মন্দির-মসজিদের রাজনীতিই ভরসা বিজেপির?

ফের মন্দির-মসজিদের রাজনীতিতেই ফিরছে বিজেপি। উন্নয়ন বা স্বচ্ছতার বদলে ধর্মীয় তাসই হচ্ছে ২০১৯-এ ভারতের সাধারণ নির্বাচনে তাদের প্রধান পুঁজি। আসামের রাজধানী গুয়াহাটিতে এক অনুষ্ঠানে এসে সেটাই বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন ভারতীয় রাজনীতিতে ‘বেফাঁস’ মন্তব্যের জন্য সুপরিচিত সুব্রামনিয়াম স্বামী। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্চকেই তিনি ব্যবহার করলেন বিজেপির সাম্প্রদায়িক তাস আস্তিন থেকে বের করার জন্য। তাই রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, স্বামীর মুখ দিয়ে বের হলেও কথাগুলো আসলে বিজেপির থিংক ট্যাংকই রচনা করে দিয়েছেন। এর পেছনে অনেকে খুঁজছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে সরকারের ব্যর্থতাকেই।

জাতপাতের রাজনীতির বদলে উন্নয়ন আর প্রতিশ্রুতিকে পুঁজি করে ২০১৪ সালে মোদির নেতৃত্বে বিজেপি দিল্লির ক্ষমতা দখল করে। আসমুদ্রহিমাচল প্রদেশ কংগ্রেসের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের পাশাপাশি নতুন কিছুর স্বপ্ন দেখেছিল। ছিল কর্মসংস্থানের পাশাপাশি আর্থিক বিকাশেরও প্রতিশ্রুতি। বিদেশ থেকে কালোটাকা উদ্ধার থেকে শুরু করে বহু বিষয়ে হাই-টেক প্রচার এনে দিয়েছিল মোদির প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা। সেই স্বপ্নের ফেরিওয়ালার ডাকে মানুষ দুহাত ভরে সমর্থন করেছিল গেরুয়া বাহিনীকে। ছিল স্বচ্ছ প্রশাসনের অঙ্গীকারও।

কিন্তু চার বছরেই স্বপ্নভঙ্গের আভাস মিলতে শুরু করেছে। ভারতীয় লোকসভার বিভিন্ন উপনির্বাচনের ফলাফলও বিজেপির বিরুদ্ধেই যাচ্ছে। মোদি-মিথ অনেকটাই এখন এসে ঠেকেছে তলানিতে। বিভিন্ন সমীক্ষায় বলা হচ্ছে, বিরোধীরা ঐক্যবদ্ধ হলে বিজেপি জমানার পতন ঘটতে পারে। ১ জারা ও ৫০০ রুপির নোট বাতিল থেকে শুরু করে, পণ্য পরিষেবা কর ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষকে নাজেহাল করে তুলেছে। সেই সঙ্গে ‘কালো ধন’ আদায়ের তেমন সাফল্যও দেখাতে পারেনি। কাশ্মীর নিয়ে ভারতীয়দের আবেগ মারাত্মক। সেই কাশ্মীর সমস্যাও অথই জলে। দুর্নীতি নিয়ে গত সাধারণ নির্বাচনে কংগ্রেসকে বিদ্ধ করলেও এবার রাফেল যুদ্ধবিমান কেনা নিয়ে মোদি নিজেই অভিযুক্ত। খোদ রাহুল গান্ধী তাঁকে সংসদের ভেতরে ও বাইরে আক্রমণ চালাচ্ছেন। এ অবস্থায় স্বামীর আবির্ভাব ধর্মীয় তত্ত্ব হাতে। তিনি দক্ষ অর্থনীতিবিদ এবং শতভাগ গান্ধী পরিবারের বিরোধী। বর্তমানে বিজেপি থেকে রাজ্যসভার সদস্য। এর আগে অবশ্য জনতা দলের নেতা ছিলেন।

সামনের বছরের মার্চ-এপ্রিল নাগাদ ভারতে সাধারণ নির্বাচন। তার আগে মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ছত্তিশগড় ও মিজোরামে বিধানসভার ভোট হওয়ার কথা। এই বিধানসভা নির্বাচন বিজেপির কাছে বিশেষ পরীক্ষাও বটে। কারণ, বিজেপিশাসিত রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশে গেরুয়া শিবিরের পতন ঘটারও আশঙ্কা আছে। বিভিন্ন গণমাধ্যম সে রকমই আভাস দিচ্ছে। তাই এখন থেকেই সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপাতে চাইছে বিজেপি। কংগ্রেসের কৌশল মোটামুটি স্পষ্ট। রাফেল যুদ্ধবিমান কেলেঙ্কারিই তাদের প্রধান অস্ত্র। গোটা দেশে এখন থেকেই কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে রাহুল-ব্রিগেড। এর আগে রাহুল গান্ধীর বাবা প্রয়াত রাজীব গান্ধীর বিরুদ্ধে বোফর্স কামান কেনার অভিযোগ তুলে দারুণ সাফল্য পেয়েছিলেন বিরোধীরা। ১৯৮৮ সালে রাজীবের নেতৃত্বে বোফর্সের ঘায়ে কংগ্রেস সরকারের পতনের পর আর কখনো দলটি একক শক্তিতে ক্ষমতায় আসতে পারেনি। গত সাধারণ নির্বাচনেও কংগ্রেসের পরাস্ত হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল টু-জি, থ্রি-জি টেলিফোন কেলেঙ্কারিসহ একাধিক দুর্নীতির অভিযোগ। টেলিকম কেলেঙ্কারি থেকে অবশ্য কংগ্রেস কিছুটা মুক্তি পেয়েছে। তবু শতাব্দীপ্রাচীন দলটি জানে, আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগ নির্বাচনী যুদ্ধে কত বড় অস্ত্র। রাফেলকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে চাইছে তারা।

এ অবস্থায় কিছুটা ব্যাকফুটে বিজেপি। উন্নয়নের ফানুসও অনেকটাই চুপসে গেছে। পেট্রোপণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। কমছে রুপির দাম। মোহভঙ্গ হচ্ছে জনগণের। গত চার বছরে মোদির জনমোহিনী ইমেজেরও ধার কমেছে। সব মিলিয়ে মোদি-ম্যাজিকে এবার আর তেমন ভরসা রাখতে পারছে না বিজেপির হিন্দুত্ববাদী মেন্টর গ্রুপ রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস।

গেরুয়া শিবিরের দুর্গ রক্ষায় আবার সেই মন্দির-মসজিদের রাজনীতিতেই বোধ হয় ফিরতে চাইছে বিজেপি। কিছুটা ইঙ্গিত ছিলই উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের কথায়। কিন্তু স্পষ্ট করে দিলেন ‘দক্ষিণী চাণক্য’ সুব্রামনিয়াম স্বামী। গুয়াহাটিতে তিনি বললেন, ‘দিওয়ালির দিন থেকেই শুরু হবে রামমন্দির নির্মাণ-প্রক্রিয়া।’ তাঁর ব্যাখ্যা, ‘মুসলিমরা যেখানে খুশি নামাজ পড়তে পারেন। অযোধ্যায় ভগবান রামের একমাত্র জন্মভূমি। সেখানে হিন্দুরা কেন পূজা করতে পারবেন না?’ তাই তাঁর ঘোষণা, রামমন্দির হবেই।

শোনাতে ভুললেন না, ‘ভারত হিন্দু রাষ্ট্র। তাই হিন্দুরা এখানে স্বাগত।’ প্রশ্ন ছিল বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল নিয়ে। এই বিলে ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আগে অনুপ্রবেশকারী হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ, জৈন ও শিখদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়ার বিধান রয়েছে। শুধু নেই মুসলিমদের বেলায়। দেশের অ-বিজেপি প্রায় সব দলই বিলটির বিরোধিতায় সরব। এমনকি আসামেই বিজেপির জোট শরিক অসম গণপরিষদ বিলটির বিরোধিতায় পথে নেমেছে। এ অবস্থায় সুব্রামনিয়াম স্বামী আসামে বসেই বিজেপির হিন্দুত্ব লাইনকেই উসকে দিলেন।

কংগ্রেস অবশ্য বিজেপির এই কৌশল আগাম বুঝতে পেরেছে। তাই মহিলা কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সভানেত্রী সুস্মিতা দেব বলছেন, ‘মোদিজির সততার মুখোশ খুলে গেছে। মানুষ তাঁর সব ধোঁকাবাজি ধরে ফেলেছে। দেশের সবচেয়ে বড় দুর্নীতি রাফেলেই বিদ্ধ হবেন তিনি।’ কংগ্রেসেরই আরেক নেতা তথা আসাম বিধানসভার বিরোধী দলের নেতা দেবব্রত শইকিয়া আরেক কদম এগিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেন, ‘জাতপাতের রাজনীতি করে বিজেপি দেশে অশান্তি সৃষ্টি করে ঘোলা জলে মাছ ধরতে চাইছে। জনগণকে সতর্ক থাকতে হবে।’ পাশাপাশি তাঁর অনুমান রামমন্দির বা হিন্দুত্বের লাইনে ভারতের মতো ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে কোনো কাজ হবে না। মোদিজির বিদায় আসন্ন বলেই দাবি করেন দেবব্রত।

ভারতে জাতপাতের রাজনীতি ধরেই কিন্তু বিজেপির উত্থান। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে ‘মণ্ডল’ আর ‘করমণ্ডল’ এক্সপ্রেসে সওয়ার হয়েই ভারতের জাতীয় সংসদে ২ থেকে ৮৯ আসন হয় দলটির। মণ্ডল হলো ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং জাতপাতের ভিত্তিতে সংরক্ষণের জন্য মণ্ডল কমিশন গঠন করেন। এ নিয়ে গোটা দেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। আর করমণ্ডল হলো বিজেপির রামমন্দির গঠনের জন্য করসেবা। গোটা দেশে রথযাত্রা করেছিলেন বিজেপির বর্ষীয়ান নেতা লালকৃষ্ণ আদভানি। পরবর্তী সময়ে অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভাঙেন বিজেপির এই করসেবকেরা। এরপর বিজেপির উগ্র হিন্দুত্ববাদের মোড়কে সাফল্য বাড়তেই থাকে। তাই ফের সেই পুরোনো ছকেই ফিরতে চাইছে হিন্দুত্ববাদী দলটি। সুব্রামনিয়াম স্বামী সেটাই বুঝিয়ে গেলেন গুয়াহাটিতে।

তরুণ চক্রবর্তী প্রথম আলোর উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রতিনিধি