মানের সামঞ্জস্য নিশ্চিত করতে হবে

সম্প্রতি মন্ত্রিসভার বৈঠকে কওমি মাদ্রাসাগুলোর সর্বোচ্চ ডিগ্রি দাওরায়ে হাদিসকে ইসলামের ইতিহাস ও আরবি বিভাগের স্নাতকোত্তর পর্যায়ে স্বীকৃতি দেওয়া-সংক্রান্ত একটি খসড়া আইনের নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে দেশের সুধী সমাজের মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায়। কেউ কেউ সিদ্ধান্তটিকে ক্ষতিকারক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেছেন। তাঁরা বলছেন, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষক-ছাত্রদের সমর্থন পেতে শিক্ষাগত দিক বিবেচনা না করে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে।

অন্যদিকে কারও বক্তব্য, দীর্ঘদিন ধরে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি বিশাল অংশ এই স্বীকৃতি থেকে অন্যায্যভাবে বঞ্চিত ছিল। এখন এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা অন্যদের মতোই চাকরির উপযুক্ততা অর্জন করলেন। বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমকে মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানিয়েছেন, গত বছরের এপ্রিল মাসে শিক্ষা মন্ত্রণালয় গেজেটে প্রকাশিত একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এ স্বীকৃতি দিয়েছে। প্রস্তাবিত আইনটি পাস হলে সেই প্রজ্ঞাপনের তারিখ থেকে কার্যকর হবে; অর্থাৎ নীতিগতভাবে সরকার এ অবস্থানটিকে স্বীকার করে নিয়েছে। এখন দেওয়া হচ্ছে এর আইনি রূপ।

স্বাধীনতার আগে থেকেই এ দেশে বহুমুখী শিক্ষাব্যবস্থা ছিল। আর তার তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। ইংরেজি মাধ্যম ‘এ’ এবং ‘ও’ লেভেল, ইংরেজি মাধ্যমে সরকারি সিলেবাস, বাংলা মাধ্যমে সরকারি সিলেবাসের পাশাপাশি আলিয়া ও কওমি মাদ্রাসার শিক্ষাব্যবস্থাও আমরা লাভ করেছি উত্তরাধিকার সূত্রে; বরং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চালু নতুন আরেকটি মাত্রা সংযোজিত হয়েছে। সেগুলোর ওপরও সরকারের কার্যকর নিয়ন্ত্রণ নেই এবং অধিকাংশের শিক্ষার মান নিচু মর্মে ব্যাপকভাবে ধারণা করা হয়।

তেমনি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটি অংশ ক্ষুব্ধ ও সোচ্চার, তাঁদের ইভিনিং কোর্সের নিম্নমানের স্নাতকদের প্রসঙ্গে। অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন হতে আমরা দেখছি না। শিক্ষার মান ক্রম নিম্নমুখী বলে নিরন্তর অভিযোগ আসে। এ অবস্থায় কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ স্তর উত্তীর্ণদের বিশেষ দুটি বিভাগে স্নাতকোত্তর সমপর্যায়ে ভুক্ত ঘোষণা করলে কেউ কেউ বিচলিত ও হতাশ হতে পারেন। তবে দেখা দরকার যাঁরা স্বীকৃতি পাচ্ছেন, তাঁদের এ স্তরে ঘাটতি আছে কি না আর তা কীভাবে মিটিয়ে নেওয়া যায়।

উল্লেখ করা হয়েছে, মাদ্রাসা শিক্ষা আমাদের দেশে দুই ভাগে বিভক্ত। একটি আলিয়া মাদ্রাসা। এগুলো মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। ১৭৮০ সালে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে এর যাত্রা শুরু। তারা ইসলামি ধারা শিক্ষার পাশাপাশি ব্যবহারিক জীবনের প্রয়োজনীয় কয়েকটি বিষয়ে যেমন: ভাষা, গণিত, ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানও পড়িয়ে থাকে। বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জরিপের তথ্যানুসারে এর সংখ্যা প্রায় ১১ হাজার। ছাত্রছাত্রী ২০ লাখ। এই শিক্ষাব্যবস্থার সূচনা কিন্তু খুব গৌরবোজ্জ্বল ছিল। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, ড. কুদরাত-এ-খুদা ও সৈয়দ আমির আলীর মতো মনীষীদের শিক্ষাজীবনের সূচনা ছিল কলকাতা মাদ্রাসায়। হালের আলিয়া মাদ্রাসাগুলো থেকেও কেউ কেউ সাফল্যের শীর্ষে গেছেন। তবে অনুপাত খুব কম। জানা যায়, উপযুক্ত শিক্ষকের অভাব এর জন্য দায়ী।

ডিগ্রির সমতাকরণ যতই হোক, যেকোনো পদে আসতে হবে অন্যদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে। ঠিক একই কথা প্রযোজ্য কওমি মাদ্রাসাগুলোর ক্ষেত্রেও। এরা অনেকটা দেওবন্দ তরিকার অনুসারী। সেই দেওবন্দও একসময় অনেক প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিদের শিক্ষাঙ্গন হিসেবে পরিচিত ছিল। তবে তার অনুসারী প্রতিষ্ঠানগুলো এখন সেই ঔজ্জ্বল্য তেমন ধরে রাখতে পারছে বলে জানা যায় না। এগুলো সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়। বিশিষ্ট আলেমদের দ্বারা পরিচালিত এখনকার ছয়টি কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড। প্রস্তাবিত আইনে এসব বোর্ড একত্র করে একটি করার বিধান থাকছে।

তবে খবরের কাগজে আইনের সারসংক্ষেপ যেটুকু এসেছে তা থেকে মনে হয়, নতুন বোর্ডেও সরকারের ভূমিকা গৌণই হবে। হয়তো সিলেবাস ও পরীক্ষা নিয়ে কিছু দিকনির্দেশনা থাকতে পারে। শিক্ষা জরিপ অনুসারে এ দেশে কওমি মাদ্রাসার সংখ্যা ১৪ হাজারের কিছু বেশি। মন্ত্রিপরিষদ সচিবের প্রেস ব্রিফিং অনুসারে কওমি মাদ্রাসার ১৫ লাখ শিক্ষার্থীকে মূল ধারায় আনার সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে সরকার আইনটি করতে যাচ্ছে। এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক, ২০০৭-এর সূচনায় যে নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল তাকে সামনে রেখে ২০০৬-এর শেষে চারদলীয় জোট সরকারও এমনি একটি উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু সময়ের অভাবে প্রক্রিয়াটি শেষ করতে পারেনি।

১৫ লাখ শিক্ষার্থীকে শিক্ষাব্যবস্থার মূল ধারায় নিয়ে আসার উদ্যোগকে অযৌক্তিক বলবেন না। আর বিশেষ কোনো বিষয়ে পড়লে বা কোনোটা না পড়লে ডিগ্রির সমমান দেওয়া যাবে না—এমন কথাও নয়। গণিতের স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী ইংরেজি সাহিত্য তেমন একটা পড়েননি। হয়তোবা পড়েননি ইতিহাস, ভূগোলও। তেমনি ইংরেজি সাহিত্যের স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীদের অনেকের কাছে গণিত বিভীষিকা। ইতিহাস, ভূগোলও খুব একটা আকর্ষণীয় নয়। সংগীতেও স্নাতকোত্তর সনদ দেওয়া হয়। তবে তাদের প্রত্যেককে একটি স্তর—যেমন অষ্টম বা দশম শ্রেণি পর্যন্ত আসতে হয় একই সিলেবাসের মধ্য দিয়ে। এতে তারা ভাষা, গণিতসহ মৌলিক কিছু বিষয়ে ধারণা পেয়ে যায়। আলিয়া মাদ্রাসাতেও এ ব্যবস্থা রয়েছে। জানা যায়, কোনো কোনো কওমি মাদ্রাসায়ও ইংরেজি ও গণিত পড়ানোর ব্যবস্থা আছে। তবে এই সংখ্যা খুবই সীমিত।

ইদানীং তথ্যপ্রযুক্তি আমাদের জীবনাচারে অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে আছে। অবশ্য অনেক স্কুল, কলেজ ও আলিয়া মাদ্রাসায় এটা শেখানোর ব্যবস্থা এখনো হয়নি। তবে হতে হবে। কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদেরও এসব বিষয়ে একটি স্তর পর্যন্ত জ্ঞানার্জনের ব্যবস্থা তাদের পরিচালকেরা নিজ থেকেই করতে পারেন। সনদের সমতাকরণ চাকরির নিশ্চয়তা দেবে না। প্রতিযোগিতায় টিকতে হলে এর বিকল্প কিছু নেই, এটা নিশ্চয়ই তাঁরা অনুধাবন করেন। তাঁরা বিজ্ঞ ও অভিজ্ঞ। সমাজে সম্মানিত অবস্থানে আছেন। তাঁরা কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ জীবন চলার পথকে সহজ করতে ডিগ্রির সমতাকরণের দাবি জানিয়ে আসছেন দীর্ঘকাল। সরকার তা মেনেও নিয়েছে। তবে সে সমতাকরণই একমাত্র সমাধান নয়, এটা সবাই বুঝতে পারেন।

বাংলাদেশের শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ ইসলাম ধর্মাবলম্বী। জন্ম থেকে মৃত্যু, বিবাহ—সব ক্ষেত্রেই তাদের প্রয়োজন আলেমদের। তাঁদের প্রতি সবাই যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল। সেই আলেমদের ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত হতেই হবে। কোরআন, হাদিস, ফিকহসহ এসব বিষয়েই তাঁদের পারদর্শী হতে হয়। এ নিয়ে কেউ জীবনাবধি গবেষণাও করেন। তবে মাদ্রাসায় যাঁরা পড়েন, তাঁদের সবারই পেশা হিসেবে ইমাম, মুয়াজ্জিন, মাদ্রাসার শিক্ষক বা স্কুলের ধর্ম শিক্ষক হতে হবে—এমন কোনো কথা নেই। আলিয়া মাদ্রাসার ছাত্রদের জন্য পথ খোলা আছে। কওমি মাদ্রাসার জন্যও খোলার ব্যবস্থা হচ্ছে। তবে সে পথে চলার পাথেয় তাদের সংগ্রহ করে আনতে হবে শিক্ষাঙ্গন থেকেই। আর দাবিটির নেতৃত্ব যাঁরা দিচ্ছেন, তাঁদের তা উপলব্ধি করার মতো বিচক্ষণতাও রয়েছে। আমাদের দেশের শিক্ষার মান ক্রম নিম্নমুখী বলে যে অভিযোগ রয়েছে, তা প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে স্নাতক, স্নাতকোত্তর সর্বত্র। আলিয়া মাদ্রাসাগুলোও এখন খুব ভালো অবস্থানে নেই।

উল্লেখ্য, তাদের পেছনেও সরকার বহু টাকা ব্যয় করে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায়গুলোই তাদের মর্জিমাফিক ডিগ্রি দেয়। আমরা চাই কওমি মাদ্রাসার ছাত্ররাও আসুক মূল ধারায়। চাই তারা আসবে অন্যদের চেয়ে নিজ নিজ বিষয়ে অধিক যোগ্যতা নিয়ে। এরা সরকার থেকে কোনো দান-অনুদান নেয় না। তবে শিক্ষা সনদের স্বীকৃতি যখন সরকার দিচ্ছে, তখন পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপন অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। কওমি মাদ্রাসার সিলেবাসে কিছু জাগতিক বিষয়ের অন্তর্ভুক্তি প্রয়োজনীয় বলে ব্যাপকভাবে ধারণা করা হয়। ইসলাম ধর্ম চর্চার পাশাপাশি তাদের ভাষা, গণিত, সমাজবিজ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তি ইত্যাদি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে অধিক আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। আইনটি চূড়ান্ত করার আগে সরকারের কওমি মাদ্রাসার নেতাদের সঙ্গে একটি যৌক্তিক সম্মানজনক সমঝোতায় আসা দরকার। নচেৎ দাওরায়ে হাদিসকে ইসলামের ইতিহাস ও আরবি বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রির সমতুল্য করার সুফল তারা পাবে না।  

আলী ইমাম মজুমদার সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব