তুরস্কে পশ্চিম-বিরোধিতা বাড়ছে

ট্রাম্প প্রশাসন তুরস্কের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারির পর তুর্কি জনগণের মধ্যে মার্কিনবিরোধী মনোভাব জোরদার হয়েছে। ছবি: রয়টার্স
ট্রাম্প প্রশাসন তুরস্কের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারির পর তুর্কি জনগণের মধ্যে মার্কিনবিরোধী মনোভাব জোরদার হয়েছে। ছবি: রয়টার্স

মার্কিন টেলিভিশন সিরিজ ‘ডালাস’ যখন প্রথম তুরস্কে এল, তখন তা এখানে বেশ ভালোই উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিল, যা অব্যাহত থাকে বেশ কয়েক বছর। যে সময়টায় টেলিভিশনে ‘ডালাস’ দেখাত, তখন তুরস্কের রাস্তায় কাউকে দেখা যেত না। গোটা দেশ ‘ডালাস’ ইউয়িং পরিবারের সুখ-দুঃখে বুঁদ হয়ে ছিল। আমার দাদি ওই সিরিয়ালের খলচরিত্র জুনিয়র ইউয়িংকে সব সময় শাপশাপান্ত করতেন। আমাদেরও রাগ ছিল জুনিয়র ইউয়িংয়ের ওপর। তবে আমরা তাকে কখনো একজন ‘আমেরিকান’ বা ‘পশ্চিমা’ হিসেবে দেখিনি।

যখন আমি অতীতের দিকে তাকাই, তখন অবাক হয়ে লক্ষ করি যে সেখানে পশ্চিমাবিরোধী বা ইউরোপবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি অনুপস্থিত। এ রকম হওয়ার পেছনে একটি কারণ হতে পারে, আলজেরিয়া বা মরক্কোর মতো তুরস্ক কখনো পশ্চিমাদের উপনিবেশ ছিল না। ঔপনিবেশিকতাবাদের কোনো স্মৃতি আমাদের নেই। তুর্কি নাগরিকেরা মনে করত, তারা ইউরোপেরই অংশ, এমনকি অনেক ইউরোপিয়ানও এখনো তা–ই মনে করে। কিন্তু এখন তুর্কিরা আর সেটা মনে করে না।

গত কয়েক বছরে আমার মাতৃভূমি ক্রমাগতভাবে স্বাতন্ত্র্যবাদী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। দেশটি এখন ইউরোপবিরোধী দেশ। সরকারের স্থূল কর্তৃত্বপরায়ণতার সঙ্গে সঙ্গে এখানে এখন অতি জাতীয়তাবাদ ও ধর্মীয় মৌলবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। আর এসব কারণে দেশটিতে নারী-পুরুষের বৈষম্য বাড়ছে।

নারীর প্রতি সহিংসতা নাটকীয়ভাবে বেড়ে গেছে। গত বছর নারী হত্যার ঘটনা ২৫ শতাংশ বেড়েছে। প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানচেষ্টার পর জারি করা জরুরি অবস্থার অবসান ঘটলেও পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক হয়নি।

তুরস্কে পশ্চিমাবিরোধী মনোভাব এতটাই তীব্র হয়েছে যে গত সপ্তাহে তুরস্কের রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রণাধীন টেলিভিশন টিআরটি ঘোষণা দেয় যে তারা আর কাউবয় চলচ্চিত্রগুলো সম্প্রচার করবে না। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন তুরস্কের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করার পর তুর্কি জনগণের মধ্যে এই মার্কিনবিরোধী মনোভাব জোরদার হয়েছে।

মার্কিন ধর্মযাজক অ্যান্ড্রু ব্রানসনকে আটক করে রাখাসহ কয়েকটি কারণে যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটো জোটের অন্যতম এই সদস্যের বিরুদ্ধে এই নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। তুর্কি সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষিত দুটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হয়ে কাজ করার অভিযোগে তুরস্কের আদালতে ৫০ বছর বয়সী এই মার্কিন ধর্মযাজকের বিচার চলছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাঁকে ৩৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড দেওয়া হতে পারে।

মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপের কারণে তুরস্কের মুদ্রা লিরার মান অনেক পড়ে গেছে। এর জবাবে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান গোটা দেশকে মার্কিন ইলেকট্রনিক পণ্য বর্জনের আহ্বান জানিয়েছেন। সরকার সব ডলারকে লিরায় রূপান্তরিত করার আহ্বানও জানিয়েছেন।

আগস্ট মাসে প্রায় প্রতিদিনই সরকারপন্থী টেলিভিশন চ্যানেল ও পত্রপত্রিকাগুলো আমাদের জানিয়েছে যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ নানা উপায়ে পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে। আদানা শহরের এক ব্যক্তি তাঁর সন্তানদের মার্কিন পাসপোর্ট প্রকাশ্যে আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছেন। একই শহরের অতি জাতীয়তাবাদী একটি গ্রুপ টিভি ক্যামেরার সামনে মার্কিন ডলার পুড়িয়ে দিয়েছে। এ ঘটনার পরে ওই গ্রুপের মুখপাত্র বলেছেন, ‘আমরা এই সংকট কাটিয়ে উঠব। আমরা ওই ধর্মযাজককে একজন ইমামে পরিণত করব।’

দেশপ্রেমের ওই উন্মাদনা অবশ্য সব তুর্কি নাগরিকের মধ্যে দেখা যায়নি। যারা পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ দেখাতে রাস্তায় নেমে আসছে, তারা স্পষ্টভাবেই সংখ্যালঘু। কিন্তু একটি দেশে যেখানে বিরোধীদের কথা বলতে দেওয়া হয় না, সব সময় দমন ও পীড়ন করা হয়, সে দেশে এটা একটি বিপৎসংকেত। যে বা যারা পশ্চিমাবিরোধী বিক্ষোভে অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে, তাদের বিশ্বাসঘাতক হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে।

একটি বড় ধরনের সাংস্কৃতিক পরিবর্তন এখানে হচ্ছে। আমাদের একটি কৃত্রিম গোত্র ও জাতিভেদের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে এবং আমাদের বলা হচ্ছে যে জাতিগত, ধর্মীয় ও ঐতিহাসিকভাবে আমরা পশ্চিমাদের থেকে সম্পূর্ণরূপে আলাদা। আমরা আর কখনো তাদের একজন হতে পারব না। সংস্কৃতি এখন নতুন একটি যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। এ দেশ থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা হারিয়ে যাচ্ছে। নতুন করে বেশ কিছু মাদ্রাসা গড়ে তোলা হয়েছে। পাঠ্যসূচিতেও পরিবর্তন আসছে। ধর্মীয় ও জাতীয়তাবাদের লাইনে পাঠ্যসূচি তৈরি করা হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন, তিনি চান একটি ধার্মিক প্রজন্ম গড়ে তুলতে।

ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ তুরস্ককে ইউরোপবিরোধী বলে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের তুরস্ক এখন আর প্রেসিডেন্ট মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের তুরস্ক নয়।

তবে তুরস্কের এই পশ্চিমাবিরোধী মনোভাবের নেতিবাচক পরিণতি ভোগ করতে হবে ‘আমাদের’ এবং ‘তাদেরও’। এই পরিস্থিতি ইউরোপীয় রাজনীতিকদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।

এখন এমন একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে হবে, যেখানে স্বৈরাচারী সরকারগুলোর এবং মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও বাক্‌স্বাধীনতার লজ্জাজনক রেকর্ডের খোলাখুলি সমালোচনা করা যাবে। কিন্তু একই সময়ে এসব দেশের নাগরিক সমাজের ও জনগণের কথা শুনতে হবে, যারা প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সংগ্রাম করে যাচ্ছে। তুরস্কের ইসলামপন্থী ও জাতীয়তাবাদীরা চায় না যে তাদের দেশটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের অংশ হোক। তারা দেশের অস্থিতিশীলতাকে পুঁজি করে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করতে চায়।

যখন এই আন্তর্জাতিক নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে, তখন তুরস্কের সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী ও নাগরিক নেতাদের নির্বাসনে পাঠানো হচ্ছে বা কারাবন্দী করা হচ্ছ। এই যেমন মানবাধিকারকর্মী ওসমান কাভালাকে ভিত্তিহীন অভিযোগে এখনো জেলে আটকে রাখা হয়েছে।

বিরোধী দলের নেতা সেলাহাত্তিনকেও অবৈধভাবে আটকে রাখা হয়েছে। ঔপন্যাসিক ও কলামিস্ট আহমেত আলতান কোনো অপরাধ না করেই যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করছেন। তুরস্ক এখন বিশ্বের মধ্যে সাংবাদিকদের সবচেয়ে বড় কারাগারে পরিণত হয়েছে। এটা চীনের দুঃখজনক রেকর্ডকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে।

তুরস্কের পরিবর্তন হচ্ছে, সব দিক দিয়ে দেশটি পিছিয়ে যাচ্ছে। স্বদেশপ্রেমের দোহাই দিয়ে এর সরকার দেশটিকে ইউরোপ থেকে আলাদা করে দিচ্ছে। কিন্তু সুশীল সমাজ এর বিরোধিতা করছে। তুরস্কে বহু নাগরিক রয়েছে—নারী, শিক্ষার্থী ও সংখ্যালঘুরা আবেগের সঙ্গে বহুত্ববাদী গণতন্ত্রকে রক্ষার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা এখনো সেখানে আছে। আমরা এখনো সেখানে আছি এবং পশ্চিমাদের উচিত আমাদের সাহায্য করা।

ইংরেজি থেকে অনূদিত। দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া

এলিফ শাফাক তুর্কি: বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক