রোহিঙ্গাদের নিয়ে কারা বিরক্ত আর কারা বিভ্রান্ত?

শরণার্থীদের ছোট চোখে দেখা এক বৈশ্বিক অভ্যাস। ছবি: প্রথম আলো
শরণার্থীদের ছোট চোখে দেখা এক বৈশ্বিক অভ্যাস। ছবি: প্রথম আলো

যাঁরা একাত্তর দেখেছেন, তাঁরা জানেন, বিপদে পড়া শহুরে মানুষদের গ্রামের মানুষ কেমন আত্মীয়ের মতো ঠাঁই দিয়েছিলেন। নিজেরা কষ্ট করে তাঁদের খাবার জুগিয়েছিলেন। দেশ স্বাধীন হলে গদি-চাকরি-শান-শওকত ফেরত পেলে তার কী প্রতিদান আমরা দিয়েছিলাম, কিংবা ৭৪ সালের খাদ্যাভাবের সময় গ্রাম থেকে আসা ক্ষুধার্ত মানুষদের দেখে বিরক্ত হয়েছিল কি না, সে প্রসঙ্গ নিয়ে এই লেখায় আলোচনা হবে না। আলোচনা হবে মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে টেকনাফ-উখিয়ার স্থানীয় সমাজের মনোভাব এবং চাওয়া-পাওয়া, লাভ-লোকসানের হালহকিকত। ‘খেয়ে এসেছেন, না গিয়ে খাবেন’ সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা শহুরে গবেষকেরা রোহিঙ্গা পরিস্থিতির শুরু থেকেই রোহিঙ্গাদের নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। বারবার তাঁরা টেকনাফ-উখিয়ার স্থানীয়দের বিরক্তির পারদ ওপরে ওঠার খবর দিয়ে যাচ্ছিলেন। হিসাব কষে জানিয়েছেন, স্থানীয় লোকজন সংখ্যালঘু হয়ে যাচ্ছেন দিন দিন। তা প্রমাণে সাত বছর আগের আদমশুমারির হিসাব নিয়ে আসছেন। এমন শুভংকরী আলোচনা শুনে অনেকেই তপ্ত-উত্তপ্ত হয়েছেন। ভুলে গেছেন একাত্তরে আগরতলা, বহরমপুর, কল্যাণী, কাছাড়, শিলংয়ে শরণার্থী আর স্থানীয় মানুষের সংখ্যাগত তারতম্যের কথা। 

উন্নাসিক ও সদা বিরক্ত গবেষক আর ধারণাশ্রী বিজ্ঞদের বিশ্বাস এ রকম: রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয় মানুষের জীবন-জীবিকা, পরিবেশের ভারসাম্য এবং বাজারব্যবস্থা উল্টেপাল্টে যাচ্ছে। ক্ষতি কিছু হচ্ছে বৈকি। তবে তার জন্য শরণার্থী বনাম যেকোনো পরিস্থিতিকে সংকটে পরিণত করায় পাকা ব্যবস্থাপকদের কার কতটা দায়, সে হিসাব নেওয়াটাও তো দরকারি। উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর সনাতন প্রায়াসের সঙ্গেও আমাদের পরিচয় আছে।

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কারণে বাংলাদেশের যেসব সংকট সৃষ্টি হচ্ছে বা হবে বলে বলা হচ্ছে, তার আলোচনা তাই করা যাক।

বন উজাড় হয়ে যাচ্ছে
এলাকার বন উজাড় হচ্ছে প্রধানত রান্নার জ্বালানি সংগ্রহের জন্য। রোহিঙ্গারা ঝোপঝাড় থেকে খড়ি সংগ্রহ করেন বা করতেন। বলে রাখা ভালো, আশেপাশের জঙ্গলগুলোর বড় বড় গাছ সমূলে ধ্বংস হয়েছে আরও আগে, আমাদেরই হাতে। তবে শরণার্থী–ঢলের শুরুতেই আমরা বিকল্প জ্বালানির ব্যবস্থা করতে পারতাম। প্রযুক্তি এবং সরবরাহ থাকা সত্ত্বেও ধানের কুঁড়া থেকে উৎপাদিত ‘তুষ খড়ি’ ব্যবহারের পথে আমরা হাঁটিনি। তবে আশার কথা যে বিকল্প ও সাশ্রয়ী জ্বালানির পথে আমরা দেরিতে হলেও এগোচ্ছি।

কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কে পরিবহন–সংকট
এই পরিস্থিতির জন্য মূলত দায়ী উড়ে বা ছুটে আসা দেশি-বিদেশি সংস্থাগুলো। তাদের গাড়ির স্রোতে রাস্তায় পা ফেলা দায়। যেখানে একটা গাড়িতে কাজ সারা যায়, সেখানে ছুটছে চারটা গাড়ি। স্থানীয় যানবহনও এখন ওই সব বিদেশি সংস্থার দেশীয় কর্মীদের দখলে।

স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে
ডিপথেরিয়া বড় বিপদের সংকেত নিয়ে হাজির হয়েছিল। সে পরিস্থিতি সফলভাবে সামাল দেওয়া গেছে। কিন্তু রোহিঙ্গা মায়েদের আন্তরিক সহযোগিতা ছাড়া ওই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যেত না। এ ছাড়া এইডসে আক্রান্ত ২৪ জন রোহিঙ্গাকে শনাক্ত করা এবং এই ব্যাধির বিস্তার রোধে শিবিরে বসবাসকারীদের ভূমিকাই প্রধান। যে যা–ই প্রচার করুন না কেন, শরণার্থীরা অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও স্বাস্থ্যবিধি পালনে যথেষ্ঠ হুঁশের নজির রেখে চলেছেন।

দ্রব্যমূল্যের বাড়তি চাপ
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে দুই থেকে তিন গুণ। উখিয়ার কোর্ট বাজারের দোকানি আবুল হাশেম অর্থশাস্ত্র পড়েননি, তবুও যেভাবে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করলেন, তাকে চট করে রাবিশ/বোগাস বলে বাতিল করা যাবে না। জানালেন মজুতদার পাইকারদের কারসাজি এবং ‘ক্রেতা বেশি মাল কম’ থাকার কথা। তাঁর ব্যাখ্যা এ রকম: স্থানীয় মানুষের গড় ক্রয়ক্ষমতা হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। প্রায় প্রত্যেক পরিবারে দু–তিনজন বিভিন্ন সংস্থায় চাকরি করছেন, ৩০ হাজার টাকার নিচে কোনো বেতন নেই। ক্লাস নাইন-টেনে পড়া ছেলেমেয়েরা পর্যন্ত চাকরিতে নেমেছে। অনেকেই বাঁশ-কাঠের ঠিকাদারি করছে। যাদের ঘরবাড়ি আছে, তারা পাঁচ হাজার টাকার ঘর ২০ বা ৪০ হাজার টাকায় ভাড়া দিচ্ছে, ভাড়াও বাড়ছে তিন মাস পরপর। বাতাসে টাকা উড়ছে, যে যেমনভাবে পারছে ধরছে, খরচের হাত লম্বা হচ্ছে। এসবের বাইরেও উখিয়া-টেকনাফ এলাকার উৎপাদিত কৃষিপণ্য, যেমন: পান, সুপারি, সবজি ইত্যাদির দাম যেকোনো সময়ের চেয়ে তিন-চার গুণ বেশি। উখিয়া-টেকনাফে পানের দাম আর চাহিদা এত বেড়েছে যে যশোর-কুষ্টিয়া থেকে পান এনে বাজার সামাল দিতে হচ্ছে। এসবের ফায়দা লুটছে বাজার নিয়ন্ত্রণকারী স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। আবুল হাশিমের মতে, আয় বাড়লে মানুষের খরচের হাত লম্বা হয়, ভোগ বাড়ে। যে কলা কিনে খেত না, সে এখন ডজন ধরে কলা কেনে—দাম তো বাড়বেই! শরণার্থীদের সরাসরি দায় এখানে কোথায়?

কক্সবাজারের উখিয়ার রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির। ছবি: প্রথম আলো
কক্সবাজারের উখিয়ার রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির। ছবি: প্রথম আলো


রোহিঙ্গারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে
ঘটনা সত্য। বাসাবাড়িতে কাজের মানুষের সংকটের সহজ সমাধান আমরা অনেকেই খুঁজছি রোহিঙ্গা নারীদের মাঝে। এ পর্যন্ত শুধু চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা থেকেই অন্তত ২৮ হাজার ৬০০ রোহিঙ্গাকে ক্যাম্পে ফেরত পাঠানো হয়েছে ৷ তবে এসব ঘটছে আমাদের দিগ্‌ভ্রান্ত নীতির জন্য। অল্প জায়গায় এতগুলো মানুষকে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে মাসের পর মাস বসিয়ে রাখলে এমনটিই হবে। তাদের কাজ দিতে হবে, লাগসই কাজ শেখার ব্যবস্থা করতে হবে। রেশন না দিয়ে নগদ টাকা বা ভাউচার দিতে হবে। দেশে ফেরার আলোচনায় তাদেরও অংশীদার করতে হবে। এ–সম্পর্কিত সব তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। তথ্যের অভাব গুজবের গজব তৈরি করে।

রোহিঙ্গা নারীদের দেহব্যবসায় জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা
নিরুপায় রোহিঙ্গা নারীদের দালাল চক্রের মাধ্যমে ‘সারভাইভাল সেক্স’ বা বেঁচে থাকার জন্য দেহ বিক্রিতে নামার প্রমাণ বিবিসি প্রকাশ করেছে। স্থানীয় দালাল আর কক্সবাজারে ‘রোহিঙ্গা উদ্ধারে’ আসা বিদেশিদের সম্পৃক্ততার সুস্পষ্ট আলামতও বিবিসি পেয়েছে। এরপর পুলিশের হুঁশ হলে এখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৩০০ জনেরও বেশি দালাল আটক হয়েছে। তাহলে দোষটা কার? যারা বেঁচে থাকার জন্য যেকোনো ত্যাগ স্বীকারে রাজি তারা দায়ী? নাকি যারা তাদের লালসার শিকার বানানোর জাল ফেলছে তারা দোষী? প্রায় সব ক্ষেত্রেই মেয়েদের গার্মেন্টস বা হোটেলে সম্মানজনক চাকরি দেওয়ার কথা বলে নিয়ে আসা হয়। এই অপরাধী চক্র দমনের দায়িত্ব তো সরকারের।

অপরাধমূলক নানা কর্মকাণ্ডে বা মাদক পাচারে জড়িয়ে পড়ার ভয়
মাদক ব্যবসা মূলত আমাদের নিজেদের ব্যবসা। সস্তা শ্রম দিতে আর ঝুঁকি নিতে রাজি যে–কাউকে মাদকের গডফাদারেরা রিক্রুট করে। এখানে রোহিঙ্গাদের আলাদা কোনো কোটাসুবিধা নেই।

গবেষকেরা আসলে কী খোঁজেন?
মাস তিনেক আগে শহর থেকে সরেজমিন তথ্য তালাশে যাওয়া একদল গবেষক স্থানীয় লোকজনের মুখোমুখি হন। তাঁরা জানতে চান: এই যে এত মানুষ, ছোট হাটবাজার, সরু রাস্তা, আসুবিধা হয় না? যেখানে–সেখানে ত্যাগ করে, অসুবিধা হয় না? পুরুষ কম নারী বেশি, আসুবিধা হয় না? আপনার লবণখেতে ঘর উঠিয়েছে, আসুবিধা হয় না?

স্থানীয় লোকজন কবুল করেন, আসুবিধা তো হয়ই! আবার প্রশ্ন ছোড়েন গবেষক, তাহলে এদের আশ্রয় দেয়াটা মনে হয় সরকারের ঠিক হয়নি, কী বলেন? মুহূর্তের মধ্যে চেহারা বদলে যায় স্থানীয় মেজবানদের। স্পষ্ট স্বরে জবাব দেন, ‘আমাদের কষ্ট হলেও হেরা থাক।’ পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘আপনারাও তো মানুষ। কোনো মানুষ তো চাইতে পারে না আরেকজনের জান যাক। বার্মা গেলে ওরা তো মারা যাবে!’ স্থানীয় যাঁর কথা বলছি, রাখাইনে সেনা অভিযান শুরু হওয়ার পর তাঁর ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। এরপরও বাড়ির পাশে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের এ পর্যন্ত ১০ হাজার টাকার খাবার কিনে দিয়েছেন বলে জানালেন। তাঁর ভাষায়, ‘আমি যখন খাই, তখন আমার সামনে এরা না খেয়ে থাকে। আমি মুসলমান, তারাও তো আমাদের ভাই। খাবার সময় তাদের কাউকে না কাউকে সঙ্গে নিয়ে খাই।’

গবেষকেরা এরপর যান বালুখালীর নতুন বস্তিতে। সেখানে জানতে চান, তাঁদের ঘরবাড়ির সামনে এভাবে রোহিঙ্গারা আশ্রয় নেওয়ায় তাঁদের স্ত্রীরা বিরক্ত কি না? উত্তর আসে, ‘ঘরে গিয়ে দেখেন পাঁচজন রোহিঙ্গা মা বসে আছেন।’ এঁরা এসেছেন ওই বাড়ির গোসলখানায় গোসল করতে। গবেষককে শুনিয়ে বললেন, তাঁদের স্ত্রীরা প্রতিদিন দোয়া করেন আরাকান যেন স্বাধীন হয়। এঁদের ওপর জুলুম যেন শেষ হয়।

উখিয়া-টেকনাফের অসংখ্য মানুষ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের এভাবে আশ্রয় আর সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছেন। এটাই সত্যি যে আন্তরিক কষ্ট স্বীকার করেই তাঁরা সেটা করছেন। সাধারণ মানুষের মানবিকতা বোধের খবর না রাখলে কী করে চলবে?

গওহার নঈম ওয়ারা: দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মী ও গবেষক