মেধার বহির্গমন রোধ করা জরুরি

দক্ষ ও মেধাবী মানবসম্পদ একটি উন্নত জাতি গঠনের পূর্বশর্ত। যখন পশ্চাৎপদতা কাটিয়ে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হবে, তখন আমরা এগিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে পিছিয়ে যাচ্ছি। সামাজিক বাস্তবতার পাশাপাশি কোনো কোনো ক্ষেত্রে অবহেলা, অজ্ঞতা ও দায়িত্বহীনতার কারণেও জাতিগতভাবে পিছিয়ে পড়ছি।

উন্নত দেশগুলো লোভনীয় বৃত্তিতে উচ্চশিক্ষার সুযোগ করে দিয়ে তৃতীয় বিশ্বের মেধাবী শিক্ষার্থীদের নিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষাজীবন শেষে তাদের লোভনীয় চাকরির ব্যবস্থাও করছে। উন্নত দেশগুলো তৃতীয় বিশ্বের এই মেধা কাজে লাগিয়ে আরও উন্নত হচ্ছে। কিন্তু আমরা তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো পিছিয়েই থাকছি। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা প্রবল। মেধাবীরা যায় বিদেশি বৃত্তি পেয়ে, আর যারা বৃত্তি পায় না তারা যায় নিজের খরচে। অর্থাৎ মেধার পাশাপাশি বিপুল অঙ্কের অর্থও এই খাতে বিদেশে চলে যাচ্ছে।

ইউনেসকোর এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া ও কানাডায় পড়তে গেছেন ১৫ হাজার ৩৪ জন। সমীক্ষা অনুযায়ী, এ পাঁচটি দেশে তাঁদের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর কোর্স করতে গড়ে ৬ বছরে খরচ হবে প্রায় ১৯ হাজার ২০০ কোটি টাকা। যদি তাঁদের এক-তৃতীয়াংশের অভিভাবক সন্তানদের পড়ালেখার খোঁজখবর নিতে বিদেশে যান, তাহলে আরও ১ হাজার ২১০ কোটি টাকা খরচ যোগ হবে। এই ৫টি দেশ ছাড়াও চীন, জাপান, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, ইতালি, ফ্রান্স, তুরস্ক, মিসর, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিক্ষার্থী প্রতিবছর পড়তে যান। অর্থাৎ এই খাতে বিপুল অঙ্কের অর্থ বৈদেশিক মুদ্রার আকারে বিদেশে চলে যাচ্ছে।

এই অর্থনৈতিক ক্ষতির চেয়েও বড় ক্ষতি দেশের মেধাবী সন্তানদের হারানো। এটা একটা বড় জাতীয় সমস্যা। এই সমস্যার সমাধান নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে দুটি প্রশ্ন আসে। এক, আমাদের ছেলেমেয়েরা কেন বিদেশে পড়তে যাচ্ছে? দুই, কেন তারা পড়ালেখা শেষ করে আর দেশে ফিরছে না?

প্রথম প্রশ্নের উত্তর সহজ। মেধাবীরা বৃত্তি পেলে উন্নত দেশে উন্নত মানের উচ্চশিক্ষা নিতে যায়। যারা বৃত্তি পায় না, তাদের আর্থিক সামর্থ্য থাকলে নিজের খরচে পড়তে যায়। কারণ, এই দেশে উচ্চশিক্ষার কাঙ্ক্ষিত পরিবেশ নিশ্চিত করা যায়নি। এ দেশের কোনো সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্ব র‍্যাঙ্কিংয়ে সম্মানজনক অবস্থানে নেই। শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন আছে; আছে ক্যাম্পাসে অস্থিরতা, রাজনৈতিক হানাহানির কারণে অভিভাবকদের দুশ্চিন্তা। তাই যাঁদের আর্থিক সামর্থ্য আছে, তাঁরা ভালো মানের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য সন্তানদের বিদেশে পাঠান। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরও সহজ। উন্নত দেশে দামি ডিগ্রি অর্জন করে ওই দেশেই কাঙ্ক্ষিত কাজ পেলে কেউ দেশে ফিরতে চায় না। কারণ, দেশে সেই নিশ্চয়তা নেই।

আসলে দোষ ওদের নয়। মেধাবীদের ফিরিয়ে এনে জাতির অগ্রগতির জন্য কাজে লাগানোর পরিকল্পনা আমাদের নেই। রাষ্ট্র চাইলে বিশ্বমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দেশেই গড়ে তোলা সম্ভব। প্রতিবছর সরকার অর্থ বাজেট উপস্থাপন করে। কিন্তু উচ্চশিক্ষায় বাজেটের কোনো পরিবর্তন হয় না। এ থেকেই অনুমেয়, উচ্চশিক্ষায় সরকারের তেমন কোনো পরিকল্পনা নেই।

সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় গত এক দশকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে বেশ সাফল্য অর্জিত হয়েছে। এই ছেলেমেয়েরাই যখন উচ্চশিক্ষায় আসছে, তখন আগের পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইদানীং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো আচরণ শুরু করেছে।

তারা সন্ধ্যাকালীন কোর্স করছে, প্রফেশনাল কোর্স করছে। অতিরিক্ত প্রাপ্তি আছে বলে শিক্ষকদের আগ্রহ এতে বেশি। ফলে নিয়মিত ক্লাসে তাঁদের পারফরম্যান্স প্রত্যাশিত মানে থাকছে না। সরকারি কলেজগুলোতে মানসম্পন্ন শিক্ষা না থাকলেও বিবিএ, এমবিএ, ফোর ইয়ার্স কম্পিউটার সায়েন্স ইত্যাদি বিষয়ের সনদ দিচ্ছে।

অথচ রাষ্ট্র পরিকল্পনা গ্রহণ করলে বিশ্বমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দেশেই গড়ে তোলা সম্ভব। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে তহবিল গঠন করে একটি পাইলট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যেতে পারে, যেখানে পাঠদানের জন্য আসবে বিশ্বের বড় বড় উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধ্যাপকেরা। পৃষ্ঠপোষকতা থাকলে কেমব্রিজ, অক্সফোর্ড, হার্ভার্ড ও স্ট্যানফোর্ডের অধ্যাপকদের পাওয়া সম্ভব। এখানে শিক্ষার্থীদের বাস্তব বিশ্বের ব্যবহারিক জ্ঞান দিতে আসবেন মাইক্রোসফট, অ্যাপল, গুগল ও ফেসবুকের প্রধান নির্বাহীরা। আন্তর্জাতিকভাবে একটি বিশ্ববিদ্যালয় গড়তে রাষ্ট্রের ৫০০ কোটি টাকাও লাগবে না। অথচ প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা বাইরে চলে যাচ্ছে শুধু উচ্চশিক্ষায় বিদেশে পড়তে যাওয়া শিক্ষার্থীদের দ্বারা।

ইউরোপ-আমেরিকা সুকৌশলে সারা বিশ্ব থেকে মেধাবীদের কিনে নিচ্ছে। মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসায় আমেরিকান নাগরিকের সংখ্যা ৩০ শতাংশেরও কম। সারা বিশ্বের মেধাবীদের তারা সেখানে গ্রহণ করেছে। এটা তাদের দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ পরিকল্পনার অংশ। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের একেকটা ইউনিভার্সিটিও কিন্তু একেকটা শিল্প। তারা এখান থেকে বৈদেশিক ডলার উপার্জন করছে।

সরকারের উদ্যোগ থাকলে অবশ্যই এই অঞ্চলে বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা সম্ভব। প্রথম সারির কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলে দেশের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কাছ থেকে অভিজ্ঞতা নিয়ে সার্বিকভাবে একটি বিশ্বমানের শিক্ষা পরিবেশ নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে। বিশ্বমানের ৫টি বিশ্ববিদ্যালয়,২টি বিশ্বমানের মেডিকেল কলেজ,২টি ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট যদি সরকার প্রতিষ্ঠা করতে পারে, তাহলে মেধার বহির্গমন শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে।

এবার আসা যাক কর্মক্ষেত্র নিয়ে। আমাদের মেধাবীরা ফিরছে না কাঙ্ক্ষিত মানের জীবনযাপনের সুযোগ তথা একটি প্রত্যাশিত চাকরির সুযোগ না থাকার কারণে। অথচ বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত দেখলে বোঝা যায়, এ দেশে কাজের ক্ষেত্রের কোনো অভাব নেই। এ দেশে এসে মোটা বেতনে চাকরি করছেন বিদেশি বিশেষজ্ঞরা। তাহলে সমস্যাটা কোথায়? সমস্যাটা আসলে সমন্বয়ে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এক সাম্প্রতিক গবেষণায় বলেছে, দেশের ২৪ শতাংশ তৈরি পোশাক কারখানায় বিদেশিকর্মীরা কর্মরত আছেন। তথ্যপ্রযুক্তি, চামড়া, তৈরি পোশাক, পর্যটন, চা-শিল্প, শিপইয়ার্ড, কনস্ট্রাকশন, ভারী শিল্পপ্রতিষ্ঠানসহ গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোতে দক্ষ জনশক্তির অভাবে বিদেশি শ্রমিক আমদানি করা হয়। ২০১৭ সালের ১৬ অক্টোবর প্রকাশিত প্রথম আলোর সম্পাদকীয়তে বলা হয়, সরকারি তথ্য অনুযায়ী বৈধভাবে এ দেশে সাড়ে ১৬ হাজার বিদেশি নাগরিক কাজ করছেন। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, বিদেশি চাকুরের সংখ্যা কয়েক লাখ।

বাংলাদেশে চাকরির বাজারে বিদেশিদের দাপট শিরোনামে বিবিসি বাংলা গত মে মাসে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে বাংলাদেশের বিভিন্ন সেক্টরে বিদেশিদের প্রভাব কতটা প্রবল, তার একটি চিত্র তুলে ধরা হয়। এসব চিত্র থেকে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়, কর্মক্ষেত্র বা বেতন কোনো সমস্যা নয়। ভালো মানের কর্মক্ষেত্র নিশ্চিত করেই আমাদের দেশের মেধাবী গোষ্ঠীটির দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা আমরা করতে পারি।

কারা কোন সেক্টরে কাজ করবেন, তাঁদের কী মানের শিক্ষা প্রয়োজন ইত্যাদি বিষয়ে জাতীয় পরিকল্পনা জরুরি। সরকার মেধাবীদের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারে। এই পরিকল্পনায় থাকবে আগামী দশ বা পনেরো বছর পর এ দেশে কোন কোন সেক্টরে কত সংখ্যক বিশেষজ্ঞ দরকার হতে পারে। দেশের মেধাবীদের একটি তালিকা প্রস্তুত করে তাঁদের দেশে অথবা দেশের বাইরে উন্নত শিক্ষার সুযোগ দিয়ে বিশেষজ্ঞ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে। এই জনগোষ্ঠীটিই দক্ষ হয়ে আগামী দিনে দেশের সব সেক্টরের দায়িত্ব গ্রহণ করবে।

দেশের সন্তান গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা আর একই দায়িত্বে বিদেশি বিশেষজ্ঞ থাকার মধ্যে পার্থক্য অনেক। সরকার এ বিষয়ে দৃষ্টি দিলে দেশের মেধা দেশের কাজে লাগিয়ে সমৃদ্ধির সোপানে আরোহণ সম্ভব।

ড. আবু ইউসুফ মো. আব্দুল্লাহ: খুলনা নর্দান ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজির উপাচার্য