বিএনপি দেশকে কোথায় নিতে চায়

জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়া
জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়া

ঔপনিবেশিক আমল থেকে আজ অবধি এ দেশে আমরা চারটি দলের শাসন দেখেছি। এর মধ্যে দুটি দল—মুসলিম লীগ ও আওয়ামী লীগ তৈরি হয়েছিল ক্ষমতার বৃত্তের বাইরে। তারা দীর্ঘকাল সংগঠন ও আন্দোলন করে জনগণের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছিল। মুসলিম লীগ দেশের হাল ধরেছিল নতুন একটি রাষ্ট্র ‘পাকিস্তান’ তৈরির মধ্য দিয়ে। জন-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে তাল মেলাতে না পারা এবং জনগণের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ার কারণে দলটির ভরাডুবি হয়।

আওয়ামী লীগও দুই দশকের আন্দোলন-সংঘটনের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছিল এবং একইভাবে নতুন রাষ্ট্র ‘বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে দেশের হাল ধরেছিল। আওয়ামী লীগ টেকসই হয়েছে। মুসলিম লীগ কেন পারল না এবং আওয়ামী লীগ কেন সফল, এ নিয়ে গবেষণা হতে পারে।

এর বাইরে আমরা দেখেছি স্বল্প কিংবা মধ্যমেয়াদি সামরিক শাসন এবং এর ছাতার তলায় গড়ে ওঠা রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জাতীয় পার্টি। দুটোই একসময় সরকার চালিয়েছে। বিএনপি গত ১২ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে রয়েছে। জাতীয় পার্টি ১২ বছর ধরে ক্ষমতার অংশীদার। তারপরও দেখা যায়, বিএনপি একটি ‘প্রবণতা’ হিসেবে এখনো বেশ শক্তিশালী।

অন্যদিকে জাতীয় পার্টি পরিণত হয়েছে আওয়ামী লীগের ‘পরিশিষ্ট’ হিসেবে। এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। কেননা, বিএনপির মতাদর্শ এবং তাদের লোকজন ভাগিয়ে এনেই তৈরি হয়েছিল জাতীয় পার্টি। রাজনীতিতে কত কী-ই না হয়।

বাংলাদেশের রাজনীতির দুই পরাশক্তির একটি আওয়ামী লীগ, অপরটি বিএনপি। রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার লড়াইয়ে তারা পরস্পরের প্রধান প্রতিপক্ষ। বিএনপির বয়স চার দশক পার হলো। ১৯৭৮ সালের ৩১ আগস্ট দলটি সরকারি অনুমোদন পায়। ১ সেপ্টেম্বর ঢাকায় রমনা রেস্তোরাঁ প্রাঙ্গণে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বিএনপির প্রধান হিসেবে দলের নাম, গঠনতন্ত্র ও কর্মসূচি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন। তঁার ৭৬ জনের আহ্বায়ক কমিটিতে আওয়ামী লীগেরও বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ ও কনিষ্ঠ নেতা ছিলেন; যেমন মোহাম্মদ উল্লাহ, কে এম ওবায়দুর রহমান, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, ক্যাপ্টেন (অব.) সুজাত আলী প্রমুখ।

পরে আওয়ামী লীগের আরও যঁারা যোগ দিয়েছিলেন, তঁাদের মধ্যে অধ্যাপক ইউসুফ আলী ও সোহরাব হোসেন উল্লেখযোগ্য। তঁারা দুজনই বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন। অধ্যাপক ইউসুফ আলী তো মুজিবনগরে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করে বিশেষ খ্যাতি পেয়েছিলেন। জিয়াউর রহমান ১৯৮১ সালের ৩০ মে এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হন। তিনি আরও কয়েক বছর বেঁচে থাকলে আর কে কে এই দলে যোগ দিতেন, তা নিয়ে অম্লমধুর আলোচনা হতে পারে।

বিএনপি আজ ৪০ পেরিয়ে ৪১ বছরে পা রাখল। তাদের অগুনতি নেতা-কর্মীকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, বিএনপির হালহকিকত কেমন এবং সামনের দিনগুলোতে দলটি কোথায় গিয়ে দঁাড়াবে।

এ দেশের রাজনীতিতে ক্রমাগত যে মেরুকরণ হয়েছে, তার ফলে জন্ম নিয়েছে একধরনের ‘আইডেন্টিটি পলিটিকস’ বা পরিচয়ের রাজনীতি। তাদের চিন্তাভাবনায় কিংবা কাজকর্মে যত মিলই থাকুক না কেন, তারা কিছু বিশেষ ধরনের স্লোগান ও বাক্য আওড়ে নিজ নিজ অবস্থান জানান দেয়। আওয়ামী লীগের স্লোগান হলো ‘জয় বাংলা’। বিএনপির স্লোগান হলো ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক আহমদ শরীফের মন্তব্য উদ্ধৃত করছি:

‘জিন্দাবাদ ও ইনক্লাব (বিপ্লব) এ দুটো ফারসি ও আরবি শব্দ চালু করেন ব্রিটিশ ভারতের বিপ্লবীরা। এ শব্দগুলোতে জাতীয়তা বা শাস্ত্রিক স্বাতন্ত্র্য চেতনার কোনো প্রত্যক্ষ সম্বন্ধ নেই। “জয় বাংলা”তেও নেই হিন্দুয়ানি। সংস্কৃত জি+অল=জয়। এতে সাফল্যের কাঙ্ক্ষা আছে মাত্র, দেবতার সহায়তা নেই। কাজেই ১৯৬৯-৭০-৭১ সালে যে জয় বাংলাতে পাকিস্তান সমর্থক মুসলিমরা জয় কালীর ছায়া দেখেছিল, তা ছিল তাদের চরম অজ্ঞতাপ্রসূত।

‘যাহোক, এখন “জিন্দাবাদ” ও “জয় বাংলা” রাজনৈতিক দলের মতাদর্শ সম্পৃক্ত হয়ে যোগরূঢ় সংজ্ঞা সংজ্ঞার্থ লাভ করেছে। কাজেই মৌল অভিধাচ্যুত হয়ে এ স্লোগান বা “জিকির” দুটো এখন বিশিষ্ট মতের, পথের, আদর্শের ও সিদ্ধান্তের প্রতীক প্রতিম ও প্রতিভূ হয়ে উঠেছে। একটি বাঙালির, অপরটি রাষ্ট্রিক বাঙালির অভিধাজ্ঞাপক।’

আধুনিক জমানায় একদলীয় রাষ্ট্রের ধারণা জনপ্রিয় হয়নি। বহুদলীয় ব্যবস্থায় দলগুলো নাগরিকদের মন জয় করার জন্য নানান কথা বলে, নানা কৌশলের আশ্রয় নেয়। কয়েক বছর পরপর নির্বাচনে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়। দলগুলো যে সব সময় নাগরিকদের মনমতো কথা বলে বা আচরণ করে, তা নয়। তারপরও নাগরিকদের পছন্দের জমিটি খুবই ছোট, সীমিত। অনেক সময় ‘মন্দের ভালো’কেই বেছে নিতে হয়। অর্থাৎ একটিকে বর্জন করলে অন্যটি সামনে চলে আসে। এভাবেই এ দেশের রাজনীতিতে পালাবদল হচ্ছে ১৯৯০-এর দশক থেকে।

আওয়ামী লীগ সরকার পরিচালনা করছে টানা প্রায় ১০ বছর ধরে। তাদের নানা অর্জনের পাশাপাশি ব্যর্থতাও আছে অনেক। আওয়ামী লীগের পক্ষে আছে বিশাল এক জনগোষ্ঠী। কিন্তু আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নানা কারণে ক্ষোভ ও হতাশাও আছে। আওয়ামী লীগবিরোধী এই সেন্টিমেন্টটিই বিএনপির সবচেয়ে বড় পুঁজি। দুর্বল হলেও নীরব জনসমর্থন পেয়ে একটি রাজনৈতিক দল যে নির্বাচনে জিতে যেতে পারে, তার প্রমাণ দেখা গেছে ১৯৯১ সালে। বিএনপি আশা করে, ঠিকঠাকমতো ভোট হলে আগামী নির্বাচনে তারাই জিতবে। নির্বাচনে জিতে গেলেও তারা দেশটি ঠিকমতো চালাতে পারবে কি না, এ নিয়ে প্রশ্ন আছে, আছে শঙ্কা। আওয়ামী লীগের বিএনপিবিরোধী প্রচারের মূল সুরটি এখানেই। এ দেশে গত প্রায় ১০ বছরে আওয়ামী লীগের ভাষায় যে ‘অভূতপূর্ব উন্নয়ন’ হয়েছে, তার ধারাবাহিকতা ধরে রাখার জন্য আওয়ামী লীগকে আবারও সরকার পরিচালনায় থাকতে হবে। কেননা, তাদের মতে, বিএনপি ক্ষমতায় এলে দেশ পিছিয়ে যাবে।  আওয়ামী লীগের এই প্রচারের তেমন জুতসই জবাব বিএনপি দিচ্ছে না। বিএনপি ‘গণতন্ত্র’ নিয়েই কথাবার্তা বলছে বেশি। বিএনপি দেশটিকে ১০-২০ বছর পর কোথায় নিয়ে যেতে চায়, তার বিস্তারিত কৌশলপত্র এখনো তারা দেয়নি। বিএনপির মূল স্লোগান হলো: আওয়ামী লীগ হটাও।

বহুদলীয় রাজনীতিতে নাগরিকেরা একটু স্বস্তিতে নিশ্বাস ফেলার জায়গা পান। এদিক দিয়ে ভাবলে বিএনপি এখনো প্রাসঙ্গিক। বিরোধী দল যখন ক্ষমতার রাজনীতিতে বিকল্প হয়ে ওঠে, তখন জবাবদিহির একটা জায়গা তৈরি হয়। রাজনীতির একচেটিয়া কারবারে জবাবদিহির কোনো জায়গা নেই।

বিএনপি অতীতে অনেক ভুল করেছে। ভুল কমবেশি সবাই করে। তবে তা স্বীকার করে না। বিএনপির বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগগুলো হলো: ১. ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে পাস করিয়ে তারা বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ বন্ধ করে দিয়েছিল। ২. বিনে পয়সায় সাবমেরিন কেব্‌লের সংযোগের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে তারা দেশকে অনেক পিছিয়ে দিয়েছে। ৩. খালেদা জিয়ার মামলার রায় হওয়ার আগে তড়িঘড়ি করে দলের সংবিধান সংশোধন করে ‘দুর্নীতি ও অসদাচরণের’ দায়ে দণ্ডিত ব্যক্তিদের দলের নেতৃত্বে রাখার ব্যবস্থা জায়েজ করেছে।

এগুলোর কোনোটিই আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা, উন্নয়ন ও নৈতিকতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। বিএনপিকে তার অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে।

মহিউদ্দিন আহমদ, লেখক ও গবেষক
[email protected]