নির্বাচনী প্রয়োজন, না বাণিজ্য?

এই সপ্তাহের আলোচিত চরিত্র কে বা কী? দুর্নীতি নিয়ে টিআইবির প্রতিবেদন? মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাওয়া? বেপরোয়া বাসের ধাক্কায় মায়ের কোল থেকে ছিটকে পড়ে শিশুর মৃত্যু? কাঠমান্ডুতে হাসিনা-মোদি বৈঠক? নাকি অন্য কিছু? আমার তো মনে হয়, সপ্তাহের সবচেয়ে নজরকাড়া বিষয় হলো ‘ইভিএম’ (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন)। কে কবে কোথায় এ যন্ত্রটি তৈরি ও প্রথম প্রয়োগ করেছিলেন, জানি না। মাটির ওপরে বা নিচে যেখানেই তিনি থাকুন না কেন, তাঁর আবিষ্কার নিয়ে বাংলাদেশে যে তুলকালাম হচ্ছে, সেটা ভেবে তিনি যারপরনাই আনন্দিত কিংবা বিস্মিত হবেন।

ভ্লাদিমির লেনিনের বিখ্যাত উক্তিটির কথা মনে পড়ে-ওয়ান স্টেপ ফরোয়ার্ড, টু স্টেপস ব্যাক; এক পা এগোও তো পেছাও দুই পা। বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে সংগতি রেখে ও বোঝাপড়া করে রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণ নিয়ে তিনি এ কথা বলেছিলেন। আবার আমাদের শৈশবের স্কুলপাঠ্যে পাটিগণিতের সেই অঙ্কটির কথাও মনে পড়ে-তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে বানরের মিনিটে এক ফুট ওপরে ওঠা এবং পরের মিনিটে পিছলে দুই ফুট নেমে যাওয়া-বাঁশটির দৈর্ঘ্য কত, ইত্যাদি।

নির্বাচন কমিশনের অবস্থাও হয়েছে ওই রকম। একটু এগোয়, আবার গ্যাঁড়াকলে পড়ে যায়। কোথায় মানুষের মনে তারা স্বস্তি এনে দেবে, তা নয়। নিজেরাই বেফাঁস কথাবার্তা বলে ধোঁয়াশা তৈরি করে। এতে নাগরিকেরা বিভ্রান্ত হন। কমিশন দিন দিন সাবালক হচ্ছে, এ কথাটি জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না।

পাঁচজনের কমিশনে সব সময় যে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হবে, এমন আশা কেউ করেন না। এটা তো সরকারের মন্ত্রিসভা নয় যে প্রধানমন্ত্রী যা বলবেন, সবাই সমস্বরে তাঁকে সমর্থন দেবেন। প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর মন্ত্রীদের থাকা না-থাকা নির্ভর করে। নির্বাচন কমিশন তো স্বাধীন, কমিশনাররাও। কিন্তু সেখানে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ইচ্ছার ঘাটতি লক্ষ করা যাচ্ছে। প্রশ্ন উঠতেই পারে, নির্বাচন কমিশন কি সরকারের ‘এক্সটেনশন’? তা না হলে, সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছার সঙ্গে তাল মেলাতে কমিশন এত উতলা কেন? মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর তিলোত্তমাসম্ভব কাব্যে দেব স্কন্দের মুখ দিয়ে বলেছেন:
অধীন যে জন, কহ, স্বাধীনতা কোথা
সে জনেব? দাস সদা প্রভূ-আজ্ঞাকারী।

কমিশন যদি মনে করে, সরকার তাদের নিয়োগকর্তা এবং সরকারের বিরাগভাজন হওয়ার ঝুঁকি তারা নিতে চায় না, তাহলে সংবিধানে এবং আইনে তাদের যত ক্ষমতাই দেওয়া হোক না কেন, তারা সেটা হজম ও প্রয়োগ করতে পারবে না। মুশকিল হলো এখানেই। কমিশনে যাঁরা আছেন, তাঁরা সব সময় নিজের ক্ষমতার জোরটা বোঝেন না।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা কথা বলতে পছন্দ করেন। সব সময় সামনে গিয়ে আবার পিছিয়ে আসেন। আগে তিনি বলেছিলেন, কোনো রাজনৈতিক দল রাজি না হলে ইভিএম ব্যবহার করা হবে না। তিনি এখন সেই অবস্থান থেকে পিছিয়ে এসেছেন। আবার এ-ও বলেছেন, জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার নিয়ে এখনো নাকি সিদ্ধান্ত হয়নি। তাঁর কথাবার্তা বেশ গোলমেলে।

কমিশন সচিবালয় থেকে বলা হয়েছে, আগামী নির্বাচনে ১০০ আসনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে। অথচ সিইসি বলছেন, এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়নি। সিদ্ধান্ত না হলে মেশিন কেনার জন্য এত তোড়জোড় কেন? তাহলে ঘোড়ার আগে গাড়ি জোড়ার ব্যবস্থা হচ্ছে কার নির্দেশে? সিইসি হয়তো বুঝতে পেরেছেন ইভিএম যন্ত্র কেনাকাটা নিয়ে ঝামেলা তৈরি হবে। ‘জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়নি’ বলার কারণ, একটি ‘অস্বচ্ছ’ প্রক্রিয়ায় ইভিএম কেনার চেষ্টা চলছে। প্রথম আলোর একটি খবরে জানা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ অনুমোদন নিয়ে ট্রাস্ট ব্যাংকে ঋণপত্র খোলা হয়েছে। কেনাকাটা করবে বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি।

গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, কমিশন দেড় লাখ ইভিএম কেনার অনুমোদন দিয়েছে বলে সিইসি জানিয়েছেন। নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার প্রশ্ন তুলেছেন, নির্বাচন কমিশনের কোন সভায় এই অনুমোদন দেওয়া হলো? কমিশনের কোনো নথিতে অনুমোদন থাকতে পারে। কিন্তু তাতে কমিশনের অনুমোদন আছে কি? খবরে প্রকাশ, পরিকল্পনা কমিশনে ইভিএম কেনার একটি প্রকল্প প্রস্তাব গেছে। প্রশ্ন হলো, কমিশনের কোন সভায় এর অনুমোদন দেওয়া হয়?

মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি থেকে ইভিএম কেনার জন্য কোনো টেকনিক্যাল কমিটি কি সুপারিশ করেছে? করে থাকলে কমিশনের কোন সভায় এবং সেখানে কী বলা হয়েছে? জনমনে এসব প্রশ্ন উঠেছে। ইভিএম ব্যবহার করা না-করা নিয়ে যে বিতর্ক হচ্ছে, সেখানে বিষয়টি আওয়ামী লীগ বনাম বিএনপির ঝগড়ার আরেকটি জমি তৈরি হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে। অনেক আওয়ামী-সমর্থক এমনও বলছেন যে ইভিএমবিরোধীরা আসলে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের বিরুদ্ধে; অর্থাৎ অগ্রসরমাণ চিন্তার সঙ্গে পশ্চাৎপদ চিন্তার একটি বিরোধ দেখা দিয়েছে, যেখানে বিএনপি এবং তার মিত্ররা দেশকে পেছনে ঠেলে দিতে চাইছে। বিএনপির নেতা-সমর্থকেরা নানা দেশের উদাহরণ টেনে এনে বলেছেন, দুনিয়ার খুব কম দেশেই এটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বাম জোট, যুক্তফ্রন্ট, এমনকি জাতীয় পার্টিও এ নিয়ে সরব।

এটা ঠিক যে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে শীর্ষস্থানীয় দেশ জার্মানির ফেডারেল কোর্ট নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারকে সংবিধানবিরোধী বলে রায় দিয়েছেন-এমন একটি সংবাদ ছাপা হয়েছে। ভারতের আসন্ন নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে কংগ্রেসসহ সাতটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দল। বিষয়গুলো ভাবায়।

যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের রায় হ্যাকিং করে পাল্টে ফেলা হয়েছিল বলে ডেমোক্র্যাট শিবিরের অভিযোগ ছিল। সন্দেহের তির ছিল রাশিয়ার বিরুদ্ধে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন বলেছেন, চীনা হ্যাকাররা এ কাজ করেছে। জানা গেছে, আমাদের ইভিএম নাকি কেনা হবে চীন বা হংকং থেকে। এমনিতেই নির্বাচন-প্রক্রিয়ায় জনগণের আস্থায় চিড় ধরেছে। তার ওপর এই হ্যাকিংভীতি। হ্যাকাররা যদি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার সরিয়ে নিতে পারে, তাহলে ইভিএম হ্যাক করে ভোটের ফলাফল পাল্টে দেবে না, এর কী নিশ্চয়তা আছে? এই প্রশ্নগুলোর সদুত্তর পাওয়া খুবই জরুরি।

কমিশনার মাহবুব তালুকদার ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দেওয়ায় ৩০ আগস্ট এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, ‘সার্চ কমিটির মাধ্যমে ইসি গঠন করা হয়েছে। এটি গঠনের সময় মাহবুব তালুকদারের নাম দিয়েছিল বিএনপি। সেটি বড় বিষয় নয়। আমি মনে করি, নির্বাচন কমিশনাররা সবাই দক্ষ ও নিরপেক্ষ।’ তালুকদারের নাম যে বিএনপি প্রস্তাব করেছিল, এটা মানুষকে নতুন করে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার মাজেজা বুঝলাম না। সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘একজন কমিশনার নোট অব ডিসেন্ট দিতে পারেন। এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য।’ মনে হতে পারে, ইভিএম ব্যবহার নিয়ে সরকার এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি। তবে প্রধানমন্ত্রী ইতিমধ্যেই ইভিএম-বিতর্কের গোড়ায় জল ঢেলে দিয়েছেন। কারণ, আরেকটি প্রশ্নবিদ্ধ এবং অপ্রয়োজনীয় প্রক্রিয়ার পক্ষে এ ধরনের ঝুঁকি তাঁর না নেওয়ারই কথা। তিনি আপাদমস্তক একজন রাজনীতিবিদ।

একটি অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেড় লাখ ইভিএম কেনার লক্ষ্য হয়তো নির্বাচনে এটি ব্যবহার করা নয়। কেনার জন্যই কেনা। আড়াই হাজার কোটি টাকা নয়ছয় হতে পারে। কমিশন-বাণিজ্য থাকবে। মাঝখানে আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো আরও বিতর্কিত হবে। অথচ এই টাকায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য ২৫-৩০টা ছাত্রাবাস বানানো সম্ভব, বানানো যায় হাজারটা মানসম্মত আধুনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়। জনগণের টাকা এভাবে খরচ করার পেছনে যে বড় ধরনের মতলব আছে, তা মোটামুটি স্পষ্ট। রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগের ক্ষেত্রে জবাবদিহির কোনো বালাই নেই।

মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক
[email protected]