বীরাঙ্গনা ও তাঁর ভাইয়ের গল্প

রমা চৌধুরী
রমা চৌধুরী

মুক্তিযুদ্ধে ধর্ষণের শিকার রমা চৌধুরী সন্তানও হারিয়েছিলেন। সেই দুর্বহ স্মৃতির বোঝা নিয়ে বেঁচে ছিলেন আরও ৪৭ বছর। সেই জীবন গৌরব ও বেদনার। আজ অনেকেই হয়তো জানেন তাঁর জীবনকাহিনি। কিন্তু তাঁর ভাই আলাউদ্দিনের কথা রয়ে গেছে অজানা। প্রথমে এই বীরাঙ্গনা সম্পর্কে সামান্য ভূমিকা দেওয়া যাক। সংবাদমাধ্যমে রমা চৌধুরীর কাহিনি প্রকাশের পর খোদ প্রধানমন্ত্রী দেখা করতে চেয়েছিলেন তাঁর সঙ্গে। তিনি প্রথমে রাজি না হলেও পরে গিয়েছিলেন। সেই খালি পায়ে, মলিন বেশে হাজির হয়েছিলেন গণভবনে। সেটা ২০১৩ সাল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে সাহায্য করতে চেয়েছিলেন। তিনি গ্রহণ করেননি; বরং উল্টো তাঁকে উপহার দিয়ে এসেছিলেন নিজের লেখা একাত্তরের জননী গ্রন্থটি। তাঁকে সাহায্য করতে চেয়েছিলেন আরও অনেকেই। কিন্তু তিনি রাজি হননি, কারও দয়া-দাক্ষিণ্যে বাঁচতে শেখেননি। লেখালেখি করতেন। গল্প-উপন্যাস-কবিতা-প্রবন্ধ মিলিয়ে প্রায় ১৮টি গ্রন্থের লেখিকা রমা চৌধুরী জীবন ধারণ করতেন দ্বারে দ্বারে বই বিক্রি করে।

সেই ষাটের দশকে, যখন এ দেশে নারীদের জন্য উচ্চশিক্ষা সহজ-সুলভ ছিল না, তখন রমা চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেছিলেন। প্রতিষ্ঠার মধ্যগগনে থাকার কথা ছিল তাঁর। কিন্তু সব স্বপ্ন-সম্ভাবনা দুমড়ে-মুচড়ে দিয়ে গেছে একাত্তর।

পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন শিক্ষকতা। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি ছিলেন নিজের গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর পোপাদিয়াতে। স্বামী চলে গিয়েছিলেন ভারতে। একাত্তরের ১৩ মে স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি সেনারা হানা দিয়েছিল তাঁর বাড়িতে। পাকিস্তানি সেনারা নিজের মা আর দুই শিশুসন্তানের সামনেই ধর্ষণ করে তাঁকে। লুটপাটের পর বাড়িটি পুড়িয়ে দেয়। তারপর এলাকাবাসী কেউ কেউ তাঁর প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছিলেন, কিন্তু নিকটজনেরাই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। রমা চৌধুরী তাঁর একাত্তরের জননী বইয়ে লিখেছেন, ‘...আমার আপন মেজো কাকা সেদিন এমন সব বিশ্রী কথা বলেছিলেন, লজ্জায় কানে আঙুল দিতে বাধ্য হই। আমি লজ্জায় মুখ দেখাতে পারছি না, দোকানে গিয়ে কিছু খাবারও সংগ্রহ করতে পারলাম না মা ও ছেলেদের মুখে দেবার জন্য।’

ছেলেদের নিয়ে থাকতে হয়েছে দরজা-জানালাহীন ভাঙা ঘরে। অনাহারে-অর্ধাহারে ও শীতের কামড়ে অসুস্থ হয়ে পড়ল সাগর ও টগর নামে দুই ছেলে। ১৫ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয়ের আগের রাতে অসুস্থ হয়ে ২০ ডিসেম্বর মারা গেল সাগর। একইভাবে ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি মারা গেল দ্বিতীয় ছেলে টগরও। স্বামী আর তাঁকে গ্রহণ করেননি।

রমা চৌধুরী স্বাধীনতার পর দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু প্রতারণার শিকার হলেন, সংসার ভাঙল। এই ঘরের এক সন্তানকেও হারালেন ১৯৯৮ সালে। হিন্দুধর্মের মরদেহ পোড়ানোর রীতি মানেনি; তিনটি ছেলেকেই মাটিচাপা দেওয়া হয়েছিল। তিন সন্তান মাটির নিচে আছে-এই বিশ্বাসে বাকি জীবন আর কখনো জুতা পরে মাটিতে হাঁটেননি। সব হারিয়েও পরাস্ত হননি, নিজের সৃষ্টিশীলতাকে অবলম্বন করে বাঁচতে চেয়েছেন সম্মানের সঙ্গে। এখান থেকেই শুরু হতে পারে আলাউদ্দিনের কথা। ১৯৯৪ সালে চট্টগ্রামের একটি প্রেসে বই ছাপাতে গিয়ে সেই প্রেসেরই কর্মী আলাউদ্দিনের সঙ্গে পরিচয়। আলাউদ্দিনেরও ছিল দুঃখের ইতিহাস। সৎমায়ের রূঢ় ব্যবহারে ঘর ছেড়েছিলেন তিনি। দুই দুঃখী বাঁধা পড়লেন মায়ার বাঁধনে, হলেন ভাইবোন। দিদি একসময় আলাউদ্দিনকে রেঁধে খাওয়াতেন। পরে ভাইবোন যখন একত্রে থাকা শুরু করলেন, তখন ১৫ বছর ধরে দিদিকে রেঁধে খাইয়েছেন আলাউদ্দিন। টুকটাক প্রেসের ব্যবসা আর সাংগঠনিক কিছু কাজকর্ম ছাড়া বাকি সময়টা দিদির দেখাশোনা, দিদির বই ছেপে বের করা, পরে তাঁর সঙ্গে ঘুরে ঘুরে সেই বই বিক্রি করেই দিন কেটেছে আলাউদ্দিন খোকনের।

১৯৯৫ সালের মার্চ মাসে একবার মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণজনিত রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন রমা চৌধুরী। আলাউদ্দিন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দেড়টি মাস দিদির সেবাশুশ্রূষা করেন। তখন এই আলাউদ্দিন ছিলেন প্রথম আলো চট্টগ্রাম বন্ধুসভার সাধারণ সম্পাদক। বন্ধুসভার সদস্যরাও তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে সেবাশুশ্রূষা করেছিলেন দিদিকে। হাসপাতাল থেকে ঘরে ফেরার পর রমা চৌধুরীর শরীরের ডান পাশ অবশ হয়ে পড়েছিল, একটি চোখও নষ্ট হয়ে যায়। আলাউদ্দিন নিজের হাতে খাইয়েছেন-পরিয়েছেন, গোসল করিয়েছেন দিদিকে। দিদি আবার ফিরে পেয়েছেন চলার শক্তি। চট্টগ্রাম শহরের মানুষ দীর্ঘকাল ধরে দেখেছে একটি দৃশ্য-কাঁধে ঝোলা, কানে হিয়ারিং এইড লাগানো এক প্রৌঢ়া হেঁটে যাচ্ছেন ফুটপাত ধরে, পাশে তাঁর মাথায় ছাতা ধরে চলেছেন এক তরুণ।

দিদি পূজা দিতে যান চট্টগ্রামের কৈবল্যধাম ও গোলপাহাড়ের শ্মশান মন্দিরে। সেখানেও তাঁর সঙ্গী আলাউদ্দিন। দিদি পূজা করেন, দূরে দাঁড়িয়ে থাকেন ছোট ভাইটি। দিদি তাঁর দেবতার কাছে ভাইয়ের মঙ্গল কামনা করে প্রার্থনা করেন। দিদির পূজার জন্য ভোগও রান্না করে দেন আলাউদ্দিন। ‘অন্য ধর্মাবলম্বীর রান্না করা ভোগ দেবতা গ্রহণ করবেন?’ একবার সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে এ কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম রমা চৌধুরীকে। যেন অবান্তর কোনো প্রশ্ন শুনলেন, এভাবে ব্যথা ও বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিলেন প্রৌঢ়া। সেই দৃষ্টিতে যেন উঠে আসে পাল্টা প্রশ্ন, ‘ভাইয়ের আবার জাত কী?’ এদিকে সময়ের নিয়মে আলাউদ্দিন বিয়ে করেছেন। একটি কন্যাসন্তানও আছে তাঁর। কিন্তু নিজের ঘরসংসার একদিকে রেখে দিদির শুশ্রূষা করে গেছেন আলাউদ্দিন। এ নিয়ে স্ত্রী-কন্যার অনেক অভিমান হয়তো ছিল, কিন্তু আলাউদ্দিন যে বাঁধা পড়ে গেছেন কর্তব্য ও মমতার নিগড়ে। বছরখানেক ধরে অসুস্থ অবস্থায় শয্যাশায়ী ছিলেন রমা চৌধুরী। চিকিৎসার সুব্যবস্থা করার জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন আলাউদ্দিন। কোথাও সহযোগিতা পেয়েছেন, কোথাও-বা প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। অবশেষে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সরকারি নির্দেশে কেবিনের ব্যবস্থা হয়েছিল তাঁর। দিনরাত হাসপাতালে তাঁর পাশে ছিলেন আলাউদ্দিন। ৩ সেপ্টেম্বর ভোরে একপ্রকার ভাইয়ের কোলেই মাথা রেখে মৃত্যু হয় তাঁর।

দিদির মৃত্যুর ঠিক দুই দিন আগে ছিল আলাউদ্দিনের একমাত্র কন্যাসন্তানটির জন্মদিন। মেয়ের সাধ ছিল কেক কাটার সময় বাবা থাকবেন তার পাশে। কিন্তু সেই সময়টিতেও মেয়ের কাছে থাকতে পারেননি আলাউদ্দিন। হাসপাতালে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন দিদির শিয়রে বসে। এই যুগে নিজের সন্তানই ঠিকমতো দেখভাল করতে পারেন না মা-বাবার। সেখানে অনাত্মীয় ও ভিন্ন সম্প্রদায়ের দুটি মানুষের এই অসাধারণ সম্পর্ক দেখে বিস্ময় মানতেই হয়!

বিশ্বজিৎ চৌধুরী: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক, কবি ও সাহিত্যিক
[email protected]