংস্কার। তাদের অনেক দাবিতে ন্যায্যতা আছে। তাদের গড়ে সরকারবিরোধী অথবা রাষ্ট্রবিরোধী ভাবা ঠিক নয়। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে উদ্ধৃত করার লোভ সামলাতে পারছি না। পাকিস্তানের গণপরিষদে ১৯৫৬ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারির অধিবেশনে আলোচনাকালে একপর্যায়ে তিনি বলেছিলেন:

‘ছাত্রদের দ্বারা এমনভাবে অঙ্গীকারনামা স্বাক্ষর করানো হচ্ছে যেন পাকিস্তানের সব ছাত্রই রাষ্ট্রবিরোধী এবং কেবলমাত্র মন্ত্রী, এমসিএ এবং সরকারি দলের পার্লামেন্ট সেক্রেটারিরাই দেশপ্রেমিক।...কারও বিরুদ্ধে যদি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকে, কোর্ট আছে, বিচারব্যবস্থা আছে, তাদেরকে কোর্টে হাজির করা যেতে পারে এবং বিচারের মাধ্যমে শাস্তি প্রদান করার অধিকার সংবিধানে দেওয়া আছে। কিন্তু এই
সব কালাকানুন কেন, যাতে বলা আছে যে, রাষ্ট্রবিরোধী কাজের জন্য যে কাউকে গ্রেপ্তার করা যাবে? স্যার, এই সমস্ত কালাকানুন সাধারণত যারা দেশের জন্য কাজ করে এবং যারা পাকিস্তানের জনগণের জন্য কাজ করে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।’

দেশ এখন বঙ্গবন্ধুর সৈনিকে ভরে গেছে। কজন বঙ্গবন্ধু পাঠ করেন?

মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক
[email protected]