হিজরি নববর্ষ ও মহররম মাস

হিজরি নববর্ষ ১৪৪০ সমাগত। ইসলামের বিধিবিধান হিজরি সন ও চান্দ্র তারিখের সঙ্গে সম্পর্কিত। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসবসহ সব ক্ষেত্রেই মুসলিম উম্মাহ হিজরি সনের ওপর নির্ভরশীল। হিজরি সনের সঙ্গে মুসলিম উম্মাহর তাহজিব তামাদ্দুনিক ঐতিহ্য সম্পৃক্ত। বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর সংস্কৃতিতে ও মুসলমানদের জীবনে হিজরি সনের গুরুত্ব অপরিসীম।

সময়ের সমষ্টিই মানবজীবন বা আয়ু। তিলে তিলে পলে পলে মানুষের আয়ু ক্ষয় হয়। দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়; মানুষ তার জীবনের পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়। আল্লাহ মানুষ সৃষ্টির সময় তার আয়ু নির্ধারিত করে দেন। তিনি আয়ু বাড়াতে ও কমাতে পারেন। নেক আমল, দান-খয়রাত, পিতা-মাতার খেদমত, গুরুভক্তি এবং আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীর সেবা আয়ু বৃদ্ধির কারণ হয়।

আল্লাহ তাআলা সময়কে মানুষের প্রয়োজনে ব্যবহারোপযোগী করে প্রাকৃতিকভাবে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করেছেন। যেমন: দিন, রাত, মাস, বছর ইত্যাদি। বছরকে আমরা সাল বা সন বলি। সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর আবর্তনের সময়কালকে সৌরবর্ষ এবং পৃথিবীর চারদিকে চাঁদের আবর্তনের সময়কালকে চান্দ্রবর্ষ বলা হয়। মহানবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর হিজরতের বছরকে ইসলামি সন গণনার প্রথম বছর ধরা হয়েছে বলে এটি হিজরি সন নামে পরিচিত। হিজরি সন চান্দ্রবর্ষ ও সৌরবর্ষ উভয় হিসাবে গণনা করা হয়। সৌরবর্ষে ৩৬৫ ও ৩৬৬ দিনে বছর হয়, চান্দ্রবর্ষে ৩৫৪ ও ৩৫৫ দিনে বছর হয়। ইসলামি শরিয়তের ফিকহি বিধানগুলোতে বছর বলতে চান্দ্রবর্ষকেই বোঝানো হয়।

দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর (রা.)-এর খেলাফতের সময় ভূখণ্ড ইসলামি খেলাফতের অন্তর্ভুক্ত হয়। ঐতিহাসিক আলবিরুনির বর্ণনায়, হজরত আবু মুসা আশআরী (রা.) একটি পত্রে উমর (রা.)–কে জানান, আপনি আমাদের কাছে যেসব চিঠি পাঠাচ্ছেন, সেগুলোতে সন–তারিখের উল্লেখ নেই, এতে আমাদের অসুবিধা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে খলিফা উমর (রা.) একটি সন চালুর ব্যাপারে সচেষ্ট হন।

আল্লামা শিবলি নোমানি (র.) সুপ্রসিদ্ধ আল ফারূক গ্রন্থে উল্লেখ করেন: হজরত উমর (রা.)-এর শাসনামলে ১৬ হিজরি সনের শাবান মাসে খলিফার কাছে একটি দাপ্তরিক পত্রের খসড়া পেশ করা হয়, পত্রটিতে মাসের উল্লেখ ছিল; সনের উল্লেখ ছিল না। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন খলিফা বললেন, পরবর্তী কোনো সময়ে তা কীভাবে বোঝা যাবে যে এটি কোন সনে পেশ করা হয়েছিল? অতঃপর তিনি সাহাবায়ে কেরাম ও অন্যান্য শীর্ষ পর্যায়ের জ্ঞানী-গুণীদের পরামর্শে হিজরতের ১৬ বছর পর ১০ জুমাদাল উলা মুতাবিক ৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দে হিজরি সন প্রবর্তনের এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। হিজরতের বছর থেকে সন গণনার পরামর্শ দেন হজরত আলী (রা.)। পবিত্র মহররম মাস থেকে ইসলামি বর্ষ শুরু করার পরামর্শ প্রদান করেন হজরত উসমান (রা.)। (বুখারি ও আবু দাউদ)।

মহররম শব্দের অর্থ সম্মানিত। ইসলামের ইতিহাসে এই মাসটি এমন কতগুলো উল্লেখযোগ্য স্মৃতিবিজড়িত, যে স্মৃতিসমূহের সম্মানার্থেই এই মাসকে মহররম বা সম্মানিত বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। মহররম মাসের করণীয় আমলসমূহ হলো: চাঁদের প্রথম রাতে নফল নামাজ ও প্রথম দিনে নফল নামাজ। প্রথম দশ দিন নফল রোজা।

বিশেষত দশ মহররম আশুরার সুন্নত রোজা। আশুরার দিনে ও রাতে নফল নামাজ পড়া। মাসের তেরো, চৌদ্দ ও পনেরো তারিখে আইয়ামে বিজের সুন্নত রোজা, উনত্রিশ ও ত্রিশ তারিখ নফল রোজা এবং প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবার সুন্নত রোজা। এ মাসে প্রতি রাতে এক শ বার দরুদ শরিফ ও সত্তরবার ইস্তিগফার। (তরিকত শিক্ষা, খান বাহাদুর আহ্ছানউল্লা রহ. পৃষ্ঠা: ৩০ ও ৯৬; রাহাতুল কুলুব, ইমাম রাজিন রহ.)।

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আশুরার দিনে পরিবারের ব্যয় বৃদ্ধি করবে, ভালো খাওয়াদাওয়ার আয়োজন করবে, আল্লাহ সারা বছর তার প্রাচুর্য বাড়িয়ে দেবেন।’

মহররম মাস সম্পর্কে সাধারণে কিছু ভুল ধারণা রয়েছে। যেমন: এই মাসে বিয়েশাদি না করা, নতুন ঘরবাড়ি নির্মাণ না করা, কোনো শুভ কাজ বা ভালো কাজের সূচনা না করা, গোশত না খাওয়া ও নিরামিষ আহার করা, পান না খাওয়া, নতুন কাপড় ও সুন্দর পোশাক না পরা, সাদা কাপড় বা কালো কাপড় তথা শোকের পোশাক পরা, সকল প্রকার আনন্দ উৎসব পরিহার করা, তাজিয়া-মাতম করা, নিজেকে আঘাত করে ক্ষতবিক্ষত ও রক্তাক্ত করা ইত্যাদি।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজমের সহকারী অধ্যাপক

smusmangonee@gmail,com