ভোটের রাজনীতি ও জোটের রাজনীতি

রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের স্রোত যখন অপ্রতিহত গতিতে চলছিল, তিনটি বড় দেশ ছাড়া বিশ্বব্যাপী ধ্বনিত হচ্ছিল তাদের প্রতি অপার সহানুভূতি, তখন ফুটপাতের এক ফল বিক্রেতা বললেন, ‘ওরা আর ফেরত যাবে না, আমরা ওদের ফেরত পাঠাতে পারব না।’

তিনি কূটনীতিবিদ নন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ও পার হওয়ার সুযোগ হয়েছে কি না সন্দেহ, কিন্তু কী করে জানলেন রোহিঙ্গাদের নিয়তি কী হতে পারে বা বাংলাদেশের ভূমিকা কী হবে!

ভারত-চীন-ভুটান সীমান্তে তখন চরম উত্তেজনা। বাংলাদেশের ও বিশ্বের সংবাদমাধ্যমে লেখা হচ্ছিল যেকোনো মুহূর্তে চীন-ভারত যুদ্ধ বেঁধে যাবে। আমাদের কলাম লেখকদের আশঙ্কাও ছিল তাই। টক শোজীবীদের আশঙ্কা আরও এক কাঠি বেশি। সেই সময় এক ওষুধের দোকানের কর্মচারী যুবক বললেন, ‘যুদ্ধ-টুদ্ধ কিচ্ছু হইব না। দুই দেশই শক্তিশালী। তারা অত বোকা না।’

সপ্তাহখানেক পরেই বুঝতে পারলাম ছেলেটি একজন দক্ষ নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ।

পাশ্চাত্যের সংবাদমাধ্যম ঘণ্টায় ঘণ্টায় ঘোষণা করছে যেকোনো মুহূর্তে উত্তর কোরিয়াকে আক্রমণ করবে যুক্তরাষ্ট্র। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের হাত-ইশারা বাকি। কিম জং–উনকে উচিত শিক্ষা দেবে। হোয়াইট হাউসের মুখপাত্রদের অনবরত মুখ চলছে। আমেরিকার পশ্চিমা মিত্রদের কপালে ভাঁজ। তখন একটি ব্যাংকের নিরাপত্তাকর্মী একা একাই বলছিলেন, আমেরিকার তর্জন-গর্জনই সার। কিমের গায়ে হাত দেবে না।

আমি বললাম, আপনি কী করে জানলেন যে ট্রাম্প কিমের শরীরে হাত দেবেন না?

মধ্যবয়সী নিরাপত্তাকর্মী দরজায় দাঁড়িয়ে বললেন, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়ার মতো কোরিয়া মুসলমান দেশ না।

আক্রমণ করা তো দূরের কথা, কয়েক মাস পরে দেখা গেল সিঙ্গাপুরে দুই দোস্ত খানাপিনা করছেন। দীর্ঘ বৈরিতার পর নতুন মহব্বতের সূচনা।

বাংলাদেশের হাটবাজার, দোকানপাট ও রাস্তাঘাটে লোকজন অনেক ফালতু কথা বলে। কিন্তু তাদের অনেকের দিব্যদৃষ্টি ও দূরদর্শিতা হেনরি কিসিঞ্জারের চেয়ে কিছুমাত্র কম নয়। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের বিত্ত সামান্য, পুঁথিগত বিদ্যায় ঘাটতি রয়েছে, কিন্তু বুদ্ধি-বিশেষ করে কূটবুদ্ধির অভাব, সে অপবাদ দেওয়া যাবে না। বাংলাদেশের অক্ষরজ্ঞানহীন কিশোরদের বুদ্ধি রাইট ভ্রাতৃদ্বয় বা নাসার বিজ্ঞানীদের চেয়ে খুব কম নয় তা ধোলাইখাল ও বুড়িগঙ্গার ওপার জিঞ্জিরা গিয়ে যে কেউ দেখে আসতে পারে। যারা অত্যাধুনিক গাড়ির পার্টস বানাতে পারে, বিদেশি দামি পণ্যের হুবহু নকল তৈরি করতে পারে, তারা দেশের অবস্থা বোঝে না তা ভাবা বোকামি। দেশের অবস্থা বোঝার জন্য রাজনৈতিক নেতা হওয়ার প্রয়োজন হয় না, রাজনীতি করারও প্রয়োজন নেই, পঞ্চইন্দ্রিয়ের মধ্যে মাত্র দুটি—চোখ ও কান সজাগ রাখাই যথেষ্ট।

কোনো দেশের সাধারণ নির্বাচন চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। পরবর্তী একটি মেয়াদে কারা দেশ পরিচালনা করবেন তা নির্ধারিত হয় নির্বাচনে। সাধারণ নির্বাচন কোনো সিটি করপোরেশন নির্বাচন নয়, দোকান মালিক সমিতির নির্বাচনও নয়। সাধারণ নির্বাচন দেশের ভাগ্য পরিবর্তনের পথ। সেখানে রাজনীতিবিদদের ভূমিকা গুরুতর। জনগণের সঠিক সিদ্ধান্ত বদলে দিতে পারে জাতির ভাগ্য। আসতে পারে ইতিবাচক পরিবর্তন অথবা ঘটতে পারে বিপর্যয়।

বিভিন্ন বহুদলীয় গণতান্ত্রিক দেশে সাধারণ নির্বাচনের আগে নির্বাচনী ঐক্যজোট গঠিত হয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় এমন সব দল ঐক্যজোট গঠন করেছে যাদের নীতি-আদর্শে কোনো মিল নেই। দেখা যায় কট্টর দক্ষিণপন্থী ও রক্ষণশীল দলের সঙ্গে বামপন্থী এমনকি মার্ক্সবাদী দলও জোট বেঁধেছে। যদি তারা মনে করে জোট বেঁধে নির্বাচন করে একটা ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব।

বহুদলীয় জোটের সফল সরকার ভারতের পশ্চিমবঙ্গে দেখা গেছে। মালয়েশিয়ায় দেখা গেছে। জার্মানির ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের সরকারও কোয়ালিশন সরকার। বলতে গেলে বর্তমান যুগটিই কোয়ালিশন সরকারের যুগ।

সরকারে এক দলের স্বৈরাচারী শাসনের চেয়ে বিভিন্ন দল-মতের অংশগ্রহণ থাকুক, জনগণ সেটা ভালো মনে করে। আঙ্গেলা ম্যার্কেল চ্যান্সেলরের পদটি ধরে রেখে তার বিনিময়ে অধিকাংশ মন্ত্রিত্ব দিতে চান অন্য দলকে। যাঁরা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করেন, তাঁরা বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন হন এবং জাতীয় স্বার্থে আত্মত্যাগ করতে দ্বিধা করেন না।

আগামী ডিসেম্বরে সাধারণ নির্বাচন করা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। কিছুদিন যাবৎ ছোট দলগুলো জোট গঠনের জন্য বিভিন্ন নেতার বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজ অথবা নৈশভোজে মিলিত হচ্ছে। বাংলাদেশে গত কুড়ি বছরে বামপন্থী এবং দক্ষিণপন্থী-উত্তরপন্থী-পূর্বপন্থী বিভিন্ন দলের ক্ষণজীবী যেসব জোট গঠিত হয়েছে, তা নিয়ে ২০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪০টি পিএইচডি গবেষণা সন্দর্ভ হতে পারে। দু-চারটি ইতিমধ্যে হয়েছে কি না আমার জানা নেই। বাংলার মানুষ কতবার শুনেছে ‘বাম বিকল্পের’ কথা, ‘তৃতীয় ধারা’র নাম। কিন্তু কী ছিল সেই সব জোটের ভূমিকা এবং তাদের কর্মকাণ্ড তা তোপখানা রোডের বড় গাছগুলো ছাড়া দেশের জনগণ জানে না। দলীয় কর্মিবন্ধন ওখানেই হয়।

প্রধান দুই দলের নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যও ছোট দলের নেতারা জোট গঠনের ঘোষণা দেন। আওয়ামী লীগেরও জোট আছে, বিএনপিরও জোট আছে। জামায়াত এবং জাতীয় পার্টি জোটের প্রয়োজনবোধ করে না। তারা দুই বড় দলের ছায়ায় চলতে আরাম পায়। বর্তমানে সরকারে থাকা মানবেতিহাসের প্রথম পাতানো বিরোধী দল জাতীয় পার্টির নেতা সম্প্রতি দিল্লি সফর করে এসে বলেছেন, বিএনপি যদি নির্বাচনে না আসে তাহলে তাঁর দল ৩০০ আসনেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। সম্প্রতি গঠিত ৮-দলীয় বাম গণতান্ত্রিক জোটও ৩০০ আসন ছাড়তে নারাজ। তারা সব আসনেই প্রার্থী দেবে। ১৪-দলীয় ক্ষমতাসীন জোট, জাতীয় পার্টি, ৮-দলীয় বাম জোট এবং বিএনপি ফেলে আসা ব্যারিস্টার সাহেবের গোটা চল্লিশেক দলের ফ্রন্ট যদি ডিসেম্বরে নির্বাচন করে, বিএনপির মতো একটি দল নির্বাচনে না এলে কী আসে-যায়!

ভোটের জন্য জোট গঠন এক কথা, জামানত বাজেয়াপ্ত হবে জেনেও নির্বাচন করা আরেক কথা। দেশের সমস্যা সমাধানে ঐক্যবদ্ধ হওয়া একেবারেই অন্য জিনিস। সেটা করতে হলে জোটবদ্ধ দলগুলোকে আগে দেশের সমস্যাগুলো শনাক্ত করতে হবে এবং অঙ্গীকার করতে হবে, ওই সব সমস্যার সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত তারা থামবে না। গোঁজামিলের নির্বাচনে গিয়ে কোনো অন্যায়কে বৈধতা দেবে না।

ভোটের আগে ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট গ্রহণের জন্য জোট গঠন আর জাতীয় স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হওয়া দুই জিনিস। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা, দেশের আর্থসামাজিক উন্নতির জন্য কাজ করা এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী করতে যেসব রাজনৈতিক দলের নেতারা ক্ষমতার লোভ ত্যাগ করে কাজ করবেন, জাতি তাঁদের মনে রাখবে। ক্ষমতার জন্য যাঁরা এদল-ওদলের লেজুড়বৃত্তি করবেন, তাঁদের স্থান হবে ইতিহাসের ডাস্টবিনে। আজ জাতির এই সন্ধিক্ষণে বাংলাদেশের বড়-ছোট সব দলের নেতাদের বেছে নিতে হবে দুটি বিকল্পের একটি: মানুষের হৃদয়ের আসন অথবা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়।

সৈয়দ আবুল মকসুদ লেখক ও গবেষক