৯/১১-এর ধাক্কা শেষ হবে কবে?

নিউ কনজারভেটিজম বা নয়া রক্ষণশীলবাদ। সংক্ষেপে বলা হয় নিওকন। গত শতকে যুক্তরাষ্ট্রে শুরু হওয়া এক বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনৈতিক আন্দোলন। ৬০-এর দশকে এ আন্দোলন গড়ে উঠেছিল ডেমোক্র্যাট ও বামদের কেন্দ্র করে। কিন্তু ৭০-এর দশকে নিওকনরা নিজস্ব অবস্থান থেকে সরে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিকতাবাদ ও কমিউনিস্টবিরোধী নীতিকে ধারণ করে রিপাবলিকানদের ঘাড়ে সওয়ার হতে শুরু করেন। স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর নিওকনদের একটি দল প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনকে চিঠি দিয়ে বলেছিল, যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও নিজস্ব স্বার্থ রক্ষার জন্য বিশ্বের যেকোনো স্থানে হামলার অধিকার তাঁর আছে। এবং আফগানিস্তানে হামলা করা উচিত। সেই দলে স্যামুয়েল হানটিংটন, ডিক চেনি থেকে শুরু করে ডোনাল্ড রামসফেল্ডরাও ছিলেন। এটি তালেবানরা আফগানিস্তানে ক্ষমতা দখলের পরের এবং টুইন টাওয়ার ঘটনার আগের কথা। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন নিওকনদের দেখানো পথে হাঁটেননি। ক্লিনটন-পরবর্তী প্রেসিডেন্ট জুনিয়র বুশ পুরোপুরিই নিওকনদের মতবাদ দিয়ে সারা দুনিয়ায় এক ধ্বংসের আগুন জ্বেলে দেন। একের পর এক দেশে পশ্চিমা পরাশক্তিগুলোর জোটবদ্ধ হামলা হতে থাকে—আফগানিস্তান, ইরাক, সোমালিয়া ইত্যাদি।

নিওকনদের ইতিহাস উল্লেখ করলাম ৯/১১-এর ঘটনার প্রেক্ষাপটটা সামনে আনার জন্য। নিওকনরা যা করার জন্য ৭০ দশক থেকে উঠেপড়ে লেগেছিলেন, ৯/১১ সেই সুযোগটিই করে দিয়েছে। আগামীকাল ৯/১১-এর হামলার ১৯তম বার্ষিকী। এই বর্বরতম হামলার ১৯ বছর পরও ৯/১১-কে ঘিরে সন্দেহ, সমালোচনা ও আলোচনার কোনো সমাধান হয়নি। হবে বলেও মনে হচ্ছে না। বিশেষ করে যদি ৯/১১-এর পরবর্তী ঘটনা ও এর আগের দুই দশকের মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে নিওকনদের প্রভাব বিবেচনায় নেওয়া হয়। ৯/১১ নিয়ে মার্কিন প্রশাসনের নিজস্ব বয়ান আছে। কিন্তু এর বিপরীতেও অনেক বক্তব্য আছে। ২০০৯ সালের ১১ সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারে আসলে কারা হামলা করেছিল, এর পেছনে কাদের মদদ ছিল, জেটফুয়েলচালিত বিমান দিয়ে টুইন টাওয়ারের মতো বিশাল ভবন ধসিয়ে দেওয়া যায় কি না, এসব প্রশ্ন নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে। তথ্যচিত্র নির্মিত হয়েছে। সেই আলোচনায় না যাই। বরং দেখার চেষ্টা করি ৯/১১ কীভাবে রাজনীতির মানচিত্রটিকে বদলে দিয়েছে।

৯/১১-এর দুই ধরনের প্রভাব আছে। প্রথমত, ৯/১১ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নিওকনদের ধারণাকে পুরোপুরি বাস্তবায়নের পথ খুলে দিয়েছে। এর আগে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির মধ্যে যদিও কিছুটা রাখঢাক ছিল। কিন্তু ৯/১১-এর পর তাদের আর কোনো আড়াল-আবডালের প্রয়োজন হয়নি, কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্বও ছিল না। লাজলজ্জা বাদ দিয়ে মার্কিন সমরশক্তি বিশ্ব দখলে নেমে পড়ে। এবং যেকোনো যুদ্ধই মার্কিনরা সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধযুদ্ধ বলে জায়েজ করার চেষ্টা করেছে। এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘকে পাশে পেয়েছে আইনি বৈধতার জন্য। নিওকনদের দীর্ঘদিনের প্রচারণা, ৯/১১ ও জাতিসংঘের সহায়তা মার্কিননীতিকে আরও বেপরোয়া হতে উদ্বুদ্ধ করেছে। স্নায়ুযুদ্ধকালে মার্কিন আন্তর্জাতিকতাবাদের মূল শত্রু ছিল কমিউনিস্টরা। কিন্তু ৯/১১-এর পর মূল শত্রু এখন মুসলমানেরা। স্নায়ুযুদ্ধকালে আফগানিস্তান, কোরিয়া ও ভিয়েতনামে যুদ্ধ হয়েছে। এখন গোটা বিশ্বেই লড়াই হচ্ছে এক অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে। বলা যেতে পারে, অদৃশ্য শত্রু এল কোত্থেকে? সন্ত্রাসবিরোধী লড়াই তো হচ্ছে তালেবান, আল-কায়েদা বা আইএসের বিরুদ্ধে। তাহলে অদৃশ্য শত্রু করা? এখানেই সন্ত্রাসবাদবিরোধী অনন্ত লড়াইয়ের মূল চাবি লুকিয়ে আছে। যদি এই অদৃশ্য শত্রুকে দৃশ্যমান করা যায়, তবে সন্ত্রাসবাদবিরোধী লড়াই থেমে যাবে। যুদ্ধের দরজায় তালা মেরে দেওয়া যাবে। যুদ্ধবাজরা যার যার ঘরে ফিরে যাবে। সর্বোপরি মার্কিন আন্তর্জাতিকতাবাদ মুখ থুবড়ে পড়বে।

দ্বিতীয়ত, ৯/১১ অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে স্বৈরাচারীদের দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার পথকে মসৃণ করে দিয়েছে। আমরা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছি, এ কথা বললেই এখন পশ্চিমাদের সব ধরনের সহায়তা পাওয়া যায়। তাতে জনসাধারণের গণতান্ত্রিক অধিকার যতই হরণ করা হোক না কেন, পাকিস্তানের জেনারেল পারভেজ মোশাররফ বা মিসরের জেনারেল সিসি এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

আগেই বলেছি, ৯/১১ হামলা রহস্যের কোনো সমাধান হয়নি। কিছু কিছু ঘটনা আছে যার কখনোই সমাধান হয় না। কিন্তু তার রেশ থেকে যায় দশকের পর দশক। ৯/১১ এ রকমই এক ঘটনা। আজও আফগানিস্তান কেঁপে ওঠে আত্মঘাতী বোমা হামলায়। তালেবানরা আবারও শক্তিশালী হয়ে উঠছে। ইরাকে এতিম ও বিধবাদের সংখ্যা বাড়ছে। সিরিয় উদ্বাস্তুরা প্রতিদিনই ইউরোপে পাড়ি জমাচ্ছে। লিবিয়ায় গুম, খুন বাড়ছে। আইএস, আল-কায়েদার নেটওয়ার্কও বিস্তৃত হচ্ছে। নতুন নতুন দেশে সন্ত্রাসীরা নিজেদের উপস্থিতির জানান দিচ্ছে। সারা বিশ্বই এখন মারাত্মক নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

ঝুঁকি দুই দিক থেকেই আছে। কখন কোথায় সন্ত্রাসীরা হামলা করে, এ নিয়ে সর্বদাই শঙ্কা বিরাজ করে। এরপরের ঘটনা হয় আরও ভয়াবহ। সন্ত্রাসী হামলার পর সন্ত্রাস দমনের নামে ধেয়ে আসে মার্কিন মেরিন সেনা। এরা আবার সন্ত্রাস দমনের নামে ব্যাপকহারে জনসাধারণের ওপর হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা করে। আফগানিস্তান ও ইরাক এর উপযুক্ত উদাহরণ। যদিও মার্কিন মেরিন সেনার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে গণহত্যার অভিযোগ আনেনি। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে সুস্পষ্টভাবেই গণহত্যার অভিযোগ রয়েছে।

অন্যদিকে সন্ত্রাস দমনের নামে দেশে দেশে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ হয়, মানুষজন বিনা বিচারে বন্দী থাকে, রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন আরও বাড়ে। কিন্তু এত কিছুর পরও অদ্ভুত উপায়ে নতুন নতুন সন্ত্রাসী এবং সন্ত্রাসী ঘটনার জন্ম চলতেই থাকে।

কিছুটা গুজব, কিছুটা সত্য ও কিছুটা মিথ্যা তথ্যের ওপর ভর করে আফগানিস্তান ও ইরাককে ছারখার করে দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র এই দায় শোধ করবে কীভাবে? ইতিহাস তো বলে দায় শোধ না করে কেউ পার পায় না। জার্মানির উদাহরণ বিভিন্ন সময় দিয়ে থাকি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদিদের বিতাড়িত ও হত্যা করেছিল। এখন সিরীয় উদ্বাস্তুতে জার্মানির পথঘাট ভরে গেছে। আর্যদের নীল রক্তের বিশুদ্ধতা বোধ হয় আর রইল না। এভাবেই জার্মানি নিজ কৃতকর্মের দায় শোধ করছে। যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে দায় শোধ করে, সেটিই এখন দেখার বিষয়। নিকট ভবিষ্যতেই হয়তো আমরা মার্কিনদের দায় শোধেরও নমুনা দেখ পারব।

ড. মারুফ মল্লিক: ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো, ইনস্টিটিউট অব অরিয়েন্ট অ্যান্ড এশিয়ান স্টাডিজ, ইউনিভার্সিটি অব বন