দেশে ফিরিয়া কী করিব

বিদেশে পড়তে যাওয়া ছেলেমেয়েদের প্লেনে উঠিয়ে দেওয়ার সময় আত্মীয়স্বজনের অনেকে কেবল বলার জন্য বলেন, ‘পড়াশোনা শেষে দেশে ফিরবে তো?’ শিক্ষার্থীদের কারও কারও দেশাত্মবোধে চোখে জল চিকচিক করে। বলেন, ‘ফিরব না মানে? দেশের মাটি সোনার চেয়ে খাঁটি।’ কেউ কেউ এমন বক্র হাসি দেন, যা দেখে বুঝে নেওয়া কঠিন হয় না যে তিনি বলছেন, ‘আমার বাপু ওসব আবেগ-টাবেগের আদিখ্যেতা নেই। ও দেশে ভালো সুযোগ পেলে আর এ-মুখো হচ্ছিনে।’

বেশ অনেক দিন যাবৎই উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্তের অনেক পরিবার থেকে দু-একজন করে উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছেন। কেউ মা-বাবার কষ্টার্জিত অর্থে, কেউ মেধার জোরে বৃত্তি জোগাড় করে। সম্প্রতি প্রথম আলোয় প্রকাশিত সাহিত্যিক ও কলামিস্ট আনিসুল হকের ‘প্রবাসে থাকিব না দেশে ফিরিব?’

কলামে উল্লেখ আছে, ‘জরিপ বলছে, বাংলাদেশি তরুণেরা বিপুলভাবে বিদেশে চলে যেতে চান। একটা সময়ে আমরা দেখেছি, বহু স্কলার বিভিন্ন দেশে উচ্চশিক্ষা নিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন। এখনো সেই রকম মানুষ আছেন। কিন্তু সার্বিকভাবে সেই সংখ্যাটা কম। আর যেটা এই মুহূর্তে বলার কথা তা হলো, চীন কিংবা ভারতের মতো প্রবাসী মেধাবীদের দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে কোনো নীতি, কর্মসূচি ও প্রকল্প বাংলাদেশের নেই।’

বলা বাহুল্য, লেখক নারী-পুরুষ উভয় শিক্ষার্থীর কথাই বলেছেন। কিন্তু এবারের আলোচনায় বিদেশি ডিগ্রিপ্রাপ্ত নারীদের দেশে ফেরা না-ফেরা নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই। বেশ কিছুদিন আগেও অবিবাহিত নারীদের একা বিদেশে পড়া, বেড়ানো, চাকরি, প্রশিক্ষণ, সেমিনার ইত্যাদিতে যোগদানের ক্ষেত্রে পরিবারের সবাই থাকতেন খড়্গহস্ত। বিয়ে করে স্বামীর সঙ্গে বা স্বামীর কাছে চলে যাওয়াতে কারও কোনো আপত্তি ছিল না; বরং বিদেশে থাকা পাত্রের সঙ্গে বিয়ে হলে কনের পরিবারের মর্যাদা বেড়ে যেত।

কয়েক যুগ আগে কোনো পরিবার মেয়েদের হোস্টেলে পাঠালে সেই পরিবারকে প্রতিবেশী বা আত্মীয়স্বজনেরা পরিত্যাগ করতেন। এমনকি হোস্টেলে থাকা মেয়েদের বিয়ে নিয়েও সমস্যা হতো। নারীর শিক্ষা ও স্বনির্ভরতা এসব প্রতিকূল পরিস্থিতিকে সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। অবিবাহিত মেয়েদের দেশের বাইরে পড়াশোনা করার বাধাগুলোও একটু একটু করে দূর হচ্ছে। তাঁদেরও অনেকে ‘দেশে ফিরে দেশের ঋণ পরিশোধ করব’ বলে উড়াল দেন।

কিন্তু উচ্চশিক্ষা শেষে দেশে ফেরার বিষয়ে ছেলে ও মেয়েদের ভাবনার পার্থক্য লক্ষ করা যায়। না ফেরার প্রশ্নে উভয়ের মিল এক জায়গায়, সেটা হলো ঢাকার রাস্তার যানজট। এ ক্ষেত্রে ছেলেরা কিছুটা নমনীয়। যানজটে বিরক্তি ছাড়া তাঁদের অন্য কোনো সমস্যা কাবু করতে পারে না। কারণ দেশে ফিরে তাঁরা চাকরি করেন, গৃহকর্ম করেন না, যা তাঁদের বিদেশ করতে হতো। বিদেশে উচ্চশিক্ষাকালে ঘরসংসারের কাজ সেরে, রান্নাবাড়া করে ক্লাসে যেতে হয়। দেশে ফিরে এই ঝামেলা আর থাকে না। তাই ভালো মাইনে পেলে অনেক ছেলে দেশে ফিরতে চান।

নারীদের ব্যাপারটা একটু আলাদা। নারীরা বলেন, বিদেশে ক্লাস-চাকরি থেকে যানজটহীনভাবে ফিরে প্যাকেট খুলে রান্না গরম করা বা কিনে আনা খাবার খেয়ে নেওয়ায় ঝামেলা কম। সঙ্গে স্বামী থাকলেও দেশের প্রথা অনুযায়ী ঘরের কাজ ভাগ করে নেন। কিন্তু দেশে ফিরে মেধাবী নারী ঘরের বাইরে ছোট-বড় যে কাজই করুন না কেন, ঘরে ফিরে কখনো কখনো তাঁকে একাই সংসারের কাজের দায়িত্ব নিতে হয়।

বিদেশগামী শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রতিবছরই বাড়ছে। এক অনলাইন পত্রিকার ভাষ্য অনুযায়ী ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করতে গেছেন ৩ হাজার ১৭৬ জন শিক্ষার্থী। আগে ছেলেরা বেশি যেতেন, এখন মেয়েদেরও যাওয়া বাড়ছে। বিদেশে উচ্চশিক্ষা শেষে মেয়েরা কেন সচরাচর দেশে ফিরতে চান না? বিদেশে অধ্যয়নরত এবং সম্প্রতি দেশে ফিরেছেন এমন কয়েকজন নারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল তাঁদের অনীহার কারণ।

প্রথমত, গণপরিবহন। সবারই ব্যক্তিগত গাড়ি থাকবে এমন নয়। তাঁদের কাজে যাওয়া অনেক ঝামেলাপূর্ণ ও কষ্টকর। গণপরিবহনে ঠেলাঠেলি, যৌন হয়রানি, সিটবৈষম্য, কটূক্তি। কর্মক্ষেত্রেও বৈষম্যজনিত অসন্তুষ্টি। যেসব নারী, বিশেষ করে যাঁরা ইউরোপ-আমেরিকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়ে দেশে ফেরেন, তাঁদের কাছে ঘরে-বাইরে সবখানে জেন্ডার সমতার বিষয়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

এ দেশের অফিস-আদালতের সংস্কৃতি পুরুষতান্ত্রিক, সহকর্মীদের আচরণেও তার প্রকাশ ঘটে। এসব ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ বৈষম্য বিদেশি ডিগ্রিধারী নারীদের চাকরিবিমুখ করে তোলে। বিরূপ অভিজ্ঞতার শিকার এক নারী বলছিলেন, ‘একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন মাস চাকরি করে ছাড়তে বাধ্য হয়েছি। বিভাগীয় প্রধান ডেকে বলেছিলেন তাঁর বিভাগের কোনো নারী শিক্ষক নাকি আমার মতো বিজাতীয় পোশাকে ক্লাস নেন না। সবাই মাথা ঢেকে লম্বা হাতার কাপড় পরেন। আমি পরি প্যান্ট, ফতুয়া আর ওড়না। পরিবারের চাপে বিদেশের ভালো চাকরি ফেলে দেশে এসেছিলাম। আবার যাওয়ার চেষ্টা করছি। এত প্রতিকূলতার সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারব না।’

আর একজন একটা বহুজাতিক কোম্পানিতে ভালো বেতনে চাকরি পেয়েছিলেন। কর্মক্ষেত্র থেকে একে তো তাঁর বাসা বেশ দূরে, তার ওপরে অফিস সময়ের পরেও কাজের স্বার্থে তাঁকে আরও কিছু সময় বেশি থাকতে হতো। যানজটের কারণে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত ৯টা-১০টা। ছিলেন নববিবাহিত। শ্বশুরবাড়ির কেউই সেটা সুনজরে দেখেননি। নিজের মা-বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে স্বামীর ঘর ছাড়তে পারলেন না, কিন্তু চাকরি ছাড়তে হলো। আর এক সিঙ্গেল নারী চাকরি পেলেন, কিন্তু কেউ তাঁকে ফ্ল্যাট ভাড়া দিচ্ছিলেন না। শেষে যদিও একটা বাসা পেলেন, তাঁকে সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখা হতো তাঁর বাসায় কে এল-গেল তা দেখে রাখার জন্য।

এ ছাড়া সড়ক দুর্ঘটনা, নিরাপত্তার অভাব, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন, সর্বোপরি সুশাসনের অনুপস্থিতি নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য পীড়াদায়ক হলেও প্রবহমান পিতৃতান্ত্রিকতা উল্লিখিত প্রতিটি ঝুঁকির মধ্যে ঘাপটি মেরে নারীকেই বিশেষভাবে আক্রমণ করে।
তাই যত দিন না মানবমন ও পারিপার্শ্বিকতা নারীর স্বাধীন চলাফেরা ও মতপ্রকাশের প্রতিবন্ধকতা অপসারণ করবে, তত দিন প্রবাসে বসে ‘ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা’ বলে মেধাবী নারীর দূর থেকে প্রণতি জানানো ছাড়া গতি নেই।

উম্মে মুসলিমা কবি ও কথাসাহিত্যিক

muslima.umme@gmail,com